সরিতা আহমেদ:
মাঝে মাঝে কিছু অর্বাচীন বিতর্ক সোশ্যাল মিডিয়ার ‘আনসোশাল’ পাবলিকদের আলোড়িত করে।
সাম্প্রতিকতমটি হলো ‘ফেখক’ গোষ্ঠীর বই লেখা, তার প্রচার করা, অটোগ্রাফ দেওয়ার ছবি নিয়ে ফেসবুকে লাইক কুড়ানোর আত্মরতি ইত্যাদি।
প্রায় বছর পাঁচেক ধরে নানা মহলে শুনে আসছি -“আরে, ছেলেকে বলেছি চাকরি-বাকরি না পাস, ব্যবসা বা আর কিছু করতে না পারিস, ফেসবুকে আনতাবড়ি লিখে চল। এদিকে ঠিক বিখ্যাত হবি। আজকাল তো ফেসবুকে সবাই লেখক!”
বলা বাহুল্য উক্তির প্রতিটা শব্দের কোষে মিশে আছে তীব্র শ্লেষ ও ধিক্কার।
এমন কথা চালাচালি আমজনতা থেকে খ্যাত শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের (বাঙালি) মহলেও হতে দেখেছি। হ্যাঁ, আমার সামনেই হতে দেখেও কিছু উত্তর দিতে পারিনি, কারণ একটা সময় হয়তো মনের কোনও স্থানে এই ধারণাও হয়েছিল ‘এরকম একজন’ যখন বলছেন তার মানে সত্যিই বোধ হয় যারা ফেসবুকে লেখে তারা উচ্চকোটির জীব (?) নয়!’ খারাপ লাগলেও চুপ ছিলাম। তারপর তো চলেই এলো এই শ্রেণীর নিজস্ব নাম – ‘ফেখক’।
এজন্য অনিন্দ্যদার সামনে সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ!
পরে অনেক পরে আশেপাশের লোকের গণ্ডি ছাপিয়ে রীতিমতো ‘প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্র ও নানা আলোচনা চক্রে’ যখন এই বিষয়ে বিতর্কের ঢেউ উঠতে দেখলাম (পড়লাম) তখন একটা কথাই মনে এলো প্রথম যে, তাহলে ‘উচ্চকোটির জীব না’- শ্রেণীটিও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মাথায় চড়ার সাহস দেখাতে জানে!

তা যারা (পড়ুন যেসব বাঙালি) সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখে, বা নিজের চ্যানেলে কিছু বিষয়ে ভিডিও দেয় এবং সেগুলো কিছু ‘লোকে খায়’ – তাদের নিয়ে এতো ছাঁট জ্বলার কী আছে?
*** এই ফেসবুকে একাউন্ট থাকা বাঙালি যারা রাস্তার ধারে হিসি করে, চায়ের দোকানে বাসস্টপে বস্তুবাদী সবকিছুর অযাচিত সমালোচনা, মাইনে পত্তর বা বকেয়া ডিএর সাথে বাজার দরের ওঠাপড়া বা ছেলেমেয়ের পড়াশুনার পেছনে খরচার বড়াই অথবা স্রেফ পরনিন্দা পরচর্চায় মেতে থাকে; হোয়াটস্যাপে বা মেসেঞ্জারে আবোল-তাবোল ভিডিও বা ফুল-পাখি-দিলদিওয়ানে গুড মর্নিং থেকে করোনা ভাইরাস নিয়ে অজস্র ফরোয়ার্ড মেসেজ ও ফেক নিউজ শেয়ারে ব্যস্ত থাকে – তাদের চেয়েও কি একটু আধটু পড়াশোনা করে কি-বোর্ড চালানো ‘ফেখক’রা খারাপ?
*** না হয় একটা দুটো বিষয় নিয়ে কিছু জ্ঞানের ব্যাখ্যার পোস্টই দিয়েছে, কাউকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি তো দেয়নি! – তাহলে মাথা ব্যথা কীসের?
*** না হয় তাদের ওইসব ‘আনতাবড়ি’ লেখা কিছু জনের ভাল লেগেছে, কেউ বাহবা, সমর্থন অথবা শুভেচ্ছাই জানিয়েছে – গণহিস্টিরিয়ার মতো ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘আল্লাহুয়াকবর’ ধ্বনি দিয়ে রামদা হাতে ধ্বংসের বার্তা তো যায়নি তাদের কাছে! – তাহলে আপনাদের ফাটছে কেন?
***মফেখকদের বই যদি কিছুজন কেনে, তারা যদি ছবিছাবা পোস্টও করে ফেসবুকে, তাহলেও বা কী! সোশ্যাল মিডিয়া সৃষ্টিই হয়েছে নিজেকে জাহির করতে। এই যে আপনারা যারা ‘ফেখক’দের আত্মপ্রচার নিয়ে এতো কথা লিখছেন সেটাও ফেসবুক আছে বলেই। এটাও কি আপনাদের ‘আত্মপ্রচার’ নয়? সেলফি হোক বা নিজের বইয়ের ছবি পোস্ট – এতে ফেসবুকের নিয়মবিরুদ্ধ কিছু হলো কি?
*** মনে রাখবেন এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় গণ জাগরণ ‘শাহবাগ’ আন্দোলন শুরু থেকে শেষ অবধি যাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, তারা সবাই ‘বাঙালি ব্লগার’ – অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়াতেই লেখালিখি করে।
কী-বোর্ড চালিয়ে যেসব ছেপে বেরোয় – সেগুলো যদি এতোটাই নিকৃষ্ট শ্রেণীর লেখা হবে তাহলে গোটা রাষ্ট্র একসাথে রাস্তায় নেমে গর্জে উঠতে পারতো কি? ভেবে দেখবেন।
*** আর অটোগ্রাফ দেওয়া! তা মশাই নিজের বইয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার সই দেওয়ার উচ্ছ্বাস আপনাদের হয়নি সেটা বুকে (নিজের) হাত রেখে বলতে পারেন? ‘ফেখক’দের অটোগ্রাফের ছবি যদি স্ক্রিনবন্দীই হয় আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাপানোই হয়, সেটাও তো ফেসবুকের আত্মরতির ফর্মূলা অনুযায়ীই হচ্ছে – তাতেই বা দোষ কোথায়? বা তাতেই ‘লেখক সত্ত্বার অবমাননা হচ্ছে’ এমন জাত খোয়ানোর ধোঁয়াই বা কোথায়?
হ্যাঁ, দোষ তখনই হবে যখন, নিজের বই অযাচিতভাবে গছানোর ধান্দায় কেউ আলাপ জমাবে।
বইমেলায় নাকি বাংলা বইয়ের বাজারে বিক্রিবাট্টায় মন্দা চলছে – তা সেটা কিন্তু নতুনদের বই প্রকাশনা স্টলের ভিড়ে খুব একটা মালুম হয় না।
মালুম হয় তখন, যখন ‘ফেখক’দের কাছে বাকি পরিচিত জগতের লোকেরা আশা করে ‘তোর বইও কিনতে হবে টাকা দিয়ে?”
অথবা “ভারি তো লিখিস, ফ্রিতে দে দেখি!” অথবা “কিনলে ‘লেখক’দের বই কিনবো, ওর মতো ছাইপাঁশদের কেন?”
— হ্যাঁ এই ক্যাটাগরির ক্রেতারাই বলে বেড়ান বাংলা বই ‘আজকাল বিক্রি হয় না’।
এবার লেখক আর ফেখক-দের ‘সাহিত্যচর্চা’ নিয়ে উটকো বিতর্কটা চালাবেন কিনা ভেবে দেখবেন। কারণ সেটা চালালেও আপনাদের আবার ‘ফেখক’দের টাইমলাইনে আসতে হবে কিনা!
[পুনশ্চ – আচ্ছা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদেরই এমন বাঙালি ‘ফেখক’ দের লেখালিখি নিয়ে ফাটছে ক্যানো? বইমেলাটায় ‘বাংলা’ মেলে না তাই?? – সেটাও ভাবার সময় এসেছে।
ভাবুন , ভাবা প্র্যাকটিস করুন।