শাড়ি

টনি মাইকেল:

আমরা যারা বাঙ্গালী তাদের ছেলেবেলা থেকেই সবচেয়ে কাছের পোশাক শাড়ি। কারণ এটা আমার মায়ের পোশাক। এটা আপামর মায়ের একমাত্র পোশাক। আমাদের শিশুকাল কাটে শাড়ি ভিজিয়ে – এরপর কৈশোর থেকে খাবার পরে মুখ তো আমরা ন্যাপকিন দিয়ে মুছিনি কখনো। মা’র শাড়ির আঁচলই আমাদের ন্যাপকিন – চোখে ব্যথা পেলে ঐ শাড়ির আঁচল গোল্লা পাকিয়ে গরম ভাঁপ মুখে দিয়ে চোখে চেপে দিলেই কোথায় চলে যেতো ব্যথা! মাধ্যমিক পেরুলে গরমে স্কুল থেকে ফিরে মায়ের শাড়ির আঁচলেই মুছেছি সারামুখের লেগে থাকা লবণ মেশানো ঘাম।

শাড়ি তাই আমার কাছে পোশাক নয় – পোশাকী নয়। শাড়ি মানে সুন্দর – সে যেই পড়ুক। আমাদের বাঙ্গালী মেয়েদের বড় হওয়ার একটা বড় ইন্ডিকেটর শাড়ি । প্রথম যেদিন বড়বোন শাড়ি পরে, তখন থেকেই সে সত্যিকারের বড়দি হয়ে ওঠে। তার আগে সে শুধুই বোন যে আমার চেয়ে একটু বেশি বুঝে। আর এমন করেই শাড়ি কেমন করে যেন বাঙ্গালী নারীর ব্যক্তিত্বটাকে পাল্টে দেয় ।

কলেজের নবীনবরণে যে মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পরে আসলো সেই মেয়েটাই পরের বছর পহেলা বৈশাখে শাড়ি পড়ে কলেজে আসলে – ধুক্ করে ওঠে বুকের ভেতর ! আরে এই মেয়েটা কি সেই মেয়েটা !
প্রেমে পড়ে গেলে যেদিন প্রথম কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া সেদিন সব ছেলেদের দাবি একটাই – পারলে শাড়ি পরে এসো প্লিজ। ব্যস হয়ে গেলো ।

এভাবেই শাড়ির ভেতরের মানুষটা হয়ে ওঠে নিজের মানুষ। পুরুষ রোজগার করে – ঘাম ঝরায় মাঠে ঘাটে প্রান্তরে আর তার ভালোবাসার মানুষের জন্যে মেলা থেকে – হাটে কিংবা গঞ্জের বাজারে গিয়ে যেটা হুট করে কিনে ফেলে – সেটা আর কিছু নয় – শাড়ি – হয়তো সাথে চুড়ি । বড়ি ফিরে তুলে দেয় সেটা ভালোবাসার মানুষের কাছে । সে যেই হোক – কন্যা – জায়া – অথবা জননী ।
আমাদের বাংলা সিনেমার নায়কেরা পরিক্ষায় পাশ করে মা’র জন্যে শাড়ি নিয়ে আসে। বলে মা মা আমি পরিক্ষায় পাস করেছি! প্রথম চাকরী পেয়ে ছোট বোনটার জন্যে যে প্যাকেট নিয়ে আসে তা আর কিছু নয় – একটা সুতির শাড়ি।

বাংলায় শাড়ির বাহারের মতো এতো রং – এতো পদ – এতো পদ্ধতি আর এতো নাম বোধকরি পৃথিবীর আর কোন পোশাকের নেই। শাড়ির যেমন প্রকার ভেদ তেমনি তার পড়ার ঢং। নানাভাবে একে পরার যে কৌশল, সেটাই তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে।

কুঠি বাড়ির নারীরা যেভাবে লম্বা হাতার ব্লাউজে শাড়ি পরেছেন তার এক সৌন্দর্য, যেটা রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। আবার জসিমুদ্দিনের গ্রামের মায়ের আর মেয়ের শাড়ি পরায় রয়েছে মাতৃত্ব বাংলার প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার বর্ণনা।
কালের আবর্তে ব্লাউজ তার আকার – রূপ – ধরন এবং উদারতায় বদলেছে –কিন্তু যেটা বদলায়নি সেটা শাড়ি। আর তাই আমি পৃথিবীর সকল পোষাকের পরিবর্ধন পরিমার্জন অনুমোদন করি – শুধু শাড়ির কোন বিকল্প আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যেখানে বাঙ্গালী নারী তার পূর্ণতা খুজেঁ পায়, সেখানে সে পরিপূর্ণা হয়ে ওঠে, সেখানে কোন ভাবাদর্শ মতাদর্শ কিংবা ধর্ম আমার কাছে গৌণ।

নারীকে বর্ণনা করতে গিয়ে কবি সাহিত্যিকেরা তার চেহার পাশাপাশি যেটা বর্ণনা করেছেন সেটা তার শাড়ির। কেমন লাগছে তাকে সেই শাড়িতে – আর সেই কেমন লাগা পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছে সেই চরিত্রটিকে। হুমায়ূন আহমেদ লিখতেন – রাণুর আজ মন খারাপ। তাই সে শাড়ি পরেছে। মা’র আলমারী থেকে আগেই সরিয়ে রেখেছিলো। মাড় ভাঙ্গা শাড়ি। হালকা নীল রং। হালকা নীল রঙ্গে রানুকে মায়াবতী লাগে। মিসির আলী দেখলেন মেয়েটি মায়াবতী – বড়ই মায়াবতী। ব্যস্ হয়ে গেলো। আপনি চোখের সামনে আস্ত রানুকে দেখতে শুরু করলেন !
এভাবেই এপার বাংলার হিমুর রূপা থেকে ওপারের শুভংকরের নন্দিনীরা সবাই শাড়ি পরতো। সাহিত্যে কবিতায় শাড়ি তাই নারীর প্রতিকৃতি – নারীর প্রতিনিধিত্ব করেছে।

আবহমান বাংলার রীতিতে শাড়ির রং রূপের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে নারীর অবস্থান। যেমন সামাজিক কৃষ্টি আর আচার অনুষ্ঠানে শাড়ির ব্যবহার নির্দিষ্ট করেছে নারীর ব্যক্তি পরিচয়। যেমন বিয়ের আসরে বেনারসি শাড়ি নারীকে করেছে বধু।

সেই বধু এক সময় শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দেখেছে শাশুড়ির আঁচলে বাঁধা সংসারের স্বাধীনতা আর ক্ষমতায়নের প্রতিকৃতি সংসারের চাবি, কালের আবর্তে বাড়ির বউ এর কাছে এসেছে সেই সংসারের চাবি। ওজন শাড়ির আঁচলে ওঠার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে পরিবারে তার অবস্থান, ক্ষমতায়ন, দায়িত্ববোধ।

সংসার সামলানোর এই পথচলায় পুরুষের সাথে চলতে চলতে কখনো ক্লান্ত হয়নি নারী। আর সেই পুরুষ যদি বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায় ওপারে – নারীর শাড়ির রং যায় বদলে। সাদা শাড়ি তখন হয়ে যায় নারীর একমাত্র বসন। এ যেন নারীর জীবনের সব রং পুরুষের সাথে কবরে চলে যাওয়া। বেঁচে থাকে নারী – না বেঁচে থাকা নিয়ে।

সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যেমন সতীদাহ প্রথা উঠে গেছে যেমন – তেমনি বিধবার পরনের শাড়িতে লেগেছে উৎসবের রঙ। আমরা আমাদের মায়েদের প্রতি উদার হয়েছি। স্বামী গেলেও সন্তানদের ভালোবাসার রঙে বিধবার সাদা শাড়ি এখন শুধুই অতীত মাত্র।

কিন্তু মনের ভেতরের আবহমান যে পুরুষতান্ত্রিক চোখ সে চোখ এতো আলো সইতে পারছে না। আর তাই শাড়ি আজ কয় হাত লম্বা, কতটুকু খোলামেলা, আর কতটুকু উত্তেজক, সেই নিয়ে আমাদের গবেষণা। বারো হাত শাড়িতে আজ তাই নারীর শরীর ঢেকে রাখা কঠিন পুরুষের চোখ থেকে।

টনি মাইকেল

চিন্তিত মানুষেরা আজ তাই গবেষণা করতে বসেছেন অধর্মের আর অপকর্মের ব্যাখ্যায় শাড়ির অবস্থান কতটুকু। এ যেন শাড়ি নিয়ে না নারী নিয়েই গবেষণা। শাড়ির পেছনের মানুষটিকে সম্মান দেয়া আর না দেয়ার উছিলা খোঁজা মাত্র।

কিন্তু সাধারণ মানুষ এতোকিছুর ধার ধারে না তারা পহেলা বৈশাখে ফাল্গুনে নারীকে শাড়ি পরায়। দেখতে চায় বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদের হলুদ শাড়ি, তাই আয়োজনকে উৎসবে পরিণত করে। নারী বারবার প্রকাশিত হয় তার আপন মহিমায়।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলায় তাই এখনও পুরুষ শাড়ি বিক্রি করে। যে লোকটি শাড়ির দোকানে বসে থাকে তার মতো আদর্শ পুরুষ আর কে হতে পারে। যে পুরুষ তার সকল কাজ ফেলে তার প্রিয় মানুষকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যায়, তার মতো সুন্দর পুরুষ আর কে হতে পারে?

যে শাড়ি কিনতে পুরুষের লাগবে ১০ মিনিট সেই একই শাড়ি কিনতে নারী হয়তো গোটা দশটা দোকান ঘুরে ফেলবে – আর এতে ক্লান্তি নেই যে পুরুষের সেই তো প্রকৃত পুরুষ। যে পুরুষটি এই ধৈর্য আর ভালোবাসা নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরতে পারে সেইতো নারীর সঙ্গে পথ চলতে পারে।

যে পুরুষ শাড়ির দোকানে বসে সকাল থেকে রাত অবধি – দিদি, বৌদি, খালাম্মা, আন্টি, ভাবি আর চাচির কাছে হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে শাড়ি বিক্রি করে, সে পুরুষ কি নারী নির্যাতন করতে পারে?
যে মানুষটি খোলাবাজারে শাড়ির দোকানে নিজের গায়ে শাড়ি জড়িয়ে পরতে পারে, সে পুরুষ কি হ্যাঁচকা টানে কোনো নারীকে করতে পারে বিবস্ত্র? কই আমি তো শুনিনি কখনো কোন ধর্ষক শাড়ির দোকানে শাড়ি বিক্রি করেছে?

নারীর পরনের বস্ত্র শাড়ি – যেমন পুরুষের শিল্প কারুকার্জে অনিন্দ্য হয়ে ওঠে – তেমন নারীর সম্মান – সম্ভ্রম – আত্মমর্যাদা এর কোনটিই নারী একার নয়। আর এটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও নারীর একলার নয়। যে নারী কন্যা – জায়া – জননী সে তা হয়ে ওঠে তখনই যখন পুরুষ হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের পুত্র – স্বামী কিংবা পিতা।

আর তাই যতদিন পুরুষ শুধুই একজন পুরুষ – যতদিন এই রাষ্ট্র, এই দেশ একটি পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র যতদিন শাড়িতে নয় বোরখায় আমাদের মা মেয়েদের সম্ভ্রম নিশ্চিত করতে হবে ঠিক ততদিন, দেশের প্রতিটি ধর্ষণের শিকার বোনের শাড়িই হবে আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

[আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ স্যারকে কৃতজ্ঞতা – কেননা উনি না লিখলে – আমার শাড়ি নিয়ে লেখা হতো না।
আমি অপেক্ষায় ছিলাম স্যারের লেখার পরে আরো কেউ শাড়ি নিয়ে লিখবে অন্য একটা লেখা – কেউ লেখেননি । কোন পুরুষবাদী কিংবা নারীবাদী সময় পাননি দু লাইন লেখার।
আজ বিশ্ব নারী দিবসকে উপলক্ষ্য করে তাই আমি লিখলাম।
সকল নারীকে বিশ্ব নারী দিবসের শুভেচ্ছা ]

লেখক: টনি মাইকেল, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় ডিরেক্টর টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম হিসেবে কর্মরত, [email protected]

শেয়ার করুন: