ফাহমি ইলা:
‘করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় উহানের কোয়ারেন্টাইন কৌশলে বিশ্ব বিস্মিত হয়েছিলো, কিন্তু এ পর্যায়ে এসে মনে হয় এটি আসলে কার্যকর পন্থা ছিলো’।
করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে এর উৎপত্তি স্থল উহান শহরকে যখন চীন সরকার লকডাউন করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো, তখন পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো এবং বিশেষজ্ঞরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলো। বেইজিংয়ের সিদ্ধান্তটি ছিলো নিজেদের জন্য একটি বিশাল পরীক্ষা। এপিডেমিওলোজিস্টরা সাবধান করে বলেছিলো, এতো অর্থনৈতিক মূল্য ও প্রাণের বিনিময়েও এই কৌশল কাজ নাও করতে পারে। আধুনিক বিশ্বে এতো বড় পরিসরে এর আগে কখনোই কোয়ারেন্টাইন করা হয়নি।
উহানের জনসংখ্যা প্রায় ১১ মিলিয়ন, এবং আশপাশের শহরের আরও ১০ মিলিয়ন মানুষকে দ্রুত লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছিলো। কারণ সংকট খুব দ্রুত হারে দৃশ্যমান হয়ে উঠছিলো এবং প্রকট আকার ধারণ করছিলো। এর পরের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে চীনের এই কৌশল নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে। কিন্তু দু’মাসের মধ্যেই বেইজিংয়ের এই কঠিন সিদ্ধান্তের স্বীকৃতি মিলেছে।
চীনের রিপোর্ট অনুযায়ী, গতকাল ১৯ মার্চে নতুন করে কোনো রোগী পাওয়া যায়নি, তার মানে স্থানীয় পর্যায়ে বিস্তার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। গতকাল যেসব নতুন রোগী সনাক্ত করা হয়েছে, সবাই সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছে।
ইতালি এবং স্পেন থেকে শুরু করে জার্মানি, ক্যালিফোর্নিয়া সবাই এখন এই নীতি অনুসরণ করা শুরু করেছে, যদিও কেউই উহানের মতো এতোটা কঠোর হতে পারেনি।
লক ডাউন ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শহরের অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের সকল যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি ব্যক্তিগত এবং মেডিক্যাল ইমার্জেন্সির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিলো না। স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই ছুটিতে ছিলো, সেগুলোকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। খাবার এবং ওষুধের দোকান বাদে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়, বিশেষ অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয় এবং বেশিরভাগ গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথমদিকে মানুষজনের ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুনোর অনুমতি ছিলো, এক্ষেত্রেও দ্রুত কঠোর নিয়ম জারি হয়। কিছু এলাকায় প্রতি পরিবার থেকে একজন সদস্য দুইদিন অন্তর অন্তর একবার জরুরি জিনিসপত্র কিনতে বের হতে পারতো, বাকিদের ঘর ছেড়ে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিলো। তারা চাইলে খাবার এবং জরুরি জিনিস কুরিয়ারে অর্ডার করতে পারতো।
পরবর্তীতে নিয়ম কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা শুরু করে এবং রোগী সনাক্ত হলে জোরপূর্বক তাদেরকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে হাসপাতালে স্থানান্তর করা শুরু করে। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, একজন প্রতিবন্ধী ছেলের বাবা এবং ভাইকে তার কাছ থেকে আলাদা করে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়ার পর খাদ্য, পানি এবং অন্যান্য সাহায্যের অভাবে ছেলেটি মারা যায়।
উহানকে লক ডাউন করার পরপরই অন্যান্য এলাকাতেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা শুরু হয়। কারণ অনেক মানুষ ভাইরাসের ভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো, যারা নিজেরাও কোভিড-১৯ ভাইরাস বহন করে অন্য কোথাও ছড়িয়ে দিতে পারতো বলে ধারণা করা হয়। প্রায় সব বিল্ডিংয়ে মনিটরিংয়ের জন্য সিকিউরিটি গার্ড ছিলো, আবাসিক এলাকায় সেখানকার বাসিন্দা বাদে কেউ ঢুকতে বা বেরুতে পারতো না।
মাস্কের ব্যবহার সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো ব্যাপক হারে এবং বেশ কিছু জায়গায় মাস্ক আরও বেশি প্রয়োজন হচ্ছিল। সরকারি মালিকানাধীন ট্যাবলয়েড পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস ৩১ জানুয়ারি টুইটারে একটি ভিডিও ফুটেজ শেয়ার করে যেখানে দেখানো হয় কর্তৃপক্ষ ড্রোনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী মঙ্গোলিয়ার মানুষজনকে সতর্ক করবার চেষ্টা করছে। মঙ্গোলিয়া উহান থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সে সময়ে সেখানকার জনসাধারণ মাস্ক ছাড়াই অবাধে চলাচল করছিলো।
চীনের সাথে গভীর সম্পর্ক আছে এমন দেশগুলো যেমন সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান, উহানের এই কৌশল অনুসরণ করে ভাইরাসের বিস্তারকে দ্রুত ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে। এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে স্ক্রিনিং, টেস্টিং, ট্রেসিং এবং প্রারম্ভিকভাবে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করা।
ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের এসিস্টেন্ট প্রফেসর Chen Xi বলেন যে, যদিও চীন সাফল্যের সাথে করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করেছে, তবু সব পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি ছিলো না। তিনি বলেন- ‘আমি মনে করি না এই বিশাল লক ডাউন এতোদূর পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলো। হুবাই এতো কঠোরভাবে লকডাউন কৌশল গ্রহণ করেছিলো, কারণ সংকট এতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো যা ততদিনে তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছিলো।’ অন্যান্য দেশগুলো এখান থেকে কোন কোন পদ্ধতিকে গ্রহণ করতে পারে এ প্রশ্নে তিনি জানান- ‘সামাজিক দূরত্ব, প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয়, প্রারম্ভিক বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার মতো কৌশলগুলি অন্যান্য দেশগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে পারে।’

চীন এখনও তার পাহারা শিথিল করেনি। উহান এখনো ব্যাপক পরিসরে লক ডাউনে আছে, যদিও কিছু মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্রে ফেরত যাওয়া শুরু করেছে। কিন্তু ভাইরাস আবার ফিরে আসার আশংকায় দেশব্যাপি এখনো কঠোর নিয়ন্ত্রণ চলছে। অনেক রেস্তোরা এবং দোকানে ক্রেতাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপবার ব্যবস্থা রয়েছে এবং প্রবেশের পূর্বে তাদের তথ্য এন্ট্রি করতে হচ্ছে, এমনকি প্রবেশের জন্য আলাদা পথও নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক বিল্ডিংয়ে আবার সফটওয়্যার ‘Health Code’-এর মাধ্যমে ঢোকার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। সফটওয়্যারটি একজন ব্যক্তিকে তার সাম্প্রতিক ভ্রমণের তথ্য অনুযায়ী একটি রঙ দিয়ে সনাক্ত করে দিচ্ছে। কর্মকর্তারা বিদেশ ফেরত মানুষের দ্বারা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে সতর্ক রয়েছে।
বেইজিং ও আনহুই প্রদেশে আসার সাথে সাথে ভ্রমণকারীদের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোয়ারেন্টাইনে যেতে হচ্ছে। অন্যান্য প্রদেশ যেমন সাংহাই এবং গুয়াংডং প্রদেশে সংক্রমিত দেশ থেকে আসা ভ্রমণকারীদের নিজ বাসা অথবা সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাংহাইয়ের একটি হোটেলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় অতিথিদের শরীরের তাপমাত্রা মাপবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান