পতিতা বনাম যৌনকর্মী উপাখ্যান

অনসূয়া যূথিকা:

হঠাৎই সারাদেশ জুড়ে তোলপাড় করে দিলো একটা খবর, দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর এক পতিতার জানাজা হয়েছে। এখানে হিরো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। যদিও দুইশো লোকের উপস্থিতিতে জানাজা পড়ানোর পরে সেই মৃতার কী গতি হলো তা আমি জানতে পারি নাই। আসলে সেইটা আর জানতেও চাইলাম না তেমন করে। তার আগেই বিতর্ক চলছে তাকে পতিতা না যৌনকর্মী বলা হোক ৷ আদতে বাংলাদেশের জন্য এটা একটা অদ্ভুত অবস্হা। পতিতাবৃত্তি পেশা, আবার পেশা না।

বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড পতিতালয় বা ব্রথেল আছে। পল্লীতে বাস করে যেসব নারী তাদের জন্য জাতীয় পরিচয় পত্রে পেশার ঘরে তার পরিচয় যৌনকর্মী। তাদের সন্তানদের জন্য আলাদা স্কুল চালায় কিছু উন্নয়ন সংস্থা। তাদের চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হয়ে থাকে আলাদা করে। বলা চলে এক কথায় তারা সমাজের বিচ্ছিন্ন অংশ, পতিত। ফের সাধ করে পোশাকি নাম দেয়া কেন? কেন বলা তারা যৌনকর্মী নামে পরিচিত হবেন, পতিতা নামে না? আপনাদের গালভরা পোশাকি নামের আড়ালে তাদের জীবনটা অমনই ক্লেদাক্ত থাকবে, কিছুমাত্র বদলাবে না।

অনুসূয়া যূথিকা

এস্কর্ট সার্ভিস সারা বিশ্ব জুড়েই চলছে, ছিল বরাবরই। এদেশেও সেই চাণক্যের সময়ে নগরবধুঁ ছিল। আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আম্রপালির নামও জেনেশুনে আসছি আবহমানকাল থেকেই। একটা সময় পতিতাকে নগরবধুঁ বলা হতো, এখন যেমন যৌনকর্মী বলতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এর পিছনে চাপা পড়ে যায় হাজারও নারীর কান্না, হাজারও পরিবারের নিরন্তর যন্ত্রণা। আমরা ভুলে যাই সাধ করে অন্তত পতিতাপল্লীতে এসে কেউ ওঠে না।

সৃষ্টির শুরু থেকেই নারীদেহ নিয়ে ব্যবসায় চলে আসছে, তাই একে বলাই হয় আদিম পেশা। এক শ্রেণীর পুরুষের চোখে নারী মাত্রেই ভোগের বস্তু, লালসার সামগ্রী। একই মাটিতে তৈরি নারী তাই সেকেন্ড সেক্স আর পুরুষ নিজেকে ভাবে একমেবাদ্বিতীয়ম! তাই নারী শরীরে জন্ম নিয়ে নারীকেই বানায় দাসী। পুরুষতন্ত্র চায় এই সমাজে নারী শরীর পুরুষের ভোগে লাগুক, তাই ব্রথেল চলে৷ কেবলমাত্র যৌনকর্মের জন্যই ব্রথেল না এটা বুঝতে হবে। একটা পতিতাপল্লী ঘিরে চলে আরো শতেক অসামাজিক কর্মকাণ্ড। নারী কেবলই ব্যবহৃত হবে, তার দেহ তার সেবা নেবে পুরুষ। বিনিময়ে তাকে খেতে পরতে দেবে পুরুষ, কখনো গর্ভে আসবে সন্তান৷ যে সন্তানের গন্তব্য এই সমাজের বাইরে থাকা সেই পতিতাপল্লীর অন্ধকার জীবন।

কোনো পতিতার সন্তান যদি ছেলে হয় তবে সে বড় হতে হতে হবে এলাকার আর কোন পতিতার দালাল বা বড়জোড় চোর বদমাশ। আর কন্যাশিশু হলে জন্মের পরেই তার গন্তব্য স্থির। ঋতুমতী হতে হতে চলবে তালিম, পরবর্তী সময়ে এই সমাজের বিশিষ্ট পুরুষদের সেবায় হতে হবে নিয়োজিত। পতিতাপল্লীর ঘরে ঘরে কন্যাশিশুদের ভবিষ্যৎ স্থির, সে ভবিষ্যৎ পতিতা। খদ্দেরদের মন জোগানো, দেহের যৌন চাহিদা তা সে যতো বিকৃত হোক সেটা মেটানোই তার কাজ।

ভেবে দেখুন, বছর দশেকের একটা বাচ্চা মেয়ের যোনিতে ভেজানো শোলা পুরুষাঙ্গের আকৃতিতে কেটে স্হাপন করা হয়। শেখানো হয় এই আদিমতম পেশার নানান রকম কায়দা কানুন। ঐ ছোট্ট মেয়েটাকে প্রস্তুত করা হয় সেই শরীরে একটা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ শরীর ধারণ করতে।

সমাজের আর সব ঘরে যখন দশ বছরের মেয়ে স্কুলে যায়, এই সমাজেরই আরেক প্রান্তে আরেক রকম সমাজে সেই বয়সের মেয়েটা তৈরী হয় তার পিতার বয়সী কোন পুরুষের যৌন চাহিদা মেটাতে। অবাক লাগে না আপনাদের না? তা আর কেন লাগবে বলেন সুশীলেরা! সারাদেশ জুড়ে মাঠ কাঁপিয়ে, প্যান্ডেল বেঁধে স্টেজ সাজিয়ে আপনারা হাবিল কাবিলের সঙ্গে তাদের সহদোরার বিয়ের কাহিনি শোনেন বিরাট সেলেব্রিটি সব ওয়াজিদের মুখে।

ওয়াজই বা বলি কেন? জন্ম ইস্তক আপনারা গৌরিদান প্রথার কথা শোনেন। নয় বছরের গৌরি, বিয়ের পরে ঘর করতে এলো ভোলানাথের। ফের মহম্মদ নামের পয়গম্বরের সাথে বিয়ে হয় ছয় বছরের নাবালিকা আয়েশার যখন তিনি পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়। আয়েশা ঘর করতে আসেন মহম্মদের যখন তার বয়স নয়। সেখানে নয় দশ বছরের মেয়ে তো পুরুষের বিছানা গরম করার জন্য যথেষ্ট।

এইটুকু পড়ে মেজাজ চরম খারাপ হলো তো? নিজের ঘরে কন্যা আছে তো আপনার? নিজের কন্যার কথা ভাবুন। তার স্বামী হিসেবে পঞ্চাশ বছর বয়সের কোন দামড়ার কথা ভাবতে পারেন কি?

সনাতন ধর্মে দুর্গাদেবীর পুজায় তাঁর মুর্তি গড়তে বেশ্যাবাড়ির মাটি লাগে। মার্কন্ডেয় পুরাণ মতে দেবীর প্রতীমা গড়তে যে নবকন্যার দ্বারের মৃত্তিকা লাগে, গণিকালয় তার একটি।
সূর্যপুরান মতে যে ব্যক্তি সূর্যদেবের নামে গুটিকয় বেশ্যা উৎসর্গ করবে সে তাঁর সঙ্গে অক্ষয়লোকে বিরাজ করবে। এতো কথার পরেও বেশ্যাবৃত্তি সমাজের চোখে তথা ধর্মের চোখে পাপই। সমাজে বাস করেও পতিতা নামক নারী সমাজচ্যুত। আমরা জানি যে কোন মেয়ে সাধ করে এই জঘন্য পেশায় আসেনা। নেহাত দায়ে পড়ে আসে,আসে বিভিন্নরকমের ফাঁদে পড়ে।

“পতিতা” পাওয়া যায় বলেই কি পুরুষরা “পতিত” হয়, নাকি পুরুষের “পতিত” হবার চাহিদা থেকে “পতিতা”র জোগান দেয়া হয়? স্বাভাবিক যেকোন মানুষই দ্বিতীয় কারণের সাথে একমত হবেন। জ্বী হ্যাঁ, আমাদের দেশসহ বেশীরভাগ দেশেই “পতিত” পুরুষদের চাহিদা মেটানোর জন্যই “পতিতা”র আমদানী বা জোগান দেয়া হয়। এর জন্য দালাল হয় “পতিতা”র। বিভিন্ন অসহায় নারীদের মিথ্যা লোভ দেখিয়ে, শহরে বা বিদেশে নানারকমের চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে অভাবী নারীদের পাচার করা হয়। বর্তমান বিশ্বে মনে হয় অস্ত্রব্যবসার পরেই শিশু ও নারীব্যবসা সবচেয়ে জমজমাট ব্যবসা।
সকল ধর্মমতে দেহব্যবসা পাপ, এতোটাই পাপ যে কোন পতিতা মারা গেলে সে ধর্মমতে দাফন কাফনের হকদার হয় না। একটা সময়ে এদের কপালে মাটিও জুটতোনা।কোনমতে বস্তাবন্দী করে জলে ভাসানই ছিল এদের নসিবে।

হিন্দু ধর্মমতে এরা অগ্নিসৎকার পায়না বা দাহ করা হয়না। ধর্মের কোন বীধিই মানা হয়না।আমরা যতোই বলি পাপকে ঘৃনা করো পাপীকে নয়,তবুও পতিতাদের বেলায় আমরা অন্ধ হয়ে যাই।তাই তাদের দেহসৎকারে, স্রেফ মাটি খুঁড়ে পুতে ফেলা হয় লাশ।
বর্তমান সময়ে কিছু উন্নয়ন সংস্হা পতিতা পল্লিতে তাদের স্বাস্হ্য সেবা, পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটেশন, এইডস প্রতিরোধী প্রজেক্ট চালান। কোন কোন সংস্হা পতিতা পল্লিতে জন্ম নেয়া শিশুদের শিক্ষার বিষয়টা দেখেন।কিন্তু এতো কিছুর পরেও বাংলাদেশে যৌনকর্মীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়েই জীবন কাটান।

প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সীমানা থাকায় ও অবাধ অনুপ্রবেশকারীদের কারণে বাংলাদেশে এইডস সহহ বিবিধ যৌনরোগ বাড়ছেই। আর এসব রোগের প্রধানতম শিকার দেহব্যবসায় লিপ্ত গণিকারা।যৌনরোগ ছাড়াও আর নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় এরা। কারণ স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস।

আমার জানামতে দেশের কোন কবরস্হান বা শ্মশান কমিটি তাদের নিয়মের বাইরে গিয়ে কোন যৌনকর্মীকে এসব স্হানে দাফন করতে দেয় না। উন্নয়ন কর্মীরা তাদের আন্তরিক চেষ্টায় হয়তো মৃতদেহ সৎকার করবার জায়গা পান সেই পল্লীতেই। কখনো এইসব সংস্থার চেষ্টার কারণে জানাজা পড়ানো হয়, কিন্তু কবর দিতে হলে সেই পল্লী সম্বল। আর বিধর্মীদের জন্য কোন শ্মশানেই দাহ বা সমাধির জায়গা মিলবে না।

আমি জানি না ধর্মে এদের জন্য কী বিধান? সত্যই কি এসব হতভাগিনী মৃত্যুর পরে সাড়ে তিনহাত জায়গা না পাওয়াটাই নিয়ম? এরা কি নিজের নিজের ধর্ম মতে দাহ বা অগ্নিসতকার কি সমাধি পাবে না? ধর্ম যাই বলুক, সমাজ এদের সুবিধা নেয়। এরা না থাকলে সেইসব নরপিশাচ এর লালসার শিকার হতে হতো ঘরের মা বোনদের। এরা নীলকন্ঠের মতোই সমাজের বিষ নিজেরা পান করে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.