দিনা ফেরদৌস:
পরিবারের বড় মেয়েরা একটু বোকাসোকাই হয় সাধারণ নিয়মে। প্রথম সন্তান হিসেবে ফলো করার কেউ না থাকায়, তারা নিজের মতো ধীরে ধীরে বড় হয়, সেই সঙ্গে মা-বাবারাও শিখতে থাকেন বাচ্চা পালন। পরিবারের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বাচ্চারা একটু চটপটে হয়, কারন তাদের ফলো করার বড় ভাই/বোন যেমন থাকে, তেমনি দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তানের বেলায় হয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন বাবা- মা; ততোদিনে বাচ্চা পালনে তাদের ধৈর্য, বুদ্ধি, জ্ঞান বা কৌশল সব আয়ত্তে চলে আসে। যার কারণে বড়দের থেকে ছোট ভাইবোনেরা ভালো সার্ভিস পায় পরিবার থেকে।
ফলে দেখা যায়, যেকোনো ব্যাপারে পরিবারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাচ্চারা হয় বড়দের থেকে অনেক চটপটে, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী হয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ দেখা যায় ছোটরা থাকে এগিয়ে। ব্যতিক্রম তো আছেই, তবে আমার আলোচনার বিষয় ব্যতিক্রমীদের নিয়ে নয়, সচরাচর যেমন হয় তাই নিয়ে বলবো আজ।
বলতে শোনা যায় পরিবারের বড় মেয়েরা একটু বোকাসোকাও হয়। দেখতেও নাকি তেমন সুন্দর হয় না, ফলে বড়দের পাশাপাশি ছোট বোন আরেকটা থাকলে সকলের নজর ছোটটার দিকেই থাকে। ছোট বোনেরা চটপটে হওয়ার কারণে দেখা যায় পরিবারের লোকজনও তাদের কাছে প্রত্যাশা রাখে বেশি। তাদের সংসারে সবক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়ে, জাতে উঠার স্বপ্নও থাকে পরিবারের।
ফলে দেখা যায় পরিবারের লোকজনের বড় মেয়েদের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও বড় মেয়েরা নিজেদের অবহেলিত মনে করে। বড় বলে সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে, বড়দের একটু মানিয়ে চলতে হয়, বুঝে শুনে চলতে হয়, তাকে দেখে ছোটরা শিখবে। বড়দের এই মানিয়ে নেয়ার ফলে দেখা যায় পরিবারের ছোট ভাই/বোনেরা এর সুযোগ নেয়।
কথায় বলে বড় বোন মায়ের সমান। কথাটায় আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। নিজের থেকে খুব বেশি ছোট হলেও ৬/৮ বছরের বেশি ছোট হবার কথা নয়, সেখানে নিজ থেকে ৬/৮ বছরের আরেক মানুষের মা হওয়া বা মায়ের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে নিজের সুন্দর শৈশব বা যৌবন কেড়ে নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখি না, যদি না মা-বাবা মারা গিয়ে থাকেন। আর মা-বাবা না থাকলেও বড় বোনকে বড় বোনের মতোই দেখা উচিত। মায়ের জায়গায় রেখে তাকে বুড়ো বানিয়ে, নিজেরা ন্যাকামি করে যারা বাচ্চা সাজে, আমি তাদের সুবিধাবাদীই মনে করি। এটা বড় বোনের প্রতি কোনভাবেই শ্রদ্ধা হতে পারে না।
অনেক পরিবারে দেখা যায়, ছোটদের জন্য ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসার ফলে বড়দের নিয়ে পরিবারের লোকজন এতোই দুশ্চিন্তায় পড়েন যে, কোন এক জায়গায় বিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচেন। কোনো কোনো পাত্রপক্ষও এর সুযোগ নেয়। দেখা যায় আত্মীয় স্বজন বা বাইরের কেউ যদি এদের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনেন, তবে এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে আসেন যেখানে যৌতুক দেয়া লাগবে অথবা ডিভোর্সি পাত্র, কিংবা বউ মরে গেছেন বাচ্চা আছে, বাচ্চা দেখাশুনার জন্য বিয়ে। যার ফলে অনেক বড় মেয়ে বিয়ের আগ্রহই হারিয়ে ফেলেন, বলেন বিয়ে করবেন না। ছোট বোনের বিয়ে দিয়ে দিতে বলেন। এইসব ছোট বোনেরাও দেখা যায় হয় প্রেম করে বসে আছে, নতুবা বিদেশি পাত্র ঠিক হয়েই আছে, শুধু বড় বোনের বিয়ের অপেক্ষায় তারা।
আমাদের সমাজ বড় বোনকে রেখে, ছোট বোনের আগে বিয়ে দিলে, মানুষ সেই বড় বোনের দোষ খুঁজে বের করে, সেই বড়বোন পড়াশোনায় যতোই ভালো হোন না কেনো, বিয়ের বাজারে তার দাম কমে যায়। অনেকে বলতে পারেন সমাজ অনেক পাল্টেছে এখন এইগুলা আর সমস্যা না। আমি বলবো, আপনি, আমি কেউ যেখানে পাল্টাইনি, সেখানে সমাজ পাল্টালো কীভাবে?
আপনি নিজের ছেলের জন্য, ভাইয়ের জন্য তো সেই মেয়েকে সিলেক্ট করছেন না, যার ছোট বোনের আগে বিয়ে হয়ে গেছে, যদি না আপনার ভাই বা ছেলের কোন সমস্যা থেকে থাকে বা বয়স বেশি হয়ে না যায়।অনেকে বলেন বড় মেয়েটি পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সে আর আগ্রহী না বিয়ে করতে, অথবা তার বয়স হয়ে গেছে বলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আমি কথাটি বিশ্বাস করি না। কারণ সে যা চায় তা সে পাচ্ছে না, আর যখন তার পারার সময় ছিল, সুযোগ ছিল, তখন আপনাদের নিজেদের প্রয়োজনে তার সুন্দর সময় নষ্ট করেছেন, হয় পড়াশোনার বাহানায়, নয় পরিবারের দায়িত্বের কারণে। অথচ যখন ছোটদের সেই সময় এলো তখন টনক নড়ে উঠলো যে, সময় থাকতে ভালো পাত্র হাত ছাড়া করা যাবে না।
এইগুলা বাইরের লোক নয়, পরিবারের মানুষজনই করে, বাইরের লোক চান্সে কথা বলে। ঘরের মানুষ ঠিক থাকলে, বাইরের মানুষ সুযোগ পায় না।একটি পরিবারের সব সদস্যের উচিত সেই পরিবারের দায়িত্ব নেয়া, সবার কথা মাথায় রেখে চিন্তা করা। বড়দের সব দায়িত্ব নিতে হবে, কথাটা ঠিক নয়। সবারই উচিত পরিবারের সবার ভালোর কথা চিন্তা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া। চাইলে ছোট ভাই/বোনেরাও করতে পারে বড়ো বোনদের জন্য, বড়দের ঘাড়ে সব বোঝা চাপিয়ে না দিয়ে। নিজেরা প্রেম করবেন, ফুর্তি করবেন, বিয়ে করে বর/বউ নিয়ে এসে সংসারে হাজির হবেন, পাশের রুমে সেক্স করবেন, খিলখিল করবেন, আর বড়বোন লুকিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চিন্তা করবে পরদিন সকালে সবাইকে কী দিয়ে নাস্তা করাবে, দুপুরে কী রান্না হবে, আর ছোটরা তার চোখের সামনে রোমান্স করে বেড়াবেন, তা হয় না।
প্লিজ ছোট ভাইবোনেরা, চোখে একটু পর্দা রেখে চলতে শিখুন। তোমাদের বড়বোন বিয়ে করেনি মানে এই না, তার বিয়ে বা রোমান্সের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, বরং তোমাদের কথা ভেবে সে নিজের জীবন, সুন্দর সময় দুটোই নষ্ট করেছে মনে রেখো। সে সুন্দরী না, তা নয়। তার চেয়ে অনেক কম সুন্দরীরা বিয়ে করে ভালো আছে, যাদের দায়িত্ববান মা-বাবা আছেন মাথার উপরে। তোমাদের বড়বোন সেই সুযোগ পায়নি, তাই বলে তাকে তোমাদের ছোট করে দেখার কোন কারণ নেই।
নিজেরা পছন্দসই বিয়ে করবে, প্রেম করবে আর তারজন্যে ভেবে রাখবে সবচেয়ে পঁচাটা, তা হয় না। সবাই মিলে যদি আজ পরিবারের দায়িত্বটা নিতে, বাবা মায়ের দেখাশোনার কথা ভাবতে, শুধু একজনের উপর ভরসা না করে, তবে তোমাদের সাথে সাথে, তোমাদের বড়বোনটাও আজ সুখী হতো। শারীরিক চাহিদা, মানসিক চাহিদা সব প্রাণীরই আছে। কেউ যদি তার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে (বিশেষ কোন কারণ ছাড়া) তবে সেটা দুঃখজনক।
নিজের জীবনকে উপভোগ করার অধিকার সকলের আছে। শুধু নিজেরটার কথা চিন্তা করে যারা স্বার্থপরের মতো ভাবে অন্যের জীবনকে বলি দিয়ে, তারা আর যাই হোক পরিবারের ভালো চায় না এটা নিশ্চিত। একটি পরিবারের ভালো থাকতে হলে, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হয়, সবার ভালোর কথা মাথায় রেখে ছোট/ বড় সকলের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, এতে করে বিশেষ কারো উপরই তেমন প্রভাব পড়ে না।
জীবন শুধুই ভোগের জন্যই নয়, প্রিয় মানুষদের জন্য ত্যাগ করার মধ্যেও এক ধরনের প্রাপ্তি আছে। কিন্তু কেউ ত্যাগ করছে মানেই, এটা তার করণীয় মনে করে নিজেরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলার কোনো মানে হয় না। একা একা ভালো থাকা গেলেও, একা একা মন্দ থাকা যায় না, মন্দ রাখার জন্য কাছের মানুষই যথেষ্ট।
কথা হচ্ছে তাহলে করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে, মা-বাবা যাদের বেঁচে আছেন তারা বড় মেয়েরা বোকাসোকা হলে তাদের দিকে বেশি খেয়াল রাখুন, সে যদি দায়িত্বশীল হয়, তবে দায়িত্ব পালনকে তার দুর্বলতা মনে করার কোনো কারণ নেই। পরিবারের অন্য সব ছেলে মেয়েদের বোঝান, পরিবারের প্রতি সব সদস্যদের সমান দায়িত্ব আছে। একজন পারে বা করে বলেই তার ঘাড়ে সকলের চড়ে বসার কোনো মানে হয় না। দায়িত্ব সবাইকে ভাগ করে দেন, যাতে একজনের অবর্তমানে অন্যজন সামলে নিতে পারে।
আমার বড় মেয়েটা বোকাসোকা, সহজ সরল, পরিবারের সবারটা বুঝে, এইসব পামপট্টির কথাবার্তা বাদ দেন। ভালোবাসার খাঁচায় তাকে বন্দী না করে, ভালোবাসার আকাশে তাকে উড়তে দিন স্বাধীনমতো। ছোট মেয়েটা বেশি স্মার্ট, ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসে, বুঝে না কিছু, ছেলে মানুষ, এই জাতীয় কথাবার্তা বলাও পরিহার করুন।যা ভালো, তা সব সময়ই ভালো, যা কম ভালো মনে করেন, সেখানে সময় দিন। বড়বোনদের সামনে ছোটদের প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকুন, এতে করে আপনার বোকাসোকা বড় মেয়ের নিজের আত্মবিশ্বাস যেমন কমবে, কষ্টও লাগবে মনে। সে হাসিমুখে থাকে বলে তাকে বোকা মনে করার কোন কারণ নেই। মেয়ে সন্তানদের বিয়ের সময়ও তাদের জানিয়ে দেন, বাবার বাড়ি সব সময় তাদের জন্য খোলা আছে। যেকোনো বিপদে, যেকোনো পরিস্থিতিতে, প্রয়োজনে সারা পরিবার তাদের পাশে আছে।
নিজের সন্তানদের শেখান যে, বাইরের লোকের সঙ্গে পরিবারের পার্থক্য এখানেই। যেখানে সবাই নানা কথা বলবে, সেখানে পরিবার ঢাল হয়ে বুক পেতে দাঁড়াবে। বদনাম করার জন্য, বিপদে ফেলার জন্য, বিপদ দেখে সরে দাঁড়াবার জন্য, বাইরে থেকে মজা নেয়ার জন্য, গালি দেয়ার জন্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব তো আছেই। শত্রুতা বাইরের কেউ করে না, যার সঙ্গে উঠাবসা চলে সেইসব কাছের মানুষরাই শত্রুতা করে।
ভরসার একমাত্র জায়গা হচ্ছে পরিবার। সেই পরিবারে কেউ কাউকে ছোট বড় করে দেখা ঠিক না। বোঝে না বলে কিছু নেই, যদি না কেউ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। সবাইকে বুঝিয়ে দিন। যে বুঝতে চায় না, তার সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দিন, বুঝবে ঠিকই। পরিবারের সব সন্তানকে সমান ভালোবাসুন। শুধু মনে মনে সমান ভালোবাসা পুষে রাখলেই হবে না, ভালোবাসা প্রকাশের বিষয়। পরিবারের লোকজনের কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করুন, ভালো যেকোনো কাজে সহযোগিতা করুন।
আগেই বলবেন না, যে তুমি এটা করতে পারবে না যদি সে দুর্বলও হয়ে থাকে সেই বিষয়ে। পরিবারই হচ্ছে মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা, বিশ্বাসের জায়গা, নিখাদ ভালোবাসা পাবার জায়গা; সেটা নষ্ট করে দিয়েন না। পাশে থাকুন নিজের পরিবারের, ভুল করলেও শুধরে দিন, দোষারোপ না করে। আমরা যদি পরিবারকে শান্তির জায়গা রূপে তৈরি করতে পারি, আমাদের সন্তানেরা যদি পরিবারে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে, পরিবার থেকে সুশিক্ষা পায়, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হয়, তারাই আমাদের আগামীতে সুন্দর সমাজ দিবে।
যে সন্তানকে পরিবার শেখাবে, নিজের মাকে, বোনকে সম্মান করতে, সেই ছেলের দ্বারা অন্য কোন নারী অসম্মানের শিকার হবে না। যে পরিবারের মেয়ে তার নিজের মাকে, বড় বোন, ছোট বোনের কথা মাথায় রেখে চলবে, তাদের সম্মান করবে, সেই মেয়েই শ্বশুর বাড়ি গিয়ে নিজের শাশুড়ি, ননাস, ননদ’কে ভালোবাসবে, সম্মান করবে।
আবার সেই একই কথা বলবো, পরিবারে কেউ কারো কর্তা বা বস নয়, সবাই সবার বন্ধু হোন, সবাই সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। নিজের সুবিধার জন্য অন্যের জীবনকে ব্যবহার করতে যাবেন না। সব সময় খেয়াল রাখুন নিজের পরিবারের মানুষের প্রতি। শুভ কামনা রইল সকলের প্রতি।
কিছুদিন আগে ‘পরিবারের দায়িত্বশীল ছেলে’ শিরোনামে একটি লিখা দিয়েছিলাম পরিবারের বড় ছেলেকে নিয়ে; তখন অনেকেই বড় মেয়েদের নিয়ে লিখতে বলেছিলেন। এইবার বলবো, যারা মনে করেন এই বিষয়, ওই বিষয় নিয়ে লেখার দরকার আছে, তারা নিজেরা লিখুন অন্যের উপর ভরসা না করে। ভালো থাকুন।
পরিবারের বড় মেয়ে
শেয়ার করুন: