গান কেবল জীবিকা না, গান প্রার্থনা!

অনুসূয়া যূথিকা:

আমি তখন খুব ছোট, ব্রাহ্ম মুহূর্তে ঘুম ভাঙতো। আমার ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত মা সারারাত না ঘুমিয়েও সেই কাকডাকা ভোরে স্নান সেরে উন্দালে ঢুকতেন৷ আপনাদের আধুনিক ভাষায় যাকে বলে কিচেন, মানে রান্নাঘর। একান্নবর্তী পরিবারের লোকেদের অন্নের জোগাড়ে ব্যস্ত হতেন। কাঠের ভুষির সে উনুন ধরাতে তাকে বেগ পেতে হতো না, সাবলীলভাবে আগুন ধরাতেন পাটখড়ি দিয়ে। রান্না চড়াতে চড়াতে বা কুটনো কুটতে তার গলায় মিছরির দানার মতো সুর খেলতো।

এমন একটা জায়গায় বাড়ি যে, একদিকে রক্ষাকালী মন্দির তো একপাশে পড়ে মাজার আর মসজিদ। অদূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসতো আযানের সুর! মুয়াজ্জিন যখন বলতেন, আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাউম…. ঘুম থেকে নামাজ উত্তম, তখন মনে কোন ভাবনা আসতো না। আজানের মোহনীয় সুরে কান পেতে ভিনদেশী শব্দ শুনতাম। কানে বাজতো না, কর্কশ লাগতো না, বিরক্তিকর লাগতো না।
আজানের আগে ঘুম থেকে উঠতেই বাড়ির লোকে অভ্যস্ত, পুরা গ্রাম, পাড়া, মহল্লার লোকে ঐ সময়ে জাগে।

অনুসূয়া যূথিকা

সনাতন ধর্মে বলে সূর্য উঠার আগে মানুষ জাগে, সূর্যের পরে জাগে রাক্ষস। কাজেই ভোরের মুসুল্লিদের সাথে দেখা হয়ে যেতো মন্দিরে পূজা দিতে যাওয়া পূজারি, ভক্তদের৷ এ বাড়ি ও বাড়ির বাগান থেকে পূজার জন্য ফুল তুলতে গিয়ে এর সাথে তার দেখা হতো, কুশল বিনিময় হতো। কৃষ্ণ পূজায় সাদা ফুল লাগে, শ্যামার জন্য রক্তজবা। কিন্তু কেউ কখনো কাউকে বলে নাই, মুসলমান বাড়ির ফুলে কৃষ্ণের পূজা হয় না।

বয়স আরেকটু বাড়লো, বাড়ির সকলে কোন না কোন সঙ্গীত করে। বাড়িতে মজুদ নানান রকম বাদ্যযন্ত্র। সেজকাকা বেহালার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ বাজাতে পারেন ব্যাঞ্জো। বাবা তবলায় বসলে আর সবাই একদম চুপ করে যায়। তখন কেবল বাবার হাতের জাদুতে তবলায় বোল ফোটে, যেন একেক করে ফুটছে ফুল!

ছোটবেলায় আমার গলা তেমন সুরে বলতো না, আর হারমোনিয়াম বাজাতাম উল্টো হাতে। বেলো চাপতাম ডান হাতে। গানের চাইতে নাচে উৎসাহ বেশি ছিল এমন না, কিন্তু একটু অপ্রতিভ ছিলাম বলে নাচ শিখতেই বলা হলো।

যখন শাস্ত্রীয় নৃত্য অভ্যাস করছি খুব মন দিয়ে, শিখছি ভূমিপ্রণাম, গণেশ বন্দনা৷ এতো ভালো লাগতো সুর ও ছন্দে সেই গণেশ স্তুতি৷ একসাথে এলাকার ছেলেমেয়েরা শিখতাম, একই গুরুর কাছে একই নিয়মে। ভূমিপ্রণামের নিয়ম তো সকল শিক্ষার্থীদের জন্য একই রকম, কে হিন্দু কে মুসলমান আর কে বৌদ্ধ তা তো জানার দরকার হতো না। যতোজন নিয়ে ক্লাস শুরু হতো কিছু বরাবরই ঝরে পড়তো দেখতাম, কারণ জানতাম না। বড় হতে হতে জানলাম, মুসলমান মেয়েরা ভূমিপ্রণাম করবে না বলে নাচ ছেড়েছে। কেউ বলতো, বড় হয়েছে তাই আর নাচবে না।

সামনে একটা বড় প্রোগ্রাম ছিল আমাদের, জেলা শিল্পকলা একাডেমির। হঠাতই একজন রিহার্সেলে আসা বন্ধ করে দিলো। বহু খুঁজে তার বাসায় গিয়ে জানলাম সে আর নাচ করবে না৷ কারণ লোকের সামনে নাচ করলে কখনো বেহেশতে যেতে পারবে না। ওর নানি বলেছেন, ছোট ঘরের মেয়েরা নাচ করে স্টেজে। শরিফজাদিরা, ভালো ঘরের মেয়েরা নাচ করে না। তারা রেশমের কাজ শেখে, কাপড়ে নকশা করতে শেখে। নাচ গান করে না ভালো ঘরের মেয়েরা!

মন খুব খারাপ থাকলে চুপ করে দুর্গা স্তোত্র শুনি। কখনও মেহের জৈনের গাওয়া ইসলামি গান শুনি। কী সুন্দর করে তিনি গেয়ে উঠেন, ইয়া নবী সালাম আলাইকা! তিনি তো ধর্মমতে ইসলাম অনুসারী নন, কিন্তু কী দরদ গানে! কিন্তু দেশজুড়ে নানান ওয়াজে এখন বলা হয়, এসব দরুদ পড়া যাবে না, মিলাদ পড়া যাবে না। শবেবরাতের কোন নিয়ম ইসলামে নাই! হালুয়া রুটি বানিয়ে বিলানো যাবে না, বাড়িতে আগরবাতি জ্বালবে কেন? এসব বেদাআত!
সারাটা দেশে ওহাবিদের সব ফতোয়া ভাসে, দেশটা আর আগের মতো নাই।

মসজিদে বা কারও ঘরে যখন কোরআন পাঠ করা হয়, অদ্ভুত তন্ময়তা ভর করে। কী মায়াময়
কোরানের সুর করে আয়াত পাঠ করার নিয়ম। কিন্তু এক এলাকায় একসাথে যখন বহু মাইকে কোরআন তেলাওয়াত, ওয়াজ, ইসলামি জলসা একসাথে করে, তখন মনে হয় এই দেশটারে তো চিনি না।
আমি যে এলাকায় বড় হয়েছি, যে এলাকায় এখন বাস করি, চারদিকে হাজারও মসজিদ, কিন্তু আজানের সেই মোহময় ধ্বনি আর নাই। সব কেমন যেন মেকি, কেমন যেনো প্রফেশনাল লাগে!

ফের কোন কোন এলাকার বাড়িওয়ালা হিন্দু বা বৌদ্ধ জানলে বাড়ি ভাড়া দেন না। কেউবা আবার ভাড়া দিলেও বলে দেন, সন্ধার সময় ঘন্টা বাজাবেন না! ঘরে ধূপ জ্বালানো যাবে না, তুলসী গাছ রাখা যাবে না! দেশটা কি একা মুসলমানের? পিতৃপিতামহের ভিটা এই দেশ, জন্মের পরে নাড়িপোতা যে দেশের মাটিতে, সে দেশটা তবে কাদের!

সারাজীবন শুনলাম গায়ে হলুদ, বিয়ের আগে আগে করা স্ত্রী আচার৷ এখন নতুন নিয়ম এসেছে, গায়ে হলুদ বলা যাবে না। মুসলমানের বিয়েতে গায়ে হলুদ হয় না, হবে মেহেদী সন্ধ্যা! বৌভাত না, ওটা হিন্দুয়ানী শব্দ। মুসলমানের হবে ওয়ালিমা, হবে রুকসাত! সারাটা দেশে ইসলামাইজেশন সারা। কথার আগে পরে ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, জাজাকাল্লাহ খাইরান। খোদা হাফেজ আর বলা যাবে না, বলতে হবে আল্লাহ হাফেজ! নিজেরা ধর্ম মানবে, তা মানুক, কিন্তু হিন্দুরে এতো ঘৃণা করে কেন!

এই দেশের খুব কম মুসলমান আছেন যার বংশতালিকা খুঁজলে উর্ধ্বতন তৃতীয়, না হয় চতুর্থ পুরুষে কেউ হিন্দু নেই। আমি আমার মায়ের দিদা মানে নানিকেও দেখেছি। ঐ সময়ে পাবনা শহরের মুসলমান পুরুষেরাও ধুতি পরতেন, লুঙ্গি না। বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরে এদেশে ইসলাম ঢুকলো, ঘাঁটি গেড়ে বসলো।

শান্তির ধর্ম ইসলামের পতাকা তলে দলে দলে বহু হিন্দু নিজের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু লোকের কিছু আচার থাকে দেশ ও কাল ভেদে, ধর্ম বদলালেও সেসব বদলানো খুব সহজ কাজ না৷ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সব কাজে সব ক্ষেত্রে ধর্মের পার্থক্য করাটা কি জরুরি?

শরিয়ত বয়াতি

এদেশের মাঝিমাল্লা গান ধরে, কৃষক ক্ষেতে কাজ করতে গান করে। কুমার, কামার, জেলে, তাঁতি গান করে না কে! জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, নির্বাণ, ধামাইল কতো রকমের নাম কতো রকমের বৈচিত্র্য। বহু আউলিয়ার পূণ্যভূমি যদি বলেন বাংলাদেশকে, তবে হাজারও সাধকের দেশও বলতে হবে৷ সুফি, দরবেশ, বাউল, ফকিরেরও দেশ বাংলাদেশ। গান এদের জীবিকার মাধ্যম না, প্রার্থনার মাধ্যম। গান এদের সাধনা, গান তাদের মোক্ষ লাভের উপায়, নির্বাণ লাভের মাধ্যম। পাখির কন্ঠ যেমন রোধ করা যায় না, বুলবুলি যেমন গাইবে, প্রাণ খুলে গাইবে তেমনি আমার দেশের বাউল, ফকিরও গাইবে। ভাটির দেশের মানুষ রাধাকৃষ্ণের বিরহ গাঁথা যাকে ধামাইল বলে, তা গাইবে ফের বিয়ের অনুষ্ঠানে ধামাইলের সঙ্গে নাচবেও। ভাওয়াইয়া গাইবে উত্তরের গাড়িয়াল ভাই, কী দিয়ে তার কন্ঠ রোধ করবেন?

ইসলামে গান হারাম, গান গাওয়া জায়েজ না, কবিতা, গদ্য, গল্প, উপন্যাস বৃথা শব্দ তাই কল্পকাহিনির নামে এসব রচনা করা ইসলাম সমর্থন করে না। খুব ভালো কথা, তবে তো এদেশে বিউগল বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো উচিত হবে না। গান স্যালুট আর দেয়া যাবে না।
নামাজের কিয়ামের মতো দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা যাবে না। শহীদ মিনারে ফুল দেবেন কী করে?

এমনকি গাইতে পারবেন না দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙগীত। মানবেন তো? পারবেন তো মেনে নিতে? ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাবে গড়া মানসিকতার সঙ্গে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংঘাত নিশ্চিত।

এদেশে মুসলমান বংশোদ্ভূত যতো শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক সবাই যেন আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন৷ এরা জানেন ইসলাম তাদের এই পেশা এই নেশাকে স্বীকৃতি দেয় না। ইসলাম মানলে একজন গায়িকা, নায়িকা স্টেজ পারফর্মেন্স করতে পারবেন না। কিন্তু তারা তাদের মনের কথা শুনে সংস্কৃতির সাধনা করেন। আবার এও বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আজকের গান খুব ভালো হয়েছে। একজন খেলোয়াড় সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি রোযা রেখে খেলেছেন, তাই জিততে পেরেছেন। একজন ভাষ্কর বলেন, ইনশাআল্লাহ, কাজটা ভালো হবে! অদ্ভুত না?

বাঙালির আবহমানকালের ঐতিহ্য চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, পুরানো বছরকে বিদায় জানানো। নাগরিক পহেলা বৈশাখের উৎসব এই ঐতিহ্যের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে বটে, তবুও মেনে তো নিয়েছি আমরা। হিন্দু বাড়িতে বছরের শুরু আর শেষদিনে পূজা থাকে, কিন্তু দেশের ক্যালেন্ডারের সাথে তাদের পঞ্জিকার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তবুও প্রতি বছর একদল কট্টর মুসলমান ধুয়া তুলবেনই পহেলা বৈশাখ হিন্দুয়ানী চাল। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা শব্দটা বাংলা, বাংলাদেশেরই ভাষা। খুব অদ্ভুত লাগে যখন চারুকলার ছাত্ররা এর আয়োজন করেন, আর মুখে বলেন আলহামদুলিল্লাহ, আমরা কাজটা করতে পেরে খুশি। মাথায় হিজাব পরেও কাজ করেন অনেকে, বোরকা পরেও মেলায় আসেন। তবু একদল বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবেন, এই উৎসব বন্ধ করা হোক। এসব হিন্দুয়ানা এদেশে চলবে না। বাঙালির সব আনন্দ, সব উৎসব, সব রীতি তাদের কাছে কেবল আর কেবলমাত্র হিন্দুর চাল মাত্র।

যারা মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুয়ানী চাল দেখে বড় কষ্ট পান, তাদের জানা উচিৎ…সনাতন ধর্ম একটা উদার ধর্ম৷ একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী, যাকে চলতি কথায় হিন্দু বলা হয়, তার অন্য ধর্মাবলম্বীর সাথে মেলামেশায় তার ধর্ম তাকে আটকায় না, আটকায় যা তা হলো আচার মাত্র৷
নিজের ধর্মকে জানুন, জানুন ইতিহাসকে৷
আপনারা না জানলেই তো ইতিহাস বদলে যাবে না৷

এদেশে জোর করে মুসলমান বানানো যেমন হয়েছে.. তেমনই অন্য ধর্মের কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করার ঘটনাও আছে৷ দেশ বিভাগ যেমন সত্য, সত্য মুক্তিযুদ্ধ, তেমনি সত্য হিন্দুদের বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া৷ আবার সেই ছাড়াভিটার তুলসী মঞ্চ না ভেঙ্গে সেখানে কোন মুসলিম নারীর গলবস্ত্রে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেয়াটাও সত্য৷ সেইরকম বাড়িগুলোর পুকুরপাড়ে থাকা ছোট ছোট শিবমন্দিরগুলো রেখে দেয়া হয়।

এই দেশটা এমনই, বদলানো এতো সহজ তো না। এক শরিয়ত বয়াতির গ্রেফতার তো না। বরাবর হাজার বাউলের চুল দাড়ি কেটে নেয়া, দোতারা ভাঙা, নানান হেনস্হা দেখেছে বাংলাদেশ। তবুও এদেশের সুফি, ফকির, বাউলেরা গান করেছেন, করবেন। শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা, লালন ফকিরের দেশে হাজারো সাধকের জন্ম হয়েছে, আরো হবে।
গানের পাখিদের কন্ঠ রোধ করার সব অপচেষ্টা রুখে দিয়ে তারা গাইবে!

যা দিয়েছো তুমি আমায় কী দিবো তার প্রতিদান
মন মজাইলা ওরে বাউলা গান।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.