নারীর প্রতিবাদই নারীর সমতার দাবি

সালমা লুনা:

১.
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বা শ্লোগান হচ্ছে #EachForEqual বা সবার জন্য সমতা।
এই সমতা নারী পুরুষে। মানুষে মানুষে হবার কথা। অথচ বাস্তবে তা নেই, কিংবা হয়না বলেই এমন বিষয় বেছে নেয়া হয়েছে প্রচারণার জন্য।

শারীরিক অবয়বের পার্থক্যটুকু ছাড়া পুরুষের সাথে নারীর তেমন কোন পার্থক্য নেই। অথচ ওইটুকু কারণেই নারীকে পড়তে হয় বিশাল পার্থক্যের পাহাড়সম বাধার সামনে।
এই বাধা কি সত্যিই শুধু শরীরের সক্ষমতার কমতি?
নাকি এই বাধা গতানুগতিক পুরুষবাদী চিন্তা আর সংস্কারের আরোপিত? হাজার বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা যে বাধার পাহাড় ডিঙিয়েও সমতার সূচকে নারী আজোবধি বরাবরের হিস্যা বা ন্যায্য পাওনা বুঝে পায়নি।

আজও এই ২০২০ সালে এসেও নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে নারী পুরুষ নির্বিশেষে ৯০ ভাগ মানুষ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ৯০ জন মানুষই নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পুষে রাখেন।
না, একথা আমি বলছি না।
এটি সদ্যই প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি সূচক বলছে।
নারী দিবসের প্রাক্কালে গত ৫ই মার্চ জাতিসংঘের ‘জেন্ডার সোশ্যাল নর্ম’ সূচকের বরাত দিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
সূচক অনুসারে চাকরিতে নারীদের চেয়ে পুরুষের অধিকার বেশি বলে মনে করেন বিশ্বের ৫০ শতাংশ পুরুষ। আবার ৪০ ভাগ মানুষ মনে করেন, নারীর চেয়ে পুরুষরা ভালো ব্যবসায়িক নির্বাহী হতে পারেন।পুরুষ তার নারী সঙ্গীকে আঘাত করতে পারবে, এমন মনে করেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের এই সূচকে এমন একটা তথ্য উঠে এসেছে যে পৃথিবীর কোনও দেশেই লিঙ্গসমতা নেই ।

সালমা লুনা

পৃথিবীর কোথাওই কোন ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের সমতা নেই। এর এই ‘নেই’- টিই সর্বত্র বড় কুশ্রী রূপে বিরাজমান। রাষ্ট্রক্ষমতার চেয়ার থেকে শুরু করে বিছানা পর্যন্ত বড় নির্লজ্জের মতো হাঁ করা দাঁত বের করে আছে এই ‘নেই’।

‘নেই’ টি নেই কেন এই দাবি সবসময় নারীরাই জানিয়ে আসছে, তাও না। খুব অল্পসংখ্যক পুরুষও এই দাবি জানান, কিন্তু তারপরও কোনভাবেই বলা যাবে না এই অচলায়তন ভেঙেছে কোথাও।

এই অচলায়তন কেন ভাঙছে না এর জন্য উপরের জরিপের ৯০ ভাগ মানুষের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। অর্থাৎ লিঙ্গধারী পুরুষ ছাড়াও নারীরূপী পুরুষতন্ত্রও সমানভাবে দায়ী।

২.
নারীর সমতা বা নারী স্বাধীনতার বিষয়ে কোন কিছু লিখতে গেলে আজকাল অনেকেই টাইটেল দিয়ে নেন ‘আমি নারীবাদী নই’। অনেকটা সিএনজি বা টেম্পুর পিছনের ওই লেখাটার মতো, ‘আমি ছোট আমাকে মারবেন না’।
কেন বলেন তো?
কারণ নারীবাদীকে ক্ষমতার প্রচণ্ডতায় পিষে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলার এক চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক অভিপ্রায়ে নারী পুরুষ সকলেই আক্রমণ করে থাকেন নারীবাদী মানুষকে ।

নারীবাদী নারী মানেই সে যেন অনেকটা অচ্ছ্যুত বা সমাজ বহির্ভুত নারী হিসেবে প্রতীয়মান হয় সমাজে। নারীবাদী মানেই হচ্ছে, দে শালীরে একটা ঠোক্কর ! এ হলো গণিমতের মাল ! নারীবাদী মানেই গায়ে তার গণিকালয়ের গন্ধ। নারীবাদী মানে শুধুই নোংরামি। তার গায়ে পোশাক থাকলেও সে ন্যাংটো। তার দাঁত বড়, তার হাসি হিংস্র। তার চেহারা হিজরার মতো। ‘বারভাতারি’ ‘ঢলানি মাতারি’ ন্যাড়ি সে।
আর পুরুষের গায়ে নারীবাদীতার ট্যাগ লাগলে সে ভেড়াটাইপ পুরুষত্বহীন মেনক ।

নারীবাদী মানে যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে পারে না। যে নারী সিগারেট খায়, যেকোনো পুরুষের বিছানায় যেতে উদগ্রীব, ঘর ভাঙতে এবং পরকীয়ায় উৎসাহী নারীরাই নাকি নারীবাদী। ধর্মকেও নাকি পায়ের নিচে পিষে ফেলে নারীবাদ।
একেবারে প্রেতিনি বা ডাইনির চরিত্র যেন এই নারীবাদীরা !

নারী কি তবে পিছিয়ে যাবে?
না।

তাই তো আমরা দেখি, শিক্ষক ক্লাশ সিক্স পড়ুয়া ছাত্রীর পিঠে অনাবশ্যক হাত ঘুরাতে থাকলে ছাত্রীটি যখন প্রতিবাদে চেঁচিয়ে উঠে, হাত সরান স্যার!
তখন জন্ম নেয় নারীবাদ।

রাস্তায় চলতে চলতে টুপি পাঞ্জাবী পরা মেহেদি রঞ্জিত দাড়ির বুড়ো মানুষটার কনুই যখন আপনার শ্যেন দৃষ্টির সামনেই আপনার কিশোরী কন্যার বুকের পাশে গুঁতো দিতে উদ্যত হয় এবং ছুটে গিয়ে আপনি ‘বুড়ো- অসহায়- ভোলাভালা ‘ নরপিশাচটির গায়ে জোর ধাক্কা লাগান ।
তখন জেগে উঠে নারীবাদ।

ঘরের গৃহিনী সারাদিন কাজ করতে করতে মেজাজ হারিয়ে ফেলে স্বামীকে তার গৃহস্থালী কাজে একটু সাহায্য করতে বললে স্বামী ‘বেচারা’ যখন বলে উঠেন, এই কাজ স্বামীর নয়, স্ত্রীরই, চিরকাল নারীরাই করে এসেছে এইসব।

গৃহকর্ত্রীর গলায় তখন সবেগে কথা বলে উঠে যে ভাষা, তাই নারীবাদ।

একই যোগ্যতা নিয়ে চাকুরিতে ঢুকে নিজ মেধার জোরে পদলাভ করতে গিয়েও যখন নারী তার কাঙ্খিত জায়গাটি পায় না শুধুই নারী বলে এবং সেখানে তার চেয়ে কম যোগ্যতার একটি পুরুষকে দেখে শুধুই পুরুষ বলে, তখনই সে প্রতিবাদী হয়ে উঠে।
এই প্রতিবাদই তো নারীবাদ।

দিনের পর দিন ভোলাভালা পুরুষ যখন রোজগার করে না, স্ত্রীসন্তানকে খাওয়াতে পারে না। নিরুপায় স্ত্রী তখন অন্ন জোগাড় করতে পেটের দায়ে সুদূর নেত্রকোনা থেকে ঝিগিরি করতে আজন্ম অদেখা রাজধানীতে পা রাখে সাহস করে।
অথচ স্বামীত্বের অধিকারে সেই ভোলাভালা পুরুষটিই ফোন করে স্ত্রীকে শাসন করে, “ঢাহা শহরো শইল ঢাইক্কা চলবি”।
তখন ভীতু গ্রামীণ নারীটি যে সাহসে বলে উঠে, ‘আমি অত দূরাফি ক্যামনে চলি হেইডাও অহন আফনে কইয়া দিবাইন!’
সেই প্রতিবাদই তার নারীবাদ!

বুকের উড়নার চিপাচাপা দিয়ে পুরুষের ‘নিষ্পাপ’ দৃষ্টির ঝাঁঝ সইতে না পেরে ‘বখাটে’ কিশোরী আর তরুণী বিরক্ত হয়ে উড়না ছুঁড়ে প্রতিবাদী কণ্ঠে যখন বলে উঠে, এই নেহ্, কত দেখবি দ্যাখ!
তখন, ঠিক তখনই নারীপুরুষ একযোগে গালি দিয়ে বলে উঠে – এই শালী তো দেখি একটা আস্তা নারীবাদী!
ঠিক এভাবেই আসলে নারীবাদ ছড়িয়ে পড়ে আপনি চাইলেও, না চাইলেও।

অথচ ওই প্রতিবাদী মানুষগুলো নারীবাদকে হয়তো চেনেই না, জানেই না ভালো করে। তারা শুধু তার বিরুদ্ধে ঘটা অন্যায়টির প্রতিবাদ করতে জেনেছে। নিজের অধিকারকে চিনে নিতে চেয়েছে। আর এইটুকু করতে গিয়েই তারা জেনেছে, প্রতিবাদ করলে কারো প্রিয় হওয়া যায় না। প্রতিবাদী মানুষ সবসময় সকলের চক্ষুশূল। সত্যিটা মুখের উপর বলে দিলে কেউ খুশি হয় না। বরং লুকিয়ে রাখলে অনেকেই খুশি হয়। নারীর যা ভালো লাগছে না উচ্চকণ্ঠে জানালে সে নারীবাদী হয়। আর প্রতিবাদ না করলেই আদরের নারী হওয়া যায়।

তথাপি নারী চক্ষুশূল হয়েও, প্রিয় না হয়েও প্রতিবাদী হতে চায়। কাউকে খুশি করে সুখী হবার পাশাপাশি নিজেও সুখী হতে চায়। অন্যের ইচ্ছার ঘুড়ি হয়ে আদরের নারী হবার চেয়ে নিজের ইচ্ছেটাকে মুখ ফুটে পরিষ্কার ভাষায় জানাতে চায়। লাজভয়ে নিজেকে লুকিয়ে না রেখে নিজের সকল অর্জনের উদযাপন করতে চায় মাথা উঁচু করে।

হ্যাঁ, এই প্রতিবাদই আসলে নারীর সমতার দাবি।
যে সমতার সামনে দৃশ্যমান বাধার মতো অদৃশ্য পাহাড়প্রমাণ বাধাও ডিঙ্গাতে চায় তার প্রতিবাদের সক্ষমতার শক্তিতে।
এবং সেই সক্ষমতার শক্তিতেই নারী একা নয়, পুরুষের সাথে মিলেমিশে বৈশ্বিক লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করতে চায়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.