শশশশ্…

লাবণ্য সায়মা রহমান:

পর্ব ১

আস্তে আস্তে শিখার মেরুন ব্লাউজের হুকগুলো খুলে নিতে থাকে, আর তারপর ডান হাত আর বা হাতে ঈষৎ ঝুলে থাকে শিখার কাঁধ। ভেজা চুম্বনে ব্যস্ত দু জোড়া ঠোঁট উমমমম উমমম উমম শব্দ ছাড়া আর কোনো ভাষা খুঁজে পায় না যেন তখন। আধো বাঁকা অবস্থাতেই দীপ শিখা এগিয়ে যেতে থাকে বিছানার দিকে। দীপের বেড রুমটা জুড়েই মৃদু আলোর ল্যাম্পগুলো কোনায় কোনায় সাজিয়ে রাখা, এতো বাতি তবু কেমন আলো আঁধারির খেলা সে ঘরে। নেশা ধরায় সে মদির আলো, তীব্র নেশা গভীর আলিঙ্গনের, যৌন মিলনের।

আলতো করে শিখাকে নরম বালিশে শুইয়ে দিলে ডুবে যায় মেয়েটা। কেমন লজ্জা আর ভয় ঘিরে ধরতে থাকে ওকে, আবার অন্যদিকে মিলনের তীব্র ইচ্ছেটাও লেলিহান হয়ে উঠতে থাকে। দীপ তৎপর হয়ে খুলে নিতে থাকে শিখার পোশাকগুলো একে একে। নিজেকে নগ্ন দেখতেই দুহাতে মুখ ঢাকে শিখা। দুপা দ এর মতো ভাঁজ করে যোনিপথটা আড়াল করতে চায়। তখনই দীপের কণ্ঠ ফিসফিস করে বলে ওঠে, আই লাভ ইউ বেইবি। ব্যস্ গলে যেতে থাকে মেয়ে, সাড়া দিয়ে ওঠে ওর শরীর। দীপের এই একটি বাক্য শিখার সবকিছু তছনছ করে দেয়, হৃদয়ের গভীরে মেয়েটার যে তুমুল চাওয়া ভালোবাসার, যে কাঙ্গালপনা সেটা দীপ খুব জানে। জানে বলেই ঘায়েল করে দেয় মেয়েটাকে এই এক বাক্যে। মেতে ওঠে দুটি শরীর আদিম উল্লাসে।

পর্ব ২

রতিক্রিয়া শেষে যেটুকু মিষ্টি ক্লান্তি আসে তা গায়ে জড়িয়ে সবুজ শাড়িটা শরীরে শুধু বিছিয়ে রেখে মায়াভরা চোখে দীপকে দেখতে থাকে শিখা। ততক্ষণে দীপের ঠোঁটে লেপ্টে গেছে লাল মোড়ক থেকে বের করা প্রিমিয়াম ডানহিল, গোলাটে ধোঁয়া ফুউ ফুউ করে উড়িয়ে দিতে থাকে মুখ থেকে, তবে দীপের দৃষ্টিটা যেন অন্যদিকে। এই ধোঁয়াটে ক্ষণে আরও আপন মনে হতে থাকে তাকে শিখার কাছে। চট্ করে সিডি প্লেয়ারের রিমোটটা হাতে নিয়ে বাজায় রবিশংকরের বাদন রাগ ভীমপলশ্রী। জানে রবিশংকর শিখার ভীষণ পছন্দ এবং সেতারের মূর্চ্ছনায় মেয়েটা হারিয়ে যায়। গান ভালো বোঝে দীপ, কারণ তার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেয়া আছে, তবে ইচ্ছে করেই গায় না আর।

ফাগুনের দমকা বাতাসের মতো আচম্বিতে মেতে ওঠে ওরা আঠালো চুম্বনের খেলায় আবার। কাটতে চায় না যেন এ নেশার ঘোর। আদরে আদরে নিবিড় আলিঙ্গনে সময়ের কাঁটা কতোবার ঘুরে যেতে থাকে সে খেয়াল ওরা করেই না … দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার মিলনের খেলা শেষে সম্বিৎ ফিরে পায় শিখা। রাত তখন সাড়ে দশটা বাজে, রাতের খাবার খাওয়া হয়নি ওদের। এদিকে বাড়ি ফেরার তাড়া আছে শিখার, নইলে ওর মা চিন্তা করবেন। দ্রুত মোবাইল অন করে নিয়ে মাকে ম্যাসেজ পাঠায়। ঝটপট শাড়িটা পরে নেয়। কিন্তু তার সুইস টিসো হাতঘড়িটা আর এসপিরিটের প্ল্যানবুকটা ভ্যানিটিতে তুলতে ভুলে যায় শিখা। দুটোই তার খুব প্রিয়, দীপের দেয়া উপহার রোজ ব্যবহার করে সে। ডাকা হয়ে গেছে উবার ট্যাক্সি। শিখা বের হবার আগে দুহাতে আঁকড়ে ধরে দীপের কপালে, দুচোখে চুমু খায় পরম মমতায়। কিন্তু দীপের জ্বলজ্বলে বাদামী চোখের দৃষ্টিটা শেয়ালের মতো চতুর দেখায়, টের পায় না শিখা।

পর্ব ৩

আজ খুব ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় শিখার। গতরাতের ভালোবাসাবাসির রেশটা যেনো লেগে আছে শরীরে ও মনে। ইস্কাটনে ওদের এপার্টমেন্টটা এগারো তলায়, ওই উচ্চতা থেকে আধা জাগা আধো ঘুমের ঢাকা শহরটাকে দ্যাখে শিখা জানালায় দাঁড়িয়ে গায়ে হাল্কা চাদর জড়িয়ে নিয়ে। চাদরের ওমে দীপকে খুঁজে পায় যেনো। দীপের কথা ভাবতেই চোখ ভরে ওঠে জলে। এই মানুষটাকে এতোটা, এতোটাই কী করে ভালোবেসে ফেললো সে? তার জীবন দীপ ছাড়া অন্ধকারময় এটা জেনে গেছে শিখা। অফিস যেতে হবে তাই প্রাতরাশের আগেই স্নান করতে ঢুকে যায় শিখা। শাওয়ারের নিচে জলের ছোঁয়া নিতে নিতে লক্ষ্য করে স্তনে এবং গলায়, কাঁধে দীপের ভালোবাসার চিহ্ন লাভ বাইটগুলো, খানিকটা লালচে বাদামী রংয়ের চিহ্নে ভরে আছে শরীরের ওই অংশগুলো। মায়া হয় শিখার, দারুণ মায়ায় হাত বোলায় ওই চিহ্নগুলোতে আর ঝরঝর করে ঝরে পড়ে শাওয়ারের জলের সঙ্গে ওর চোখের নোনা অশ্রু। নিজেকেই নিজে শোনায় ফিসফিস করে, দীপ, আই লাভ ইউ মোর।

পোশাক পরে রোজকার মতো ভ্যানিটি ব্যাগটি গোছাতে গিয়ে হাত ঘড়িটা আর প্ল্যানবুকটা খুঁজে পায় না, মনে পড়ে যায় ওটা ফেলে এসেছে দীপের বেডসাইড টেবিলের ওপর। সারাদিন এ দুটো জিনিস ছাড়া ওর চলেই না। তাই মনে হলো অফিস যাবার পথে ওগুলো তুলে নিয়ে যাবে, আর এই সকালে একবার প্রিয় মানুষটার মুখ দেখা হবে। শিখার মায়ের আজ কাজে ছুটি, তাই সে গাড়ি পায়, ড্রাইভারকে নিয়ে একগুচ্ছ বেলী ফুলের মালা কিনে নিয়ে দীপের বাড়ির দিকে রওনা হয়। এই এক বছরের সম্পর্কে কখনোই ভোরবেলায় ওদের কথা হয়নি, দীপের সকালের ঘুম খুব প্রিয় তাই সে দেরি করে ওঠে, শিখা জানে যে মোবাইল অফ থাকবে, তাই আর কোনো মেসেজও পাঠায় না। কেমন একটা অধিকার নিয়ে সে চলে যায়, হোক না একদিন এক সকালের ঘুম ভাঙ্গাবে। এই মানুষটা যে তার ভালোবাসার, তার আপনার চাইতেও আপন। দীপের বাড়িতে পৌঁছে কলিং বেলে চাপ দেবে এমন সময় দরজার ওপার থেকে সেই রবিশংকরের সেতারের ঝংকার ভেসে আসে। কী ভালো যে লাগে শিখার, আহা প্রিয় মানুষটা তার পছন্দের বাজনা শুনছে এই সকালেও। কিন্তু আরেকটা কীসের শব্দ শুনে হাত পা শক্ত হয়ে যায় শিখার। সেতারের শব্দ ছাপিয়ে শিখা শুনতে পায় একটা নারী কন্ঠ যেনো বলছে, আহ্ আহ্ আহ্ ও গস্ বেইবি ইয়েস ইয়েস ইয়েস!

পর্ব ৪

নিজ শ্রবণশক্তিকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না শিখা, এটা হতে পারে না। ভুল শুনেছে সে, তার আপন মানুষটা এমন করতে পারে না। নির্ঘাত হ্যালুসিনেশন হয়েছে তার। এসব নানা কিছু ভাবতে ভাবতে কতবার কলিংবেল চাপতে থাকে বুঝতেই পারে না। মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে এই সাত সকালে কোন আপদ বলতে বলতে দরোজাটা খোলে দীপ, ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে, বলে, শিখা, তুমি এই সকালে? কী কারণ? কোনো সমস্যা হয়েছে? মনে ওলট পালট হতে থাকে, তবু শিখা শীতল কন্ঠে বলে, তার প্ল্যানবুক আর ঘড়িটা গতরাতে ফেলে গেছে। ভেতরে ঢুকতেই একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে শিখার শরীর, এ কাকে দেখছে সে? আলু থালু বেশে দীপের হলরুমের ডিভানে পা তুলে সিগারেট টানছে যে নারী, সে কেন এখানে? বিশিষ্ট ধনকুবের ও প্রতাপশালী ফ্যাশন ডিজাইনার জেরিন মাসউদ। শিখা এবার বুঝে ওঠে তার কান ভুল শোনেনি, বেলিফুলের মালাগুলো কখন হাত থেকে খসে পড়ে যায় মাটিতে, এক ঝটকায় বেরিয়ে আসে সে।

লজ্জা ঘৃণা আর অপমানে কাঁদতেও পারছিলো না শিখা, গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকেই ফিরে গেলো, আজ তার পক্ষে অফিস করা অসম্ভব! বার বার মনে পড়ছিলো কী করে দীপ শিখাকে তার জালে আটকে ফেলেছিলো। দীপের প্রধানতম অস্ত্র হচ্ছে তার পরিপাটি চেহারা আর সাজ পোশাক, তাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে সে সারাক্ষণ যৌন ক্ষুধায় কাতর। ক্ষুধা মেটানোর তো কতো পথ আছে, তবে কেন মানুষের মন নিয়ে মাতামাতি? কেন এ প্রহসন? নাকি মেয়েদের ঘায়েল করতে পারার মধ্যে দীপ বীরত্ব খুঁজে পায়?

শিখা বিশ্বাস করেছিলো বলে দীপকে উজাড় করে ভালোবাসা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিলো কুহু আপার হাউস ওয়ার্মিং পার্টিতে, সেদিন আলাপের একটু ক্ষণের মধ্যেই বলেছিলো দীপ, ‘আমি বড্ড একা, আমার বন্ধু হবেন?’

পর্ব ৫

দেশের সেরা মডেল ফটোগ্রাফার, নিত্য সুন্দরীদের আনা গোনা যার স্টুডিওতে, তার কী করে বান্ধবীর অভাব হয়? প্রশ্নটা করেছিলো শিখা সেদিনই। ছলনাময় যে মানুষ, তার তো ছলনাই প্রধানতম অস্ত্র। দীপ কিছুক্ষণ শিখার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বলেছিলো, ‘আমি স্যাপিওসেক্সুয়াল, রূপ আমাকে টানে না, মানুষের মেধা মনন আমার কাছে অনেক বেশি আবেদনময়। আমার যে বান্ধবী বা প্রেমিকা হয়নি তা নয়, কিন্তু তাদের সাথে আমার মানসিক উচ্চতা মেলেনি তাই সম্পর্কগুলো স্থায়ী হয়নি।’
শিখা উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী, ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে এবং চমৎকার রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়, এসবই নাকি দীপের কাছে ‘মোর সেক্সি’ তার রূপের চাইতে। সাতাশ বছরের শিখা শ্যামবর্ণের, মুখশ্রী তেমন আলাদা করে চোখে পড়ার মতো নয়, তবে ওর চোখদুটো দ্যুতিময়, হাসিটা মায়ায় ভরা। শিখার সঙ্গে কথা বললে যে কোনো অগ্রসর ভাবনার মানুষ তাকে পছন্দ করবেই।

শিখার ভালো লেগেছিলো দীপের কথাগুলো, মনে হয়েছিলো মানুষটা গভীর, তাইতো দীপের স্টুডিওতে চায়ের নিমন্ত্রণটা নিয়েছিলো। কুহু আপাকে একবার জিজ্ঞেসও করেনি, শিখার আত্মবিশ্বাস ছিলো, ও মানুষ চেনে, দীপ বিশ্বাস করার মতো একজন মানুষ। স্টুডিওটা ঘুরে ঘুরে দেখানোর সময় আচম্বিতে দেয়ালে শিখাকে ঠেসে ধরে দুহাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে চুমু খেয়েছিলো দীপ। এমন করে, এমন সুন্দর করে চুমু খাওয়া যায় জেনেছিলো শিখা প্রথম। ‘আই লাভ ইউ বেইবি’ সেদিনই বলেছিলো দীপ, আরও বলেছিলো ‘আই ক্যান নট ওয়েইট, আই নিড টু ফিল ইউ, ওয়ান্ট টু কাম ইনসাইড ইউ’। এসব যে দীপের ছক করে রাখা বাক্য সে তো শিখা টের পায়নি, বরং কিছুটা লজ্জা কিছুটা সংকোচে সেদিনের আদরমাখা চুম্বনগুলো নিয়ে ফিরে এসেছিলো।

পর্ব ৬

দ্বিতীয়বার ওদের দেখা হয় বেইলী রোডে, নাগরিকের দেওয়ান গাজীর কিসসা দেখেছিলো দুজনে সেদিন। নাটক দেখার সময় দীপের ডান হাতের মধ্যে শিখার বাঁ হাতটা আটকে ছিলো, যেনো কোনোদিনই ওই বাঁধন খুলবে না। আঙ্গুলের সঙ্গে আঙ্গুলের কথোপকথনও যে এতো মধুর হতে পারে সে অনুভব শিখার মনকে দ্রবীভূত করছিলো, মনে হয়েছিলো এক আশ্চর্য মানুষ এই দীপ। দুজনের এই মাখামাখি আচ্ছন্ন করতে থাকে শিখার মন, সে তৈরি হতে থাকে সমর্পনের জন্য। তৃতীয়বারের দেখায়, বাসায় দীপ আপ্যায়ন করেছিলো শিখাকে মজার সব রান্না করে নিজ হাতে। এতোখানি আদৃত বোধ করেনি শিখা এর আগে, মনে হয়েছে এই মানুষটাই তার পরম তার চির আকাঙ্ক্ষার। শরীরে শরীর মিশে গেলো সেই সন্ধ্যায় সোহাগে ভালোবাসায়, অন্তত শিখার জন্যে তো তাই-ই ছিলো। অবিশ্বাস, প্রতারণা কিছুই চিন্তার মধ্যে ছিলো না মেয়েটার। ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার সুখে বুঁদ হয়েছিলো শিখা। বিয়ে সংসার নিয়ে খুব বেশি কথা ওরা যদিও বলেনি, তবে প্রসঙ্গ উঠলে দীপ বলতো, “আমি তো তোমার, শুধুই তোমার, এটা কি যথেষ্ট নয়? আর অতো তাড়া কীসের? তুমি তো অনেক ছোট, সময় আসতে দাও সোনা, এখন ভালোবাসতে দাও তো আমাকে।”

শিখা মায়ের একমাত্র সন্তান, ওর বাবা থাকেন আমেরিকায়, তার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি শিখার। মায়ের পেটে থাকতেই ওর বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। ছেলে বলতে কয়েকজন কাজিন আর দু তিনজন সহপাঠী বন্ধুর সঙ্গে দূরত্ব রেখে মিশেছে, তেমনভাবে জানা হয়নি কোনো ছেলেকেই দীপের আগে। আবেগের সুতীব্র আলোয় দেখতে পায়নি দীপের আচরণের অসামঞ্জস্যকে, ওর অন্ধকার দিকগুলোকে। কী গভীর নকশা কেটে দীপ এগোয় তা বোঝার সাধ্য কখনোই শিখার ছিলো না। যৌন মিলন দীপের কাছে ক্রীড়া সমতুল্য, অথচ শিখার কাছে তা সর্বস্ব দান, কিংবা উজাড় করে ভালোবাসার আরেক প্রকাশ। শুধুমাত্র ক্ষুধা নিবৃত করার জন্য এমন সুনিপূণ অভিনয় করা যায় তা শিখার জানা ছিলো না। জীবনের এই বড় হোঁচট খাওয়াটা ওকে জানিয়ে গেলো, দেখিয়ে দিলো ক্রুর বাস্তবতাকে। শিখার চোখের জল বাঁধ মানে না, ঝরে তো ঝরতেই থাকে যখন তখন, দীপকে তবুও দেখার জন্য মন ক্যামন করে হয়তো দীর্ঘ অভ্যাসের কারণে, পরক্ষণে লজ্জা ও অপমানের কথা মনে হলে গা রি রি করে ওঠে শিখার। ঘেন্না হয় ভীষণ ঘেন্না!

পর্ব ৭

ঘরটা শাদা, সোনালী টুনি বাতি আর রজনীগন্ধা গোলাপ দিয়ে সাজানো পুরোটা ঘর। বিছানায় লালচে নকশীকাঁথা চাদরের ওপর গাঁদা ফুলের পাপড়ি ছড়ানো, অফহোয়াইট রংয়ের কাতান পরে মাথায় বেলিফুল জড়িয়ে, কানে ঝুমকো পরে বসে আছে যে মেয়েটা, খুব চেনা লাগছে মুখটা! কে ও? কাকে দেখছে? আলগোছে কোলে তুলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিতে থাকে মেয়েটার চিবুক, গলা, ব্লাউজের গলা দিয়ে উপচে পড়া স্তনের ক্লিভেজে মুখ ডুবিয়ে রাখে মানুষটা? ওই তো দীপ, মেয়েটা? হ্যাঁ শিখা নিজেই তো! কী করে এটা সম্ভব? না না … চিৎকার দিয়ে উঠতেই ঘুমটা ভাঙ্গে শিখার, সারা শরীর ঘেমে নেয়ে উঠেছে। এমন একটা ক্ষণ শিখার কল্পনায় ছিলো, দীপের সঙ্গে বাসর কেমন হবে সেটা ভেবে রেখেছিলো মনে মনে। স্বপ্নটা মনে করিয়ে দিলো দীপের প্রতি ওর গভীর আবেগের কথা। হু হু কান্নায় নুইয়ে পড়ে শিখা নিজের বিছানায়।

যার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে মধুর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো তার কথা ভোলা যায় কি? মুছে ফেলা যায় চাইলে? যায় না তো। দীপ দেশের বাইরে গেলেই শিখার জন্য দামী ব্যাগ, সাজের সরঞ্জাম, নইলে অন্য কিছু আনতোই, সে সব কি শুধু ওর মন ভোলানোর জন্য? মানুষকে আকৃষ্ট করার যাদুকরী শক্তি আছে দীপের, ও ভালো বাংলা জানে, গুছিয়ে কথা বলতে জুড়ি নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে, কিন্তু শিখা বোঝে ছলনার অস্ত্র হিসেবে এতোটা উৎকর্ষ অর্জন করা সম্ভব নয়। জীবনানন্দ থেকে আবুল হাসান গড়গড় করে বলে যেতে পারে মানুষটা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দীপের তুমুল আগ্রহ, গাইতেও পারে অসাধারণ। আর ফটোগ্রাফার হিসেবে সে তো দেশে স্বনাম ধন্যই। কিন্তু শরীর নিয়ে দীপের এই খেলা সহ্য করা যায় না। শিখা ওকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো বলেই নিজেকে উন্মুক্ত করেছিলো দীপ সেটা বুঝতো। তবে কেনো মন ভাঙ্গার খেলায় মাতলো শরীরের প্রয়োজনে? এটা ভাবলেই আর কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না শিখা দীপকে।

দীপের বিষয়ে শিখা এ’ কদিনে জেনে গেছে অনেক কিছু, কুহু আপা সব জানেন, উনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন শোনার সাথে সাথেই, বলেন, ‘হায় করেছিস কী? আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করিসনি কেনো?’ নেশাগ্রস্থ মানুষ দীপের নেশা যৌনতা। কিশোরী মডেল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বেশ কজনের সঙ্গে নিয়মিত শয্যায় যায় এবং সে নতুন শরীরের খোঁজে থাকে সর্বদা। শিখার সারল্য শিখার দুর্বলতাকে আশ্রয় করে সম্ভোগের বস্তু ছাড়া কিছুই হয়তো ভাবেনি ওকে। তবে দীপ এসেছিলো ক্ষমা চাইতে, শিখার ফোন বন্ধ পেয়ে একদিন ওর বাড়ির সামনে পথরোধ করে দাঁড়ায়, বলে, ‘শিখা, লেট মি কনফেস, আই ওয়ান্ট টু কারেক্ট মি, গিভ মি আ চ্যান্স’। যে মানুষ তার আত্মার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো সে সামনে এসে দাঁড়ালে মনটা জ্বলন্ত মোমের মতন গলে যেতে থাকে, কিন্তু না মনের সমস্ত শক্তি জমা করে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলো শিখা, দীপের বাঁ গালে সব শক্তি দিয়ে চটাস্ করে একটা চড় বসিয়ে আর পেছন ফিরে তাকায়নি। চোখ ভরা জল উপচে পড়ছিলো, ভাঙ্গা আয়নার মতো ঝুন ঝুন ঝুন খসে খসে যাচ্ছিলো শিখার মনটা তবু ফিরে দেখেনি একবারও।

সমাপ্ত

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.