বাংলার সর্বংসহা দেবীমূর্তি vs একজন গুলতেকিন

সুমু হক:

সম্প্রতি অভিজিৎ ব্যানার্জী অর্থনীতিতে নোবেল পাবার পর এক অর্বাচীন সাংবাদিক তার মা নির্মলা ব্যানার্জীকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ছেলের নোবেলজয়ী হওয়ায় তাঁর অনুভূতি কী এবং তার প্রিয় খাবার কী, ছেলেকে তিনি রেঁধে খাওয়ান কিনা, ইত্যাদি। অর্থনীতির অধ্যাপিকা নির্মলা ব্যানার্জি যথেষ্ট ধৈর্যের সাথে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছিলেন। তিনি যতোই গুছিয়ে তাঁর উত্তর দিতে চান, সাংবাদিক ভদ্রমহিলাটি ততই ঘুরে ফিরে আলোচনা, তাঁর ছেলের প্রিয় খাবার, মা তাঁকে রেঁধে খাওয়ান কিনা এইসব প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনতে চান।
দর্শক হিসেবে আমাদের এবং ইন্টারভিউয়ার হিসেবে সাংবাদিকটির সৌভাগ্যবশত সাক্ষাৎকারটি আর দীর্ঘ করা হয়নি।
যেখানে মা নিজে অর্থনীতির অধ্যাপিকা, ছেলের নোবেল প্রাপ্তিও অর্থনীতিতে, সেখানে অনেক আকর্ষণীয় প্রশ্নই করা যেতো মা-ছেলের কাজের জায়গায় এই যোগসূত্রটি ধরে, প্রশ্ন করা যেতে পারতো অভিজিতের গবেষণার বিষয় নিয়ে। কিন্তু তা না করে, সাংবাদিকটি প্রথমেই চলে গেলেন বাঙালি মায়ের স্টিরিওটিপিক্যাল সংজ্ঞা অর্থাৎ রান্না আর ছেলেকে খাওয়াবার জায়গায়। যেন একজন অর্থনীতির অধ্যাপক হওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়, নির্মলা ব্যানার্জীর প্রথম এবং শেষ পরিচয় তিনি একজন মা, একজন নারী, যার কাছ থেকে সমাজ এর বেশি কিছু প্রত্যাশাই করে না!

বাংলা সাহিত্য যুগ যুগ ধরে চিরায়ত নারীর প্রতিচ্ছবি আঁকার নাম করে মেয়েদের যে স্টিরিওটিপিক্যাল “masochistic” ছবি এঁকে দিয়ে গেছে, সেখান থেকে কি আমাদের এখনও বের হয়ে আসার সময় হয়নি?

একটা মানুষকে চট করে দেবী বানিয়ে দেবার প্রচুর সুবিধে। বছরে দুচারদিন নিয়ম করে ফুল-বেলপাতা দিলেই (পড়ুন, কর্পোরেট নারী দিবস কিংবা মা দিবস উদযাপন করলেই) কাজ উদ্ধার হয়ে যায়। প্রতিদিনকার জীবনে তার মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো নিয়ে বেশি মাথা না ঘামালেও চলে। দেবী, তার আবার মানবিক অধিকার কী! সে তো হবে সর্বংসহা, পরের প্রয়োজনে নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেয়া ক্ষুধা-তৃষ্ণা কিংবা যৌন চাহিদাহীন পাথরের প্রতিমা!
এইসব তেলেঝোলে মাখা বাঙালি মায়ের মাতৃময়ী মূর্তি, (অর্থাৎ কিনা মা মাত্রই তাঁকে দেবী হতেই হবে, মায়েদের রক্তমাংসের মানুষ হতে নেই), আর এইসব সর্বংসহা স্ত্রী যারা অত্যাচারী স্বামীর হাজার অন্যায় অবিচার সহ্য করেও হাসিমুখে জীবন কাটিয়ে দেয়, তাদের বাইরে আর কোন নারীর কি বাংলাদেশে কোনো অস্তিত্ব নেই?

সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হবার পর পরই বেশ ভালোরকম আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল বলে তখন আর আমি এ নিয়ে তেমন কিছু লিখিনি।

গুলতেকিন খান

কিন্তু গত দুদিন ধরে গুলতেকিন খানের বিয়ে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে যা শুরু হলো, তাতে করে মনে হলো, এবার কিছু কথা না বললেই নয়!

অধিকাংশ পোর্টাল হয় শিরোনামে আর নয়তো প্রথম বাক্যটি গুলতেকিনের পরিচয় দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদের প্রাক্তন কিংবা প্রথম স্ত্রী হিসেবে। যেন এর বাইরে তার আর কোনো পরিচয়ই নেই! গুলতেকিন একটি অত্যন্ত শিক্ষিত এবং ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান, অত্যন্ত বিদুষী একজন ব্যক্তি এবং একজন প্রতিষ্ঠিত কবিও বটে!
অথচ প্রায় চার যুগ আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, যার পরিসমাপ্তিও ঘটে গেছে বহু যুগ আগে, সেটাই কিনা হয়ে উঠলো তাঁর মুখ্য পরিচয়!

তাই সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছেন, সেও যেন একটুখানি করুণা মিশিয়ে, ভাবখানা এরকম, যে এতোদিনে গুলতেকিনের তবুও একটা গতি হলো! যেন দ্বিতীয় একটা বিয়ে না করে এতোদিন তিনি রীতিমতো অসহায় হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন!

আরেকটি মন্তব্যে দেখলাম বলা হচ্ছে, যে শুধু শারীরিক সম্পর্কের প্রয়োজনে নয়, একটা বয়সের পরে কামগন্ধহীন নিখাদ বন্ধুত্বের প্রয়োজনেও বিয়েটা হতে পারে।
যেন গুলতেকিনের মতো একজন ৫৬ বছর বয়সী নারীর কোন যৌন জীবন, যৌন চাহিদা থাকতে নেই!

আর হবে নাই বা কেন!

যে হুমায়ূন আহমেদের প্রাক্তন স্ত্রী হবার বোঝা গুলতেকিনকে আজ অবধি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেই হুমায়ূন নিজেও তো ছিলেন পুরুষতান্ত্রিকতার পরাকাষ্ঠা!
মধ্যবিত্তের জীবনকে হয়তোবা তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন, কিন্তু সেই একই সাথে তার নারী চরিত্রগুলোকে (অন্ততপক্ষে তাঁর শেষদিকের লেখায়) পূর্ণ মানুষের চেহারা দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীকে খোলা খাবার, তেঁতুল কিংবা নাজুক ফুলের উপমা দিয়ে সীমিত করে রাখা হয়েছে, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি তাঁর সাহিত্যের নারী চরিত্রগুলোকে তৈরি করেছেন। দিনশেষে যারা কেবলই রমণী, মানুষ নয়।
অর্থাৎ মধ্যবিত্তের সংসার চালানো, খুব প্রেডিক্টেবলভাবে প্রেমে পড়া, জোছনা আর ফুলপাখি নিয়ে প্রেমিকের সাথে বিলাস করা (স্ত্রী হলে সেই বিলাসটুকুও আর ভাগ্যে নাও জুটতে পারে) আর কারণে অকারণে অন্য সবার প্রয়োজনে নিজের ইচ্ছে আর চাওয়াগুলোকে বিসর্জন দেয়াতেই (লেখকের প্রথম দাম্পত্য জীবনের সাথে এই সাদৃশ্যটুকু বোধহয় কাকতালীয় নয়) তাদের সার্থকতা।

বাঙালি বরাবরই জনপ্রিয় মানুষ মাত্রকেই ঈশ্বর হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। তাই হুমায়ূন আহমেদের লেখার বিন্দুমাত্র সমালোচনা এরা সহ্য করেন না। আর তাঁর লেখাকে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে শুরু করলে তো কথাই নেই! এমন ধৃষ্টতা কারোও আছে না কি!

আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশে শহুরে মানুষের সংস্কৃতি মাত্রই এলিট সংস্কৃতি নয়। শাহবাগ, লিটল ম্যাগাজিন, শিল্প একাডেমি, বাংলা একাডেমি কিংবা বেইলি রোডের কুলীন সংস্কৃতির বাইরেও যে মানুষগুলো তাদের সংস্কৃতিও। এদের শিক্ষা আছে, সদিচ্ছা আছে, সমাজে নিজের স্থান করে নেবার মতো বেপরোয়া লড়াইয়ের ক্ষমতা আছে, কিন্তু আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই।

সুমু হক

যা আছে, তা হলো এক ধরনের শূন্যতা। আর্থিক সঙ্গতি এবং বিলাসিতা করবার মতো অবকাশ নেই বলে এরা শহুরে কুলীন সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না, আবার শহুরে শিক্ষা তাদেরকে মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের সংস্কৃতি থেকে দূর করে দেয়। ফলে তৈরি হয় একধরনের সাংস্কৃতিক শূন্যতা বা ভ্যাক্যুম। এই শূন্যতা পূরণে প্রকৃতির নিয়মেই তখন ছুটে আসে মধ্যবিত্তের সহজপাচ্য প্যাকেজ সংস্কৃতি। একদিকে হুমায়ূন আহমেদ- ইমদাদুল হক মিলন, অন্যদিকে টিভির প্যাকেজ সংস্কৃতি আর তার মাঝে হয়তো খানিকটা পাঁচফোঁড়নের মতো করে ধর্ম আর হিন্দি সিরিয়ালের রংচঙে পৃথিবী। নরম, থকথকে আবেগ আর অবাস্তব ইচ্ছে পূরণের সহজ আফিমের চাহিদা।

হুমায়ূন আহমেদ- ইমদাদুল হক মিলনের লোকপ্রিয় সাহিত্য (?) সেই আফিমের চাহিদার চমৎকার সমাধান।

ষাট -সত্তরের দশক এমনকি নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের ক্লাসিক্যাল সাহিত্য পাঠের যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল, রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির অবকাশ তৈরি হয়েছিল, তার অবক্ষয় শুরু হয়েছে নব্বইয়ের দশকেই। সিরিয়াস বই পড়ে নিজের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে নিজের জীবনের আদর্শ তৈরি করার পরিবর্তে বাজার চলতি সহজ হালকা সাহিত্য (?) পড়ে নিজেকে হিমু কিংবা রুপার আদলে তৈরি করে নেয়াটা বরং সহজ হয়ে দাঁড়ালো।
যেখানে পাঠকের সহজ স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিটুকুই নেই, সেখানে কোন লেখকের রচনা পুরুষতান্ত্রিক হলো কি না, সে বিচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না!
এইসব পুরুষতান্ত্রিক আবর্জনা ছেঁকে ফেলে সাহিত্যকে মানুষে মানুষে সমতার দৃষ্টি থেকে দেখলে বাংলা সাহিত্যে কজন সাহিত্যিক উতরোবেন?

এমনকি অনেক যথেষ্ট শিক্ষিত এবং সচেতন হুমায়ূন ভক্তকেও দেখেছি, যে তারা “স্যার” এর এই নারীমাত্রই হয় মায়াবতী আর নয়তো রূপবতী হবার ফর্মুলার ভেতর সমস্যার কিছু দেখেন না!
আমজনতা তো এরাই। সুতরাং এরা কি খায় না খায় বিবেচনা করেই টিভির প্যাকেজ নাটক এবং বইমেলায় বইয়ের চাহিদা নিশ্চিত করা হবে।
এখনকার গড়পড়তা নিউজ পোর্টালের পাঠকও খুব সম্ভব এরাই।
সুতরাং গুলতেকিন খানকে হুমায়ূন আহমেদের প্রাক্তন/প্রথম স্ত্রী ছাড়া অন্য পরিচয়ে এরা জানবে না, এটাই স্বাভাবিক।

গুলতেকিনের বিয়ের খবর প্রচার করতে গিয়ে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের অন্ধ ভক্তকূল আবারও প্রমাণ করলেন, ব্যক্তি গুলতেকিন সময়ের তুলনায় অনেক আগে জন্মেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বকে ধারণ করবার এবং মূল্যায়ন করবার ক্ষমতা যেমন হুমায়ূন আহমেদের ছিল না, তাঁর পাঠক এবং আমাদের গণমাধ্যমগুলোরও নেই!

শেয়ার করুন: