লাবনী আকতার:
ভারতে কিছুদিন আগে ২২ বছর বয়সী একজন ছাত্রী ও তার দুই বান্ধবী মিলে ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচতে ইলেকট্রিক ব্রা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্রা এর বৈশিষ্ট্য হলো মেয়েদের স্তনে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার চাপ অনুভূত হলে ধর্ষককে ইলেকট্রিক শক আহত করবে এবং পুলিশের নাম্বারে কল চলে যাবে। নিশ্চয়ই এটা একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
কিন্তু অন্তর্বাস না পরেও শুধুমাত্র শুকাতে দেয়া থাকলেও যেসব পুরুষের যৌন উত্তেজনা তৈরি হয় তাদের জন্য তো কোনো প্রযুক্তি চালু করা সম্ভব হয়নি এখনও। পুরুষের চোখে নারীকে নিয়ে যে দৃশ্যকল্প কাজ করে, তাতে নারী অন্তর্বাস পরুক কিংবা না পরুক তাতে কিচ্ছু আসে যায় না।
বেশিরভাগ সময়ে একটা বিষয় খুব ভাবায়। অনেকে ভাবতে পারেন এটা খুবই অপ্রয়োজনীয় বিষয়, কিন্তু নারীর সাথে পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টা অন্তর্বাসের সাথে কাজ করে। লিঙ্গীয় বৈষম্যের ধারাবাহিকতা এখানেও কার্যকর আমার মনে হয়।
যখনই ছাদে বা বারান্দায় অন্তর্বাস শুঁকাতে যাই তখনই নানা সংকট এসে হাজির হয়। কেননা বাড়ির গেটে নোটিশ দেয়া থাক আর না থাক কমন করিডোরে নারীদের অন্তর্বাস শুকানো একটা দৃষ্টিকটু বিষয়। ছোটবেলা থেকেই পরিবারেও দেখেছি এ বিষয়টা। যখনই এগুলো শুকানো প্রয়োজন পড়তো হয় অন্ধকার কোন স্থান, যেখানে কোনো ছেলের চোখ পড়ে না কিংবা জামা/ওড়নার নিচে দিতে হতো। এতে করে ঘটতো নানা বিপত্তি, বিশেষত শীতে বা বর্ষাকালে ঠিকমতো শুকাতো না, ভেজা জিনিসটা পড়ে থাকতে হতো। কী যে অসহ্য!
পিরিয়ডের সময় স্যাঁতসেঁতে অনুভব হতো খুবই, ক্ষেত্রবিশেষে ইনফেশনও হয়ে যায়। যখন কোনো নারী পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তখন পুরুষ পোশাকের নিচের শরীরটাই বেশি দেখে। আর যখন ছাদে বা বারান্দায় শুকাতে দেয়া হয়, তখনও অন্তর্বাসের নিচের মানুষটাকেই দেখে। কোনো পার্থক্যই থাকে না।
একবার একটা কোরিয়ান সিনেমা দেখেছিলাম বিখ্যাত পরিচালক কিম কি দুন এর ‘থ্রি আয়রন’ নামে, যেখানে এক ভবঘুরে চোর থাকে; যা কাজ হলো যে বাসাগুলোতে মানুষ থাকে না সেখানে নকল চাবি দিয়ে প্রবেশ করে রান্না করে খায়, গোসল করে, ঘর গুছিয়ে দেয়, এমনকি কাপড়ও ধুয়ে দেয়। তারপর বাড়ির লোক এলে পালিয়ে যায়। চোরটি এরকম একবার এক মডেলের বাসায় যায়, বাসায় মডেলের বেশ কিছু ছবি থাকে। একসময় দেখা যায়, গোসলে গিয়ে সে ঐ ছবিটা নিয়ে মাস্টারবেট করতে থাকে।
একইভাবে কিছুদিন আগে শুনলাম একটা ছেলে মেয়েদের অনুপস্থিতিতে মেয়েদের রুমে ঢুকে মাস্টারবেট করছে, সেটা আবার সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ছে। অদ্ভুত চিন্তাধারা ছেলেদের! মেয়েদের পোশাকে সমস্যা বলে আজকাল অনেকেই ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করেন, কিংবা বৈধতা দেন, অথচ এখানে মেয়েরা তো নেই, এমনকি কোন ছবিও নেই। তাহলে কী বলবেন?
একদল ঠিকই বলবেন, আর তা হলো, এরা মানসিক বিকারগ্রস্থ। আমার প্রশ্ন হলো, যারা মেয়েদের অনুপস্থিতিতে করছে, তারা যদি পাগল হয়, আর যারা জেনে বুঝে করছে, তাদের সাথে কী পার্থক্য? আসলে ‘ছেলেরা এগুলো করবেই’ এটাই এখন একটা সহজাত বিষয় হিসেবে চালিয়ে দেয়া হলেও মেয়েদের বলা হয় শালীন পোশাক পরতে। আর তা না পরলে খারাপ মেয়ে, কার মেয়ে, কোন পরিবারের খোঁজ শুরু হয়ে যায়।
তবে ছেলেদের শুধু চোখ ফিরিয়ে নিলেই হলো। ছাদে যখন কাপড় শুকাতে যাই সেখানে অসংখ্য পুরুষের আন্ডার গার্মেন্টস দেখি, কিন্তু কোন মেয়ের ব্রা/পেন্টি শুকাতে দেয়া অলিখিত অপরাধ বলেই সেগুলো অদৃশ্যমান। ছেলেদের আন্ডার গার্মেন্টস কি যৌন সুড়সুড়ি দেয় না কোনো মেয়েকে? মেয়েদের যদি এতো সম্মোহন ক্ষমতাই থাকে, তবে তো নারীই যৌনতার একচ্ছত্র অধিকারী, পুরুষ সেখানে অনুষঙ্গ। বেশিরভাগ নারী এ বড়াই করে না হয়তো। কারণ নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রে গায়ে পরে কিছু করে না, এইটুকু নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তার আছে।
বিল্ডিঙের নোটিশবোর্ডে বড় করে লেখা থাকে আপত্তিকর জিনিস কমন করিডোরে রাখবেন না, কিন্তু পুরুষেরটা তো প্রতিদিনই দেখি। এর উপরে আবার কিছু কিছু ব্যাচেলর পুরুষের বাসায় নারী কাজের বুয়া প্রতিদিন তার আন্ডার গার্মেন্টস পরিস্কার করে বারান্দায় শুঁকাতে দিচ্ছে, অথচ এই ব্যাচেলর এর বউ হয়তো অন্য এলাকায়, অন্য মেয়ের ছাদে কাপড় শুকানো নিয়ে কটুক্তি করছে কিংবা এই কাজের বুয়াই তার ছেলের বউকে/নিজের যুবতী মেয়েকে বাড়িতে এ বিষয় নিয়ে কটূক্তি করছে। কী একটা বেড়াজাল চারদিকে!
আবার দেখুন, পর্দার নামে, ইসলামের নামে ইদানিং যে পর্দা প্রথা চালু হয়েছে, সেটা আরও বিপদজনক; হিজাবের সাথে মেকাপের তো কোন ঘাটতি নেই, নেই পরিধেয় পোশাকেও। আকর্ষণ করার কথা যদি আসে, তাহলে বলবো এ এক অভিনব উপায় বটে! একবার একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, ‘বোরখা পরা সেই মেয়েটি’, সেখানে বোরখা পরা মেয়েটির প্রতি তীব্র আকর্ষণের কথাই ফুটে উঠেছে; কেননা, অনাবৃত শরীরের চেয়ে বরং আধো বের হয়ে থাকা দুটি চোখে চিকন কাজল রেখা কিংবা হাতে-পায়ের নখে সুন্দর করে নেলপলিশ বা মেহেদী বেশ আকর্ষণীয় পুরুষের চোখে।
যদিও আজকাল বোরখার নানা ফ্যাশনে এটা একটা ফ্যাশন অনুষঙ্গের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিংবা অনেকেই সময় ও পোশাকের স্বল্পতার জন্যও পরে থাকে। তার সাথে পর্দার কোন যোগাযোেই হয়তো নেই। অনেককেই দেখেছি, পর্দার চাপিয়ে দেয়া প্রভাব থেকে যদি কখনও সে মুক্তি পায়, তখন সে বরং পোশাকে বেশি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। সুতরাং পর্দা এবং লজ্জা নারীর ভূষণ বলে নিজের একান্ত বারান্দাটাও যদি অপরের জন্য ছেড়ে দিতে হয়, অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে নিজের আর থাকলোটা কী? তার থেকে বরং নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করাই ভালো, ঘুড়ি উড়িয়ে দিলেও লাটাইটা যেন নিজের হাতেই থাকে; ভোকাট্টা হওয়ার আগেই যেন প্রয়োজন মতো লাগামে টান দেয়া যায়।