ধর্ষণ এবং ক্ষমতার সমীকরণ

সুমু হক:

সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণ, বিশেষ করে শিশুদের ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
তারপরও যেখানে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যে অধিকাংশ যৌন সন্ত্রাসের শিকার হওয়া মানুষগুলোই শারীরিক এবং সামাজিক ক্ষমতা এবং অবস্থানের দিক থেকে ধর্ষকের তুলনায় দুর্বল অবস্থায় থাকার কারণেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তবুও যদি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধর্ষণের মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হয়, ধর্ষণের কারণ হিসেবে কোন কোন কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন, আমি নিশ্চিত, অনেকগুলো খুব কমন কিংবা বেশি করে শোনা কারণ উঠে আসবে।

সুমু হক

এই যেমন মেয়েদের পোশাক-আষাক, মেয়েদের পুরুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার, ফ্লার্ট করা, অন্ধকার রাতে কিংবা দিনের বেলাতেও নির্জন কোন জায়গায় একা একা চলাফেরা করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা, ইত্যাদি হাজার রকম সব কারণ। অর্থাৎ, যখন ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ডেমোগ্রাফি আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধর্ষণের কারণ হিসেবে এইসমস্ত ভিকটিমকে দায়ী করা কারণগুলোর অসারত্ব দেখিয়ে দেয়, তারপরও যৌন সন্ত্রাসের সবটুকু দায় আমরা চাপিয়ে দেই ধর্ষণের শিকার হওয়া মানুষগুলোর ওপরই। ধর্ষকদের তাতে একটুও দায় নেই!

মনে আছে, ছেলেবেলায় বাড়ির এক কিশোরী মেয়ের ওপর আমার এক চাচার রাত দুপুরে হামলা করা নিয়ে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলাকালে আমার দাদীকে খুব অসহায়ভাবে বলতে শুনেছি, “কী করবে বল! পুরুষ মানুষের কী সোজা কষ্ট! আল্লাহ যে তাদের কত যন্ত্রণা দিয়ে এই দুনিয়ায় পাঠায়, তাগর যে নিজে গো উপর কোন কন্ট্রোল করার ক্ষমতা নাই, তুই তার কী বুঝবি!!” তখন আমি আরেকটু বড় হলে হয়তো প্রশ্ন করে বসতাম, এই একই কাজ তাঁর সোনার পুত্রধন না করে তাঁর কন্যাত্রয়ের একজন করলে তাঁর যুক্তি কী হতো!

আর শুধু প্রতি বাড়ির এই দাদা-দাদি-নানা-নানীদের দোষ দিয়েই বা কী লাভ! যে অচলায়তনেই অন্ধকার কোণে তাঁদের জন্ম এবং যেই বিষবাষ্পে তাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁরা সেই অচলায়তনকেই যুগের পর যুগ ধরে সামনের দিকে চালিয়ে নিয়ে গেছেন শুধু !
এই পরিবারগুলো থেকেই তো রাষ্ট্র এবং সমাজ তৈরি হয়, তাই না?
যেন যেই সমাজ এবং যেই রাষ্ট্রে এইরকম নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটে তার পেছনে আমাদের কারো কোন দায় নেই ! একে হিপোক্রেসি ছাড়া আর কী বলবো ?

আপনি কি কখনও আপনার পরিবারের কোন শিশুর পরিবার কিংবা পরিচিতদের কারো হাতে এবিউজড হবার ঘটনা শুনে তৎক্ষণাৎ সেই শিশুটির পাশে এসে দাঁড়ানো কিংবা অপরাধীর বিচার চাইবার পরিবর্তে তাকে ধমক দিয়ে চুপ করে থাকতে বলেছেন? বলেছেন কি তাকে যে এইসব লজ্জার কথা কাউকে বলতে নেই, কিংবা নিশ্চয়ই তার নিজের দোষেই এমনটি হয়েছে?

পরিবারের কোন সদস্যের হাতে ধর্ষিত হয়ে বাড়ির কাজের মেয়েটি প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে কখনো কি তার পাশে এসে দাঁড়াবার পরিবর্তে তাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন?

আপনি কি আপনার বাড়ির ছেলেটিকে এই বোধ দিয়ে বড় করে তুলেছেন, যে যত অন্যায়ই কে করুক, সে হলো বংশের প্রদীপ?
আপনি কি আপনার মেয়েটিকে আত্মবিশ্বাসী করে বড় করে তোলার পরিবর্তে তাকে শিখিয়েছেন, যে তার শরীর মাত্রই পুরুষের ভোগ্যবস্তু, খোলা খাবারের প্লেট কিংবা কাঁচা তেঁতুলের মত যাতে পুরুষের স্পর্শ লাগলেই সর্বনাশ হবে, এবং সেই ভয়ংকর পাপের উৎস একটি নারীদেহের অধিকারী হবার অপরাধে সারাজীবন তাকে মাথা নিচু করে কুন্ঠিত হয়ে থাকতে হবে?

আপনি কি আপনার কিশোরী মেয়েটিকে শিখিয়েছেন যে নারী হয়ে জন্মাবার অপরাধে, স্তন-যোনির বাড়ন্ত একটি শরীর ধারণের গ্লানি মাথায় নিয়ে আজীবন তাকে মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকতে হবে?

আপনি কি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর ফর্মুলা অনুযায়ী বিশ্বাস করেন যে নারী কখনোই পুরুষের সমকক্ষ নয়? আপনি কি বিনা প্রশ্নে সেই ধর্মের সমস্ত নারীবিদ্বেষী নিয়ম মাথা পেতে নেন?

পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা যেই পুরুষ, তাদের পাপের উৎস হিসেবে নারীদেরকে তাদের দেহটিকে নিয়ে সদা বিব্রত, কুন্ঠিত থাকার এবং ঢেকে রাখার পক্ষপাতী কি আপনি?

আপনি কি সারাজীবন নিজের স্বামীর হাতে ধর্ষিত হতে থাকা মেয়েটিকেও নাক-কান বুঁজে স্বামীর ঘর আঁকড়ে থাকতে পরামর্শ দেন?

যদি এই প্রশ্নগুলোর একটির উত্তরও ” হ্যাঁ ” হয় , তাহলে আজকের বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং সমাজে অজস্র ধর্ষণের শিকার নারী এবং শিশুর যে পরিণতি, আপনিও তার জন্যে সমানভাবে দায়ী।

আপনি তর্ক করতে পারেন, বলতে পারেন আমি বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু আমি বলতে পারি, যে উদাহরণগুলো দিলাম, তার প্রত্যেকটিই কোন না কোন সময়ে আমার নিজের, আমার পরিবার এবং পরিচিতজনদের কারো না কারো জীবনে ঘটেছে।

ধর্ষণ কোন একটি বিশেষ রোগ নয়, এবং এর সাথে সবসময় যৌনতার সম্পর্কও থাকে না।
ধর্ষণ এবং যৌন সন্ত্রাস সবসময়ই কোন না কোন একটা ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাধারী এবং তার অধীনে থাকা দুর্বলতর মানুষগুলোর ওপর ক্ষমতাশীলের ক্ষমতার প্রকাশ এবং আস্ফালনের খেলা কেবল। আমি আমার থেকে দুর্বলতর মানুষটির ওপর ক্ষমতার আস্ফালনে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি, এবং করবো।

সেই যেমন নির্ভয়ার ধর্ষক নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ভয়ংকর দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলো, মেয়েটা রাতের বেলায় পুরুষ বন্ধুর সাথে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল কেন? ওকে একটা শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন ছিল, ওকে ওর “আওকাত” দেখানো জরুরি হয়ে উঠেছিল, তাই সে যা করার করেছে !
করবেই। কারণ বাইরে যতই নিজেদের প্রগতিশীল মুখোশ ধরে রাখি না কেন, ভেতরে ভেতরে এই সমাজের ৯০% মানুষের মানসিকতা এইটাই।

ধর্ষণ কিংবা যৌন সন্ত্রাস কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং আইন নারীকে যে দৃষ্টিতে দেখে, সেই নারীবিদ্বেষী মানসিকতারই একটা বহিঃপ্রকাশ এইসব ধর্ষণ এবং যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা।
পার্থক্য শুধু একটাই, নির্ভয়ার ধর্ষক অশিক্ষিত সমাজের দরিদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করা একজন বাস চালক বলে তাকে আমরা উদাহরণ করে তুলি, অথচ যে সমস্ত রাজনীতিবিদ, মিডিয়ার মাথা মাথা ব্যক্তিরা কিংবা সমাজের অন্য ক্ষমতাশালী মানুষগুলো খুব পরিশীলিত এবং সংস্কৃতিমনস্ক উপায়ে দিনে রাতে অজস্রভাবে তাদের চাইতে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর তাদের আগ্রাসী যৌনতাকে চাপিয়ে দিয়ে চলেছে, তাদেরকে আমরা দেখেও না দেখার ভান করে বিব্রত একটু হাসি হেসে এড়িয়ে যাই কেবল।

জ্বি হ্যাঁ, এদের কেউ আপনার আমার বাবা, কেউ আমাদের স্বামী, কেউ আমাদের প্রেমিক, কেউ আমাদের চাচা, ফুপা, কিন্তু তার মানে এই নয়, যে এদের ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালেও একেকটা যৌন সন্ত্রাসী লুকিয়ে নেই !

তাই শুধুমাত্র একজন বিচ্ছিন্নভাবে এক একজন ধর্ষকের নামে বিচারের দাবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলে কিংবা মানববন্ধন করে কিচ্ছু করতে পারবেন না আপনারা, যতক্ষণ না মশামাছি আর তেলাপোকার মত প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ধর্ষকের জন্ম দেয়া এই রাষ্ট্র-সমাজ আর ধর্মের উর্বর ধর্ষকামিতার সংস্কৃতির মূল ধরে টান দিতে পারবেন।
এই ধর্ষকেরা হয়তোবা তার সাঙ্গপাঙ্গদের সহায়তায় কিংবা ক্ষমতাধীন দলের সদস্যদের সাথে যোগসাজসে দিব্যি বেরিয়ে আসবে।

এই দেশ, এই সমাজ তাদের কিচ্ছু করবে না, রাষ্ট্র আর আইন তো নয়ই। মনে রাখবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, পৃথিবীর ৯০% দেশে আজ অবধি ধর্ষণের যে বিচার প্রচলিত রয়েছে, সেই আইন কিন্তু একজন পুরুষের (পিতা, স্বামী, ভাই, ইত্যাদি) অধীনস্থ একটি সম্পত্তি হিসেবে ধর্ষণের ফলে নারীর চরিত্র কিংবা শারীরিক আঘাতে তার মালিক পুরুষটির যে ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতিপূরণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তৈরি হয়েছে।

সেই জন্যেই আমরা দেখি আমাদের মতো সমাজে আজও টু ফিঙ্গার টেস্টের মত যন্ত্রণাদায়ক এবং অপমানজনক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে হয়। ধর্ষণের সাথে আজও জড়িয়ে থাকে সম্ভ্রম, শ্লীলতা, চরিত্র ইত্যাদি সব বায়বীয় ধারণা, যা কিনা আসলে ধর্ষণের শিকার নারীর মালিক পুরুষটির ইমেজ রক্ষা কিংবা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

নারী যেখানে ধর্ম, আইন কিংবা রাষ্ট্রের বিচারে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত নয়, সেখানে তার আবার নিজের শরীরের মালিকানাই বা কী, আর সেই মালিকানায় হস্তক্ষেপই বা কী! যে সম্পদ আমার নয়, তার ক্ষতিপূরণের বিচার বিবেচনায় আমার স্থানই বা কোথায়!

এতো গেলো নারীর অবস্থান। শিশু এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোর ওপর ঘটে চলা এবিউজ নিয়ে কিছু বলতে গেলে তো মহাভারত হয়ে যাবে।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনেক জায়গাতেই বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতর ঘটে ধর্ষণগুলো ধর্ষণ বলেই বিবেচ্য নয়।
হিসেবটা খুব সোজা, যে আইন স্বামীকেই একজন নারীর প্রভুত্বের অধিকার দিয়েছে, সে কি করে সেই সম্পর্কের ভেতর নারীর ব্যক্তিস্বত্তার স্বীকৃতি দেবে? আর ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়াটা নির্ভর করে নারীর নিজের কিংবা তার অধিকারীর প্রতি সংঘটিত একটি অপরাধ হিসেবে। এখন সেই অধিকারী ব্যক্তিটি নিজেই যদি ধর্ষক হয়, তবে সেখানে বিচারের প্রশ্নটাই অবান্তর।

বাংলাদেশের আইনে তাই বৈবাহিক সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত ধর্ষণের কোন স্বীকৃতিই নেই। সেই কোন মান্ধাতার আমল থেকে যাও বা বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর ন্যূনতম বয়সের একটা বাধ্যবাধকতা ছিল, আমাদের মদিনা সনদপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী “বিশেষ ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে” নারীর ক্ষেত্রে বিবাহের ন্যূনতম বয়স ১৮ থাকার নিয়মটিকে উড়িয়ে দিয়ে জগৎ সংসারের পেডোফাইলদের দিব্যি সুবিধা করে দিয়েছেন।

নেই নেই করেও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকমানের মানবাধিকার কর্মীদের সংখ্যা তো কম নেই, তাঁদের ক্ষমতার জোরটাও খুব কম নয়, কিন্তু কোথায়, আজ পাঁচ বছর পার হয়ে যাবার পরও তো সেই আইনের টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারলো না কিংবা চাইলো না? সে কি কেবল এই ইস্যুটি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এবং মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা ইন্টেলেকচুয়ালদের পরিচিত জগতের বাইরের ঘটনা বলে?

যেখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদেরকে অবৈধভাবে বিয়ের হাত থেকেই বাঁচানোর কোন দায় কারও নেই, সেখানে সেই শিশুটি বিয়ের রাত থেকে স্বামীর হাতে ধর্ষণের শিকার হতে থাকলো কিনা, ধর্ষণের শিকার হতে হতে একসময় মরেই গেলো কিনা, এসব নিয়ে ভাবার দায় কার আছে! বিয়ে করা বৌয়ের আবার ধর্ষণ!

যেখানে যতভাবেই আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলুক না কেন, এটা অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই যে দেশের প্রতিটি কোণায় ন’মাস বয়সী শিশু থেকে শুরু করে মাঝবয়সী নারীর ধর্ষণ এবং মৃত্যুর জন্যে আপনি, আমি, আমরা সবাই কম বেশি দায়ী!

একজন ধর্ষকের বিচার চেয়েই (যে বিচার প্রক্রিয়াতেও আবার ভরসা করা যাচ্ছে না, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শক্তির সাথে অপরাধীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতির জন্যে) এ সমস্যার সমাধান হবার নয়।

ধর্ষণ এমন একটি সামাজিক প্রবণতা, অনন্তকাল ধরে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং আইন যাকে পুষ্ট করে তুলেছে। ধর্ষণ এবং যৌন সন্ত্রাসের প্রতিকার চাইতে গেলে তাই এই সবগুলো ক্ষমতার উৎসের মূল ধরে টান দিতে হয়। সে সাহস আছে তো আমাদের?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.