নারী না পুরুষ, কে বেশি হবেন এই বৈশ্বিক মহামারীর মারাত্মক শিকার?

কাকলী তানভীন:

সারা বিশ্ব জুড়ে করোনা এখন একটি আতঙ্কের নাম। মাত্র একমাসের ব্যবধানে আতঙ্কের সংবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশে। বৈশ্বিক এ মহামারীর বিস্তার রোধ ও নিরাময়ে করণীয় দিকগুলি নিয়ে যেমন আলোচনা ও পরিকল্পনা করছেন বিশেষজ্ঞগণ, তেমনি তা বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে তৎপরতা।

কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত নারীর তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বেশি। ইতালি, চীন, আমেরিকা, স্পেইন সহ আক্রান্ত দেশগুলিতে এই সংখ্যা প্রায় একই রূপ পরিস্ফুটিত। চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কট্রোল এর স্টাডি রিপোর্টে দেখা যায় যে করোনায় আক্রান্ত পুরুষের মৃত্যুর হার শতকরা ২.৮ ভাগ, যেখানে নারীর মৃত্যু হার শতকরা ১.৭ ভাগ, যেখানে তারা করোনা আক্রান্ত মোট ৪৪,৬০০ জন নারী ও পুরুষের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন।

গবেষকগণ কতিপয় দিককে এর কারণ হিসেবে মনে করছেন যার মাঝে পুরুষদের জীবন যাপনের ধরনকে তারা অন্যতম বলে মনে করছেন যা নারীদের তুলনায় অনেকটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে পুরুষদের ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণের মতো দিকগুলিকে তারা উল্লেখ্য বলে মনে করেন।
বিশ্লেষকগণ এর বায়োলজিক্যাল দিকটিও ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে আমাদের শরীরে যে এক্স ক্রোমোজম থাকে তাতে রোগ প্রতিরোধী কিছু জিন থাকে, যেহেতু নারীদের এক্স ক্রোমোজম দুটি আর পুরুষের একটি, তাই পুরুষের তুলনায় নারীর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বেশি, যার ফলে রোগ সংক্রমণ থেকে তারা তুলনামূলক সহজেই সেরে উঠেন।

নারীর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা যে পুরুষের চেয়ে বেশি তা এ্যানালস্ অব ইন্টারনাল মেডিসিন এ প্রকাশিত একটি গবেষণা রিপোর্টেও দেখা যায় সার্স এর অভিজ্ঞতার আলোকে। যেখানে দেখা যায় ২০০৩ সালে হংকং এ সার্স এ নারীর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি পুরুষ মারা গিয়েছিলেন। তবে নারীর এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হবার দিকটি এখনো গবেষণাধীন।
এখন আসা যাক জেন্ডার ও ডাইভারসিটিতে এর সংশ্লিষ্ট স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের দিকটিতে। যেকোনো মহামারী আর্থ-সামাজিক নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব রাখে নারী পুরুষ, বর্ণসহ ডাইভারসিটির প্রতিটি দিকে। সার্স, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লুর মত মহামারীগুলোর গবেষণা থেকেও দেখা যায় যে নারীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বেশি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বৈশ্বিক এই মহামারীতে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে তাতে প্রায় ২৫ মিলিয়নের অধিক মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে। আর বিভিন্ন গবেষণা ফল দেখিয়ে দেয় যে নারীরাই এর শিকার হবেন বেশি। অলাভজনক সংস্থা ক্যাটালিস্ট এর মতে, গবেষণা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে যখন আয়মূলক প্রতিষ্ঠানগুলির পরিসর ছোট হয়ে আসে তখন ডাইভারসিটির দিকটি গৌণ হয়ে ওঠে। এমন মহামারী দীর্ঘদিন চলতে থাকলে, পরিবারে নারী সদস্যটিকেই আয়মূলক কাজ থেকে সরে আসতে হবে লিঙ্গ বৈষমের প্রভাবে আর পরিবারের দেখভাল নিশ্চিত করার জন্য। আবার বিশ্বব্যাপী নারী পুরুষের শ্রম বৈষম্য যেভাবে কমে আসছিল তা এ ধরনের মহামারীর ফলে লিঙ্গ সমতায় আসতে আরো ৭০ বছর লেগে যেতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএন উইমেন মনে করে।

যেকোনো ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন স্বাস্থ্যকর্মীরা আর ডাক্তার ও নার্স তাদের মাঝে প্রধান। এক্ষেত্রে নারীরাই অধিক সংখ্যক হারে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত মোট মানবসম্পদের শতকরা ৭০ ভাগই নারী। আমাদের দেশেও এই হার বেশি এবং বিশেষ করে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত নার্সদের মধ্যে নারীদের অনুপাত পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।
এ ভাইরাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে এদেশের পোশাক শিল্প। রপ্তানীমুখী এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১২ লাখ পোশাক শ্রমিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ব্যাপক ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন, যার ৪৬.১৮ শতাংশ হলেন নারী (তথ্য: বিবিএস, সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ)।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএফপিএ এর মতে, কোভিড-১৯ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রকে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত করছে এবং তা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সময়োপযোগী সহযোগিতা ও সেবাপ্রদান প্রদানে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে একথা বলা হয়েছে তথাপি বাংলাদেশও এই অভিজ্ঞতার বহি:র্ভূত নয়।
আবার বিশ্বব্যাপী এ মহামারীতে নারীর যে ভূমিকা সেক্ষেত্রেও আমাদের সহায়ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। প্রাণঘাতী এ মহামারীতে গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধ ব্যক্তিদের সেবা, স্কুল বন্ধের কারণে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় যত্ন নেয়া যেমন নারীদের অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণ হয়েছে, তেমনি মহামারীজনিত প্রেক্ষিতে নারীর প্রতি যে সহিংতামূলক পরিস্থিতি তৈরি হয় তাতেও ভুগবেন নারীরা।

এ ধরনের একটি প্রেক্ষিতে সরকার, নীতিনির্ধারকসহ সকল স্তরের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে অসরকারী প্রতিষ্ঠান গুলিকেও। এ ধরনের এক সঙ্কট শেষে, ফিরিয়ে আনতে হবে নারীকে তার আয়মূলক ভূমিকায়। নিশ্চিত করতে হবে পরিবেশ ও নারীবান্ধব নীতিমালা। আর্থিক বরাদ্দও নিশ্চিত করতে হবে নারীদের ফিরিয়ে আনতে, গৃহে নারীর সহযোগিতায় কাজ করে যেতে পুরুষদের।

স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত মানব সম্পদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি নারী সেবাদানকারীদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী সকল উপকরণ সঠিক সময়ে নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের সেবা প্রদান করতে পারেন।
নারী সহিংসতার ঘটনায় ও তা প্রতিরোধে সেবাসমূহ যেন শিথিল না হয়ে বরং আরও কার্যকর হয়ে উঠে, সেদিকে তৎপর থাকতে হবে কর্তৃপক্ষসহ সকল সরকারি ও বেসরকারি সেবাদানকারী সংগঠনগুলিকে।

রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে সরকার যে প্রনোদনা ও ভাতাসমূহ বরাদ্দ করছেন তা যেন হয় নারীর প্রতি সহায়ক এবং উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে নারীর সমতায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি পরিকল্পনা ও বরাদ্দ বন্টন যেন হয় নারীবান্ধব। পোশাক শিল্পে নারীরা যেন এই বরাদ্দের সুফল এখন থেকেই পেতে পারেন সে দিকটিও সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

যদিও করোনা ভাইরাস এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের দিকটি এখন সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার, তবে এর দীর্ঘমেয়াদী আর্থসামাজিক প্রভাব এবং লিঙ্গ ও বর্ণ বৈষম্যসহ ডাইভারসিটির সমতার দিকটিগুলি এখন থেকেই আমলে আনতে হবে নীতি নির্ধারণ মহলে।
অতিরিক্ত তথ্যসূত্র: ওয়ার্লড ইকোনোমিক ফোরাম, সিএনএন, ওয়ার্লড হেলথ্ অরগানাইজেশন, হন্টান্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন, দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস্ ।

কাকলী তানভীন
উন্নয়ন বিশ্লেষক

শেয়ার করুন: