ইসলামকে সমঝে চলুন!

অনুসূয়া যূথিকা:

শরিয়ত সরকার একজন বয়াতি, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। তার অপরাধ তিনি কবিগানের আসরে বলেছেন, গান-বাজনা হারাম কোরানের কোথাও বলা হয় নাই। কেউ যদি হারাম প্রমাণ দিতে পারে তবে তাকে আমি ৫০ লাখ টাকা দিব এবং জীবনের জন্য কবিগান ছেড়ে দেব।

ইসলাম ধর্ম মতে ইসলাম শান্তির ধর্ম। এই ধর্মের মূল ভিত্তি আল কোরআন, মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। দুনিয়াতে প্রায় ১৯০ কোটি মুসলমান ইসলাম মানে। ইসলাম মতে আখেরি জমানায় ফেৎনা ফ্যাসাদ বাড়বে। ইসলামের নামে তেয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত এক সম্প্রদায়ের নাম মুসলমান। এদের কে সহি আর কে ভুল তা ঠিক করে দেবে কে! যিনি শিয়া, কুর্দি, আহমদিয়াকে ভুল বা অমুসলিম বলছেন তার নিজের ভিত্তি কী?

ইসলাম বলে কোরআনে সমস্ত সমস্যার সমাধান আছে, ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে কোরআন দ্বারা। বস্তুত এটিই কোরআনের শেষ আয়াত যেখানে বলা হচ্ছে মানব জাতির জন্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হিসেবে অবতীর্ণ করা হলো!

শিয়া, সুন্নি, আহমদিয়া ও খাওয়ারজির মধ্যে আপনি কোনজন! সুন্নি মুসলমানের মধ্যে হানাফি, হানাবিল, বা হাম্বলি, মালিকি ও শাফির বিভেদ জানেন কতোজন? এক ইসলাম নামে কোন বাস্তবতা নেই। ইসলাম নামের ধর্মে অসংখ্য ভাগ ও বিভক্তি রয়েছে। সুন্নি ইসলামের লোকেরা অনায়াসে একে অন্যকে মুশরিক, ভুল, বিপথগামী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। এমনকি এক হানাফি আরেক হানাফিকে এসব অভিধা দিয়ে থাকেন।

আল কোরআনে নামায কায়েমের কথা আছে, কিন্তু কী নিয়মে আদায় করতে হবে তা বলা নাই। এটা জানতে হলে হাদিসের দ্বারস্থ হতে হবে। কোরআনের বাইরে একজন মুসলমান বড়জোর হাদিস পড়েছেন। এবং সেই হাদিস যে সহিহ হবে তারও কোন গাছপাথর নাই। আমরা জন্ম ইস্তক পাঠ্যপুস্তকে যেসব হাদিস পড়েছি একরকম বাধ্য হয়ে বা যেসব ঘটনা মুহম্মদের বলে জেনেছি, সেসবের অনেকই আজ মিথ্যা বলে প্রমাণিত। যেমন মুহাম্মদের সঙ্গে বুড়ির সেই ঘটনাটা।

আর যেসব হাদিসের বই এদেশে সহজলভ্য তা ইমাম বুখারি সঙকলিত বুখারি শরীফ। সহি হাদিস বলতে বুখারি শরীফ যারা বুঝে থাকেন, তারা জানেন এটা সুন্নিদের। কিন্তু শিয়াদের হাদিস বুখারির সঙ্গে কদাচিত মিলবে৷ আল কোমনির হাদিসকে শিয়ারা সহিহ হাদিস বলে মানেন। যেমন আয়েশা নামটা যতোটা মহিমান্বিত সুন্নিদের কাছে, ততোটাই ঘৃণ্য শিয়াদের কাছে। আবার শিয়াদের মধ্যেই রয়েছে পনেরোটি ভাগ, কে ঠিক কে ভুল!

ফের আরব থেকে আমদানি করা শরিয়তপন্থী আছেন। ওহাবি সালাফিদের সঙ্গে এই উপমহাদেশের ইসলামের বড় একটা খাতির নাই। রোজই মিশর থেকে পড়ে এসে কেউ না কেউ জ্ঞান দিচ্ছেন, পুরুষের মুখে দাঁড়ি কই? আপনাদের ঠিকমতো সেজদা দিতে হয় না। মিলাদ পড়েন কেন, এটা বিদাত! এরকম দাঁড়িয়ে কিয়াম করা স্রেফ নামাজে সম্ভব, আল্লাহর সামনে এভাবে দাঁড়াতে পারবেন। রসুলের জন্য দরুদ পড়বেন, মিলাদ না। এদেশেও মাযহাব না মানা আহলে হাদিসেরা আছেন, আপনি বলতে পারেন না তারা মুসলমান হিসেবে ভুল তড়িকা মানেন।

কেমনে প্রশ্ন করেন, তুমি ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ো না এটা সহি না। ফের আহলে কিতাবের সঙ্গে মুসলমানদের মতভেদ তো সর্বজন বিদিত।

গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের নামে অদ্ভুত ফতোয়াবাজি চলে। বৃহস্পতিবার ছেমা মাহফিল এবং শুক্রবারের নামাজে নারী বিদ্বেষের ঝড় উঠে। ধর্ষকের বিরুদ্ধে কথা বড় বেশি চলে না। বলা হয় মেয়েরা কতোটা নির্লজ্জ, কতোটা বেহায়া। আপনাদের ইসলামে পুরুষের নজরকে হেফাজতে রাখার কথা বলা হয় নাই কি হে মুমিন? ওয়াজ মাহফিলের প্রধান আলোচনা নারীর বিরুদ্ধাচরণ।

দেশের এহেন পরিস্থিতিতে বয়াতি শরিয়ত সরকার ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু বয়াতি শরিয়ত সরকার কী বলেছেন, তাঁর ভুল কোথায় সেটা ধরিয়ে দিয়ে বললেই তো হয়। সেটা না করে করে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য কুখ্যাত আইসিটি আইনে মামলা করেন! বলতে সমস্যা হয় সরাসরি বলতে পারেন না যে, ইসলামে গান হারাম!

ইসলামে সুফিবাদ একটা শক্তিশালী ধারা যার মধ্যে অন্তত এগারোটি ধারা রয়েছে।
এই সুফিদের একটি বড় অংশ আমাদের দেশের বাউল এবং বয়াতিরা। তাই তাদের কাছে সংগীত একটি পবিত্র অনুভূতি, প্রার্থনার একটি প্রধান মাধ্যম। সংগীত বিরোধী যেকোনো বয়ানে তাদের প্রতিক্রিয়া আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুফিদের স্বভাব বা আচরণকে ধরে আপনি ইসলামকে মূল্যায়ণ করতে পারেন না।

সুফিবাদের জন্ম হাদিস সঙ্কলনের আগে, মাযহাব সৃষ্টিরও দেড়শো বছর আগে। তাই নারীসঙ্গ বিবর্জিত, গানের মাধ্যমে প্রার্থনায় নিরত সুফিদের তত্ত্ব কট্টরপন্থী ইসলাম সমর্থকদের সঙ্গে মিলবে না।

কোরান এবং হাদিসে গান-বাজনা নিয়ে যেসব বাণী পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে ধর্মবেত্তাদের মধ্যে তর্ক আর মতভেদ আছে বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু সত্যি কি তাই!

ভাষাগত জায়গা থেকে আরবি একটি বৈচিত্র্যময় ভাষা। বাক্যের গঠন অনুযায়ী একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন একাধিক অর্থ হতে পারে। প্রথমে কুরআনের কথা বলতে গেলে, মোট চারটি আয়াতে মুসলমানদেরকে সংগীতে লিপ্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে।

“সুতরাং প্রতিমাগুলির দূষণ থেকে বিরত থাকুন এবং মিথ্যা নিরর্থক শব্দ থেকে বিরত থাকুন।” (22:30)।সুরা আল হজ্ব।

“আর এমন লোকদের মধ্যে কে আছে যে ‘ব্যর্থ কথা’ কিনে যাতে সে অন্যদেরকে সত্য জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করতে পারে এবং এটিকে উপহাস করার জন্য এটিকে অবহেলা করে তার জন্য শাস্তি (শাস্তি) ” (31: 6)। সুরা আল লুকমান।

মুমিনরা অবশ্যই সফল, যারা তাদের প্রার্থনায় নম্র হয় এবং যারা নিজেকে অযথা শব্দ থেকে দূরে রাখে”। (23: 1-3)। সুরা আল মুমিনিন।

“এবং দয়াময় আল্লাহর বান্দারা হল ………. যারা মিথ্যা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন অযথা কথা হয় তখন তারা মর্যাদার সাথে সেখান থেকে চলে যায়” (25:72)। সুরা আল ফুরকান।

এই কুরআনের আয়াতের যুক্তিগুলি কিছুটা সুদূরপ্রসারী, যদিও সংগীতের কোনও স্পষ্ট উল্লেখ সেখানে নেই।

সংগীতের পক্ষে বা বিপক্ষে জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় হাদীসে। তবে একটি হাদীস আছে যা প্রায়শই সংগীতের ব্যবহার রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয় তা হ’ল মুহাম্মদ (সা।) এর স্ত্রী আয়েশার বাড়িতে দফ বাজিয়ে দুটি যুবতীর গান গাওয়ার গল্প। আবু বকর (মুহাম্মদের শ্বশুর এবং পরে প্রথম মুসলিম খলিফা) মেয়েদের গাওয়ার জন্য ধমক দিলে মুহাম্মদ “তাদের একা থাকতে দিন” এই প্রতিক্রিয়া জানান।

সংগীত সম্পর্কে মুসলমানদের বিরোধিতার মূল কারণ হলো, অনেকে বিশ্বাস করেন যে এটি একটি খুব শক্তিশালী নেশা বা শক্তি, যা শ্রোতাদের মধ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি করতে সক্ষম যা সম্ভবত তাদের যুক্তির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে, তাদের ভক্তিপূর্ণ জীবন থেকে ফিরিয়ে দিতে এবং পাপী আচরণকে আমন্ত্রণ জানায়। ইসলামী সমাজের এই সংগীত বিরোধীরা জীবনে এর গুরুত্বহীনতার প্রমাণ হিসাবে কুরআনে সংগীতের উল্লেখ না থাকার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

শরিয়ত যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, তার জবাব দেয়ার মতো দেশে কি একজনও আলেম ওলামা নেই? দেশের এতো এতো শায়খ, মাশায়েখ, মুফতি, মৌলবিরা গেলেন কই! বছর বছর সরকারি টাকায় হজ্ব করা মডারেট মুসলমানেরাও মুখ খুলতে নারাজ নাকি!
তাই তাকে জেলে ঢুকিয়ে তার মুখ বন্ধ করা হলো? নাকি সরাসরি মানতে পারছেন না ইসলামে গান হারাম!

স্পষ্ট করে কোরআনে গানকে হারাম করা হয় নাই সত্য, তাই কেবলমাত্র কোরআনের আয়াত দিয়ে গানকে হারাম বলা কঠিন বটে। কিন্তু হাদিসের দলিল এবং ইজমা ও কিয়াস দ্বারা স্পষ্ট করে বলা চলে ইসলাম গান বাজনা সমর্থন করে না। কেবলমাত্র গান না, চিত্রকর্ম ভাস্কর্য, নৃত্যকলা, নাট্যতত্ত্ব তা সে যতো উঁচু দরের হোক না কেন তা নিষিদ্ধই বটে! সমর্থন মিলবেনা কোনরকম নন্দনতত্ত্বেরই, চলবে না লেখালেখিও।
হাত দিয়ে খেলা চলে এমন সব রকমের খেলা নিষিদ্ধ।

এখন আপনারা বলতে পারেন, এদেশের রাষ্ট্রপ্রধান একজন নারী এবং ইসলাম ধর্ম মতে নারী শাসন হারাম বা বৈধ না।

ইসলামে নারীর শাসন নাই জেনেও নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী। ইসলামকে হেফাজতে রাখবার জন্য তৈরি হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা শফি হুজুরের দেয়া খেতাবে তিনিই আবার ‘কওমি জননী’, এটা আপনাকে মানতে হবে। ইসলামে গান হারাম জেনেও একাধিকবার হজ্ব ও ওমরাহ করা আমাদের প্রধানমন্ত্রী গান শোনেন। এই সেদিন বিপিএল এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৈলাশ খেরের গান শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর নাম নিয়ে গান করেছেন বিদেশী গায়ক।

ইসলাম নাচ, অভিনয় সমর্থন করে না জেনেও এদেশের নারীরা পর্দায় অভিনয় করে। ইসলামে পর্দা ফরজ জেনেও পর্দা ভেঙে অভিনয় করতে আসেন, বেপর্দা হয়ে নাচ করেন।
সারাজীবন হারাম রোজগার করেছেন মেনে শেষ বয়সে হজ্বে যায়, বোরকা পরে। ছোট পর্দার নওশিনকে দেখুন হালের তার ইউটিউব চ্যানেলে কিংবা ড্রামা কুইন শাবানার বোরকা পরা ছবি! এমনকি এদেশের সব নামি কমিউনিস্ট সরকারি টাকায় কেমন হজ্ব করতে ছুটেন, দেখেন! এরা ঠিকই জানেন, এদের পেশা, এদের কাজ, ইসলাম সমর্থন করে না। তাই সাক্ষাৎকারে শমী কায়সারকে বলতে হয়, তিনি পাক্কা নামাজি। সারাদিনের শুটিঙের ফাঁকে তিনি পাঞ্জেগানা নামাজ পড়েন। এতো এতো আত্মপ্রবঞ্চনার কী দরকার বলেন তো!

আপনার গান ভালো লাগে, তাই গান করেন, গান শোনেন। ধর্ম সমর্থন করে না, তবু ছবি তোলেন, ফেসবুকিং করেন। করেন তো?

নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্ত করা হয়েছে। আপনি যতো গলা ফাটান না কেন, সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বক্তব্য দিলে আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র তার শক্তি প্রয়োগ করবে। একজন শিল্পী হিসাবে শরিয়ত বয়াতি নন কেবল, প্রত্যেকেরই কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। সমাজে চলমান ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার নিয়ে কথা বলতে হবে, কিন্তু সেটাও দায়িত্ব নিয়ে।

বাংলাদেশ অতি অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে একজন শরিয়ত বয়াতি যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মগ্রন্থকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন, তখন অধিকাংশ মানুষের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য এবং সেটা সামলাতে রাষ্ট্রের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্হিতি স্বাভাবিক রাখতে শরিয়ত বয়াতির গ্রেফতার তাই রাষ্ট্রের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত এটা ছাড়া আর কীইবা করতে পারে বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্র?

আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে, বয়াতির চ্যালেঞ্জ বলুন বা বক্তব্য বলুন তার জবাব দিতে এখন কারোরই হাতে সময় নাই। আমরা বরং সব তর্ক একপাশে রেখে এই আইন থেকে শরিয়ত বয়াতির মুক্তি চাই৷

রাষ্ট্র তার নিজের ধর্মে চলুক, শিল্পীকে তার মতো করে তার কাজ করতে দেয়া হোক। ইসলামও তার নিজের নিয়মে চলুক, চৌদ্দশো বছরের প্রাচীন রীতি মেনে। এদেশে শিল্প সাহিত্যের চর্চা করতে হলে ইসলামকে সমঝে চলতে হবে, এই ঘটনায় আমরা অন্তত এই শিক্ষা পেলাম।

শেয়ার করুন: