শহুরে গিন্নির সাতকাহন

বনানী রায়:

গৃহিণী, গিন্নি, গৃহকর্ত্রী, হাউজ ওয়াইফ, হোম মেকার কত নাম। আসুন আমরা গৃহিণীর সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করি।

সোজা কথায় বলতে গেলে যিনি সংসারের রান্নাবান্নাসহ যাবতীয় কাজ, সন্তান লালন পালন, সংসারের অন্য সদস্যদের দেখাশোনা, স্বামীর মনোরঞ্জন করে থাকেন, তিনিই গৃহিণী।

একটু মন দিয়ে ভেবে বলতে গেলে যিনি নিজের স্বপ্ন ভুলে সংসারের সবার জন্য স্বপ্ন বুনেন এবং সন্তানের মাঝে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন তিনিই গৃহিণী।

অন্যভাবে বলা যায়, যিনি সারাদিন সবার পছন্দের খাবার তৈরি করে সবার সামনে তুলে ধরেন, কিন্তু নিজে মুখে দেন না এবং যার খাওয়া না খাওয়া এতোটাই তুচ্ছ যে সেই খবর কেউ রাখে না বা জিজ্ঞেস করার কথা মনেও পড়ে না কারও, তিনিই গৃহিণী।

আবার যদি এভাবে বলতে যাই, যিনি নিজের মনের অজান্তেই নিজের স্বপ্ন বটিতে বা ছুরিতে কুচোতে থাকেন, আর আগের কথা ভাবতে থাকেন; তারপর কারও ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখের জল গোপন করে হাসি মুখে সবার ফরমায়েশ খাটেন, তিনিই গৃহিণী।

এবার দেখি বিনা পারিশ্রমিকে একজন গৃহিণী কী কী কাজ করেন:

১. নিত্য রান্না বান্না তো আছেই, তাছাড়া স্বামী সন্তান এবং অন্য সদস্যদের বিশেষ রকমের সব খাবার বানানো। (অনেকে বাটাবাটি, কাটাকুটিও করেন)।
২. সংসার টাকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা (অনেকে ঘর মোছা, কাপড় কাচার কাজও করেন)।
৩. সন্তানকে স্কুলে নেওয়া আনা থেকে শুরু করে টাকা দেওয়া ছাড়া সন্তানের লেখাপড়ার বাকি সমস্ত ঝক্কি পোহানো।
৪. স্বামীর কাপড়চোপড় লন্ড্রিতে পাঠানো এবং সময়মতো এনে রাখা।
৫. সন্তানের স্কুল ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্কুলে যাবার যোগ্য করে রাখা।
৬. সন্তানের স্কুলের টিফিন বানানো।
৭. বাজার করা বা করানো।
৮. বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি থাকলে তাদের সেবা যত্ন করা, ওষুধ খাওয়ানো (অবশ্য সবাই সেটা করে না, আমি স্বীকার করছি)।
৯. সন্তান বেশি ছোট হলে তাকে নিজ হাতে প্রত্যেক বেলা খাইয়ে দেয়া এবং পড়ালেখা করানো।
১০.. ব্যাংক থেকে টাকা তোলা এবং জমা দেয়া।
১১. সময়মত ইন্সুরেন্স এর পলিসি জমা দেওয়া।
১২. বাথরুমের কল, বেসিনের কলে লিক, রান্নাঘরের ময়লার লাইনে জ্যাম- এসবের জন্যে মিস্ত্রি ডাকা।
১৩. কারো অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া।
১৪. পরিবারের সবার জন্যে জামা কাপড় কেনা।

*আরো টুকিটাকি কত কী!

এই কাজগুলো সব সময় যে গিন্নিরা কষ্ট নিয়ে করে তা কিন্তু নয়, তারা সংসারকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে। আবার সব পুরুষও যে একই রকম তাও নয়। সব কিছুর মধ্যে ব্যাতিক্রম তো থাকবেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিত্রটি মোটামুটি এরকমই। গৃহিণীরা ভালোবেসে নিজের কথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা না করে সংসারে প্রদীপের মত নিজে পুড়ে আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যারা তাদের কাছ থেকে দু হাত ভরে নিচ্ছে তারা কি কখনও ভেবেছে গৃহিণীদের তারা কি দিচ্ছে। খাবার, কাপড় চোপড়, কোনো অনুষ্ঠানে গয়না, নতুবা আরো কোনো দামী উপহার, একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। ব্যাস, তাদের দায়িত্ব শেষ? একটু ভাবা দরকার, গৃহিনীদের বোঝা দরকার, তাদের মনের চাহিদার খোঁজ রাখা খুব দরকার।

সব গৃহিণী এক কাতারের নয়। কেউ স্বল্প শিক্ষিত, কেউ বেশি শিক্ষিত, কেউ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ পারদর্শী ছিল, কেউ খেলাধুলায় বেশ পরিপক্ক ছিল, কেউ খুব সুন্দরী মডেল বা নায়িকা হওয়ার বাসনা ছিল, কারো লেখার হাত ছিল চৌকষ, কারো বুদ্ধির ধার ছিল আর দশটা মানুষের চেয়ে বেশি, কেউ বা চাকরি করত বিয়ের আগে, কেউবা চাকরি ছেড়েছে সংসারের তাগিদে। তাই সব গৃহিণী ঘরকন্না নিয়ে সন্তুষ্ট , নাকি চোখের জলের আড়ালে সন্তুষ্টির চেষ্টা, কবে কে খবর রাখে? সব গৃহিণীরা যে খারাপ আছে আমি তা বলব না বরং অনেকে হয়তো ভালোই আছে। সমস্যা হল আত্মসম্মান জ্ঞান যাদের একটু বেশি তাদের। আর যারা নিজের গুন থাকতেও তার কদর পাচ্ছেনা, তাদের। কোথায় যেন পড়েছিলাম মেয়েদের বুদ্ধি ও জ্ঞান কম থাকা ভাল। আমি বলি গৃহিণীদের বুদ্ধি ও বোধ কম থাকা ভাল, তাতেই তাদের মঙ্গল।

যারা কর্মজীবী তাদের যদি বেতন না দেওয়া হয়, বা যোগ্যতার তুলনায় খুব সামান্য কিছু বেতন দেওয়া হয় এবং তাদের কাজের যদি মর্যাদা না দিয়ে ছোট কাজ বা নিচু কাজ হিসেবে দেখা হয় তবে তাঁদের কেমন লাগবে, ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখা দরকার। প্রত্যেকটা মানুষ তার কাজের জন্যে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মর্যাদা চায় এবং সেটা যখন তিনি পান তার কাজের আগ্রহ ও দায়িত্ববোধ আরো বেড়ে যায়। তিনি তখন সন্তুষ্টির সাথে তাঁর কাজটা দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে করতে থাকেন। কারো কি কখনও মনে হয়না যে, একজন গৃহিণী তার সমস্ত মেধা,মনন, শ্রম, দায়িত্ববোধ সবকিছু দিয়ে যে সংসারটাকে ধরে রেখেছেন তার নিজস্ব কিছু দরকার। তার কাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক
মর্যাদা দরকার। যদি একজন গৃহিণী তার স্বামীর বেতনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ তার নিজের বেতন হিসেবে পায় তবে তিনি সেই অর্থকে তার নিজের সারামাসের কষ্টের উপার্জন ভেবে মনে সন্তুষ্টি পাবেন। এই অর্থ তিনি কিভাবে খরচ করবেন সেটা একান্তই তার অধিকার। এই অর্থ তিনি ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে পারেন, সংসারের প্রয়োজনে খরচ করতে পারেন, সংসারের সদস্যদের বিশেষ দিনগুলোতে উপহার দিতে পারেন, তিনি অসহায় মানুষের জন্য দান করতে পারেন, বাবার বাড়িতে প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করতে পারেন। এই অর্থের জন্যে তার কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না, থাকবে না দান নেবার বা চেয়ে নেবার অগৌরব।

কত আইন পাস হয়, এই আইন কেন পাস হয়না আমি জানি না। আমি অতি সামান্য একজন মানুষ, উপরের স্তরে যারা আসীন তাদের কাছে পৌঁছানো বা সব গৃহিণীর পক্ষ থেকে আমার এই দাবি তুলে ধরা বা প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপায় আমার জানা নেই। আমি খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে সবার কাছে গৃহিনীদের কাজের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মর্যাদার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে চাই।

কতকিছু বদলালো, বাঙালি মেয়েদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে ঘুরে আবার যেন ঠিক আগের জায়গাতেই এসে গেড়ে বসলো। সতীদাহ প্রথা বন্ধ হলো, বাল্য বিবাহ বন্ধ হলো, বিধবা বিবাহের প্রচলন হলো, মেয়েদের লেখাপড়ার প্রচলন হলো, একসময় মেয়েরা ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ শুরু করলো। ধাপে ধাপে এগিয়েছে মেয়েরা, তবে কোনো কিছুই খুব একটা নিষ্কণ্টক ছিল না। বিভিন্ন পদক্ষেপে যখনই মেয়েরা কিছুটা এগিয়েছে এই এগোনোতে প্রত্যেকবার পাশে ছিল কিছু বিশাল হৃদয়, সুবিবেচক এবং সহানুভূতিশীল মহান পুরুষ। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের কোনো দুঃখ, দাবি, লড়াই আজ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি, যদিনা সেখানে কিছু সমঝদার এবং উদার মনের পুরুষ এগিয়ে এসেছেন। তাই সব পুরুষদের প্রতি আহ্বান নিজের ঘরে যিনি আলো জ্বালাচ্ছেন, লক্ষ্য রাখবেন সেই আলোর হল্কায় তার হৃদয় না পোড়ে। তিনি অসম্মানিত না হন।

শেয়ার করুন: