নারীবাদী সচেতনতা: চিন্তা বদলের এক নিরন্তর সংগ্রাম

মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার:

(বেল হুকস এর মূল প্রবন্ধ “Consciousness – raising, A constant change of heart” এর বাংলা অনুবাদ)

কোনো মানবসন্তান নারীবাদী হয়ে জন্মায় না, তাঁরা নারীবাদী হয়ে ওঠেন। এমনকি কেউ কেবল জন্মগত লৈঙ্গিক পরিচয়ে নারী বা কন্যা সন্তান হবার কারণেই নারীবাদী রাজনীতির সমর্থক হয়ে ওঠেন না। আরও অনেক রাজনৈতিক অবস্থানের মতোই একজন মানুষ নানান ধরনের বিবেচনা ও সক্রিয়তার মধ্যে দিয়েই নারীবাদী রাজনীতির সমর্থক হয়ে ওঠেন।

নারীরা যখন প্রথম সংগঠিত হতে শুরু করলেন, কথা বলতে শুরু করলেন পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদ নিয়ে, পুরুষের আধিপত্য নিয়ে, তখন থেকেই তাঁরা জানতেন যে কেবল পুরুষ নয়, নারীরাও সামাজিক ভাবে পুরুষের মতো করেই পিতৃতান্ত্রিক চিন্তার বাহন হতে পারেন, পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী চিন্তায় আচ্ছন্ন হতে পারেন, এমন কি পুরুষের আধিপত্যবাদী মূল্যবোধ ও চিন্তার সমর্থকও হতে পারেন। শুধু তফাৎ হচ্ছে, এই সকল পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী চিন্তার সুবিধাগুলো যায় পুরুষের পক্ষে, নারী নয় বরং পুরুষ আর পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোই লাভবান হয় গোটা ব্যবস্থাটির মাধ্যমে। সেজন্যেই পিতৃতান্ত্রিক শোষণব্যবস্থা বদলের জন্যে সবার আগে আসলে বদলে ফেলা দরকার আমাদের নিজেদেরকে। আর এই বদলে ফেলার জন্যে দরকার আমাদের সচেতনতার স্তরকে আরও বেশী উন্নত করে তোলা, শাণিত করে তোলা।

বিপ্লবী নারীবাদী সচেতনতা গড়ে তোলার জন্যে তাই সবার আগে প্রয়োজন পিতৃতন্ত্রকে বোঝা, এর শোষণমূলক ব্যবস্থাকে বোঝা, পিতৃতান্ত্রিক শোষণ কী করে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠলো সেটা বোঝা, কী করে এটা আক্রান্তকারী, দখলদার হয়ে উঠলো আর কী করেই বা সে তার এই দখলদার চরিত্রের এক রকমের চিরস্থায়িত্ব অর্জন করলো সেটা বোঝা। প্রাত্যহিক জীবনে কীভাবে পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদ আর পুরুষাধিপত্য উপস্থিত থাকে তা বোঝার চেষ্টা আমাদেরকে সচেতন করে তোলে পিতৃতান্ত্রিক শোষনের বিষয়ে, সচেতন করে তোলে কীভাবে এই ব্যবস্থা আমাদেরকে আক্রান্ত করে, শোষণ করে।

সমকালীন নারীবাদী আন্দোলনের শুরুর দিনগুলোতে, নারীবাদী সচতনতা গড়ে তোলার সংগঠনগুলো অংশগ্রহণকারী নারীদের জন্যে এক রকমের দুঃখ – ক্রোধ উগড়ে দেয়ার স্থানে পরিণত হয়েছিলো। নারীরা সেখানে জড়ো হতেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে, তাঁদের আক্রান্ত হবার কথা বলতে। আর এইসব বলার মধ্য দিয়ে তাঁরা কেবল তাঁদের ভয়ংকর ক্রোধ আর বিদ্বেষ উগড়ে দিতেন, কিন্তু তাঁদের এই সকল প্রকাশের মধ্যে থাকতো না এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়, থাকতো না এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার, পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে কোনো প্রশ্ন এমনকি এই ব্যবস্থাকে বদলে দেয়া বা রুপান্তরেরও কোনো প্রশ্ন থাকতো না, থাকতো কেবল ফুঁসে ওঠা ক্রোধ আর ভয়ংকর বিদ্বেষ।

প্রাথমিক পর্যায়ে, অনেক নিপীড়িত ও শোষিত নারী এই সকল নারীবাদী সচেতনতা গড়ে তোলার সংগঠনগুলোকে অনেকটাই ব্যবহার করতেন এক রকমের “নিরাময়কেন্দ্র” হিসাবে। এই সংগঠনগুলো ছিলো অংশগ্রহণকারী নারীদের সকল বেদনা আর গভীর ক্ষতকে মেলে ধরার যায়গা। এসব সম্মিলনীতে এসে নিজের বঞ্চনার কথাগুলো খোলামেলাভাবে তুলে ধরার আর আলোচনা করার মাঝে যেনো এক ধরনের নিরাময় ছিলো। এখান থেকে সচেতনতা গড়ে তুলে এই সকল নারীরা সক্ষম হয়ে উঠতেন পিতৃতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, সাহস অর্জন করতেন পিতৃতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, সচেতনতা গড়ে তোলার এই সকল কাজের শুরুটা হচ্ছে সেই সকল চিন্তার ব্যবচ্ছেদ করা যা এই পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদের জন্ম দেয়, এর পরের ধাপ হচ্ছে এই সকল চিন্তাকে বদলে দেয়ার কৌশল নিয়ে কাজ করা, ঠিক কোথায় কোথায় আমাদের চিন্তার বদল ঘটানো দরকার এবং কীভাবে নারীবাদী রাজনীতির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা। মূলত সচেতনতা গড়ে তোলার এই দলগুলো ছিলো নারীদের জন্যে এক ধরনের আত্ম রূপান্তরের যায়গা, নিজেকে বদলে নেয়ার পাটাতন।

একটা গণভিত্তিক নারীবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে নারীদের সংগঠিত হওয়াটা দরকারি। সচেতনতা গড়ে তোলার এই সকল সম্মিলনী সাধারণত হতো কারো বাড়িতে (প্রকাশ্য স্থানের বদলে বরং কারও বাড়িতে, ভাড়া বাড়িতে কিংবা কারো দান করা বাড়িতে)। এই সম্মিলনীগুলোই ছিলো প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নারীবাদীদের হাত ধরে নতুন নারীবাদীদের গড়ে ওঠার যায়গা। এই ধরনের অনেক আড্ডা ও সম্মিলনীতে নীতিগতভাবেই সকলের কথা সমানভাবে শোনা হতো। অংশগ্রহণকারী নারীরা একে একে কথা বলতেন এবং নিশ্চিত করতেন যেনো ইচ্ছুক সকলেই কথা বলতে পারেন। এই ধরনের আলোচনা চক্রগুলোতে খুব স্বাধীন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো, কোনো নির্দ্দিষ্ট নেতৃত্ব বা পৌরহিত্যভিত্তিক কাঠামো অনুসরণ করা হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিতর্কের সূচনা করা হতো সকলেই অন্তত একবার কথা বলার, নিজের বক্তব্য দেয়ার পরেই। আমাদের সেই সকল আলোচনা চক্রগুলোতে খুব চড়া তর্কবিতর্ক হতো প্রায়শই, কেননা এই ধরনের তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের বোঝাপড়াগুলোকে ঝালাই করে নিতাম, এই সব তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে পুরষাধিপত্য বিষয়ে সকলের মাঝে একটা সাধারণ বোঝাপড়া গড়ে তোলার চেষ্টা ছিলো। শুধুমাত্র আলোচনা আর ভিন্নমতের মধ্য দিয়েই আমরা সমাজে বিদ্যমান লৈঙ্গিক শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের একটা বাস্তব অবস্থান নির্ধারণ করতে পারতাম।

সত্তুরের দশকের একটি নারীবাদী সচেতনতা চক্র

গোড়ার দিকে নারীবাদী চিন্তার শুরুটা হয় ছোট ছোট দলের মধ্যে, যে দলগুলো মূলত ছিলো জানাশোনা মানুষদের মধ্যেই সীমিত, এবং এরা ছিলেন একে অপরের পরিচিত, সহকর্মী কিংবা বন্ধু স্বজন। এই চিন্তাগুলো খানিকটা তাত্ত্বিক রূপ নিতে শুরু করে প্রকাশনার মধ্য দিয়ে, প্রধানত আরও বড় অংশের মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্যে, এরপর এই দলগুলো ভেঙ্গে গিয়েছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্যান্য বিদ্যায়তনে নারী বিষয়ক বিদ্যায়তনিক শিক্ষার প্রবর্তনের নারীবাদী চিন্তা ও নারীবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে জানার আরেক ধরনের প্রেক্ষিত ও সুযোগ তৈরি হলো। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে Gender Studies এর মতো নারী বিষয়ক অধ্যয়নের এই সকল বিষয় খোলার ক্ষেত্রে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের একটা বড় অংশই ছিলেন বিপ্লবী সক্রিয়তাবাদী, নাগরিক অধিকার, সমকামীদের অধিকার ও প্রথম দিককার নারীবাদী আন্দোলনের সংগ্রামী কর্মী। এঁদের অনেকেরই পিএইচডি ডিগ্রি ছিলো না, ফলে এরা এই সকল বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁদের অন্যান্য বিষয়ের সহকর্মীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বেতনে যোগ দিয়েছিলেন, অন্যান্য সহকর্মীদের তুলনায় এদের কর্মদিবস ছিলো অনেক দীর্ঘ।

আমরা জানতাম বিদ্যায়তনে নারীবাদী চিন্তার চর্চা জরুরি, এ বিষয়ে অধ্যয়ন এবং অধ্যয়ন শেষে ডিগ্রী অর্জন জরুরি, ইতিমধ্যেই এর স্বপক্ষে তরুণতর স্নাতকেরা যোগ দিলেন এই দাবির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্যে। বিদ্যায়তনে নারী অধ্যয়নের এই সকল বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করাটা আমাদের অধিকাংশের জন্যেই ছিলো এক ধরনের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক সক্রিয়তার অংশবিশেষ, বিদ্যায়তনে নারীবাদী অধ্যয়নের একটা ভিত্তিভূমি তৈরি করার জন্যে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলাম।

সত্তুরের দশকের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন বিদ্যায়তনে পাঠের বিষয় হিসাবে Gender studies কিংবা women studies এই বিষয়গুলো গৃহীত হতে শুরু করেছে। কিন্তু বিদ্যায়তনে নারী অধ্যয়নকে বিষয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার এই বিজয় চাপা পড়ে গিয়েছিলো আরেকটি করুণ বাস্তবতার নিচে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন বিষয় হিসাবে নারী বিষয়ক অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তখন যে সকল নারীরা এই সংগ্রামের অগ্রণী ছিলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়গুলো পড়ানোর পথ করে দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই চাকুরি থেকে ছাঁটাই হতে হয়েছিলো শুধুমাত্র তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির কারণে, তাঁদের ডিগ্রীটি ছিলো মাস্টারস, পিএইচডি নয়।

আমাদের মাঝে কেউ কেউ আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়েছিলাম পিএইচডি ডিগ্রী নেয়ার জন্যে, কিন্তু আমাদের দলের দারুণ উজ্জ্বল ও মেধাবীদের অনেকেই তা করে উঠতে পারেননি, একদিকে পেশাগত ব্যস্ততার ভীষণ ক্লান্তি, আর অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁদেরকে ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট করে তুলেছিলো, তাঁরা ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন, কী করবেন আর কী করা উচিৎ সে বিষয়ে, আর একই সাথে ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে দেখলেন যে বিপ্লবী ও আমূল পরিবর্তনকামী চেতনার নারী অধ্যয়ন কী করে উদারনৈতিক সংস্কারবাদ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হলো।

সহসাই, নারীবাদী ছোট ছোট দলগুলোর জায়গা দখল করে নিলো নারী অধ্যয়নের এই সকল ক্লাসরুমগুলো। বিচিত্র প্রেক্ষিত থেকে আসা নারীরা, যারা হয়তো সাধারণ গৃহস্ত্রী, সাধারণ চাকুরীজীবী কিংবা কোনো ব্যস্ত পেশাদার কর্মী, এদেরকে হয়তো নারীবাদী চেতনা চর্চার ছোট ছোট চক্রগুলোতে পাওয়া যেতো, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়ে গেলো কেবল অভিজাত ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির মানুষদের জন্যেই।

অভিজাত শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত নারীরা, সংখ্যাগত দিক থেকে যারা ছিলেন মূলধারা, যদিও বিপ্লবী নারীবাদী চিন্তা ও আন্দোলনে এঁদের ভূমিকা খুব নেতৃস্থানীয় ছিলো না, তবুও এরাই হয়ে উঠলেন নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যমনি, মূল কেন্দ্রীয় মানুষ, কেননা এই দলটির প্রতিই ছিলো সব ধরনের গণমাধ্যমের আগ্রহ, এদেরকেই গণমাধ্যমগুলো নারীবাদীদের সংগ্রামের প্রতিনিধি হিসাবে আগ্রহের সাথেই উপস্থাপন করতো।

নারীবাদী আন্দোলন যখন থেকে মূলধারার আগ্রহের কারণ হয়ে উঠলো, তখন থেকে হঠাৎ করেই বিপ্লবী চেতনার নারীবাদীরা, যাঁদের অনেকেই ছিলেন সমকামী কিংবা শ্রমিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা নারী, তাঁরা তাঁদের দৃশ্যমানতা হারাতে শুরু করলেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণবাদী ও বাণিজ্যিক চরিত্রের কারণেই মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন নারী অধ্যয়নের এই বিষয়গুলোর অবস্থান পাকাপোক্ত হলো ততদিনে এইসকল বিপ্লবী নারীবাদীদের হারিয়ে যাওয়াটা মোটামুটিভাবে সম্পন্ন হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট বা বিভাগগুলো যখন নারীবাদী সচেতনতা গড়ে তোলার এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে নারীবাদী আন্দোলনের কৌশলকে ছড়িয়ে দেয়ার ছোট ছোট দলগুলোর অবস্থান দখল করলো তখন থেকেই নারীবাদী আন্দোলন তার গণভিত্তি হারাতে শুরু করলো।

হঠাত করেই বহু নারী হয় নিজেদেরকে নারীবাদী বলা শুরু করলো, নয়তো নারী-পুরুষের বৈষম্যের কথা বলে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি করার চেষ্টা শুরু করলো। নারীবাদ বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার এই সব সুযোগ হঠাত করেই শ্রমবাজারে অনেক চাকুরির সৃষ্টি করলো, বিদ্যায়তনিক পরিসরে ও প্রকাশনার জগত, উভয় অংশেই এই সকল চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি হলো।

পেশার জগতে এই পরিবর্তন অনেকের মাঝেই পেশাগত সুবিধাবাদের জন্ম দিলো, যে সকল নারীরা কোনোকালেই গণভিত্তিক নারীবাদী সংগ্রামের সাথে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত কিংবা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না, এমন অনেক নারীই কেবল নিজেদের নারীবাদী বলে কিংবা নারীবাদী বুলি আওড়িয়ে নিজেদেরকে একটু জাতে তোলার চেষ্টা করতে শুরু করলো। নারীবাদী সচেতনতা গড়ে তোলার এই দলগুলোর ভেঙ্গে যাওয়া এই ধারণাটি প্রায় মুছে দিয়েছিলো যে নারীবাদী হওয়াটা একটা সচেতন সিদ্ধান্ত, নারীবাদী হতে হলে, আগে নারীবাদ বিষয়টিকে বুঝতে হবে, এর রাজনীতিটাকে বুঝতে হবে, তারপরে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নারীবাদী রাজনীতিকে গ্রহণ করার, একজন নারীবাদী রাজনীতির সমর্থক হয়ে ওঠার।

নারীবাদী সচেতনতামূলক দলগুলো, যেখানে নারীরা মূলত নিজেদেরই ভেতরের নানান পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও অনুশীলনগুলোকে আবিষ্কার করতে পারতেন, অন্যান্য নারীদের সাথে তুলনামূলক ভিন্নমত, বিরোধগুলোকে আবিষ্কার করতে পারতেন, এই সংগঠনগুলোর অভাবে নারীবাদী সংগ্রাম কেবল পুরুষের সাথে সমান অধিকার ভাগাভাগি করা আর পুরুষাধিপত্যকে প্রতিরোধ করার মতো সংস্কারপন্থী সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হতে শুরু করে।

লিঙ্গভিত্তিক সমতার ক্ষেত্রে নারীকে ক্রমাগতভাবেই একজন “ভিক্টিম” বা শিকার হিসাবে দেখানোর প্রবণতার ফলে নারীকে এর ক্ষতিপূরণের দাবিদার হিসাবে হাজির করা হয় (সেটা বৈষম্য সৃষ্টিকারী আইনগুলোর সংশোধনের মাধ্যমে হোক আর নানান ধরনের সদর্থক নীতিগত পরিবর্তন করেই হোক), কিন্তু এই ধরনের নারীবাদী অর্জনের জন্যে প্রথমে এই ধারণাটির নিজের ভেতরের পিতৃতান্ত্রিক উপাদানগুলোকেই মোকাবিলা করা দরকার।

প্রায় সকল বয়সের নারীদের “নারীবাদী” হয়ে ওঠার জন্যে যেনো কেবল পুরুষাধিপত্য কিংবা সমান অধিকার নিয়ে কথা বলাটাই যথেষ্ট, এ নিয়ে ক্ষোভ – রাগ দেখানোটাই যথেষ্ট। বাস্তবত নিজের ভেতরের পিতৃতান্ত্রিক উপাদানগুলোর মোকাবিলা না করে যে সকল নারী নারীবাদের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নেন, তাঁরা প্রায়শই তাঁদের কর্মকাণ্ড দিয়ে নারীবাদের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের প্রতি, অন্যান্য নারীদের প্রতি বেঈমানীই করেন।

নারীবাদী সংগ্রামের শুরুর দিকে যে রাজনৈতিক “ভগ্নীত্ববোধ” বা রাজনৈতিক সংহতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, আশির দশকের দিকে এসে এই সংহতিবোধ তার অর্থ হারাতে শুরু করলো, এই সময় থেকেই নারীবাদের এক নতুন ধরনের ধারণা বা সংজ্ঞা তৈরি হতে শুরু করে যাকে বলা হচ্ছিলো “Lifestyle feminism” বা এক ধরনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাভিত্তিক নারীবাদ। এই ঘরানার নারীবাদ বলে যে যেকোনো নারীই নারীবাদী হতে পারেন, সে তার রাজনৈতিক মতামত বা আস্থা যাই-ই হোক না কেনো। বলাই বাহুল্য যে নারীবাদের এই ধরনের বোঝাপড়া নারীবাদী চেতনা, এর তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অনুশীলনকেই খাটো করেছে।

নারীবাদী আন্দোলন যখন আবারো নিজেকে নবায়িত করবে, যখন পিতৃতন্ত্র ও এর লিঙ্গবৈষম্যবাদী নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্যে নারীবাদ যখন তার সংগ্রামের কৌশলকে আরও শাণিত করবে, পিতৃতান্ত্রিক শোষণের হাত থেকে যখন সকলকে মুক্ত করতে চাইবে, তখন এই সকল ছোট ছোট নারীবাদী সচেতনতা চক্রগুলো আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, এই সকল দল কিংবা সংগঠনগুলো আবারও তাঁদের নিজ মহিমা ও গুরুত্ব নিয়ে হাজির হবে আমাদের সম্মুখে। অনেকটা আমেরিকার “AA” এর আদলে আবারও হয়তো নারীবাদী সংগঠনগুলো আবারো তাদের কাজ শুরু করবে, নারীবাদী বক্তব্যগুলো ছড়িয়ে দেবে সকল মানুষের কাছে, শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে সকল মানুষের কাছেই পৌঁছে দেবে নারীবাদের মূল কথাগুলো।

বিপ্লবী আন্দোলনের জন্যে পুরুষের মাঝে নারীবাদী সচেতনতা গড়ে তোলাটা সমান গুরুত্বপূর্ণ ঠিক যতটা গুরুত্বপূর্ণ নারীদের মাঝে এই সচেতনতা গড়ে তোলা। ছেলেদের বা পুরুষদের মাঝে যদি এই ধরনের সচেতনতা গড়ে তোলা যেতো যে লিঙ্গবৈষম্যবাদী নিপীড়ন কী বা কীভাবে এটা নারীকে আক্রমণ করে, বঞ্চিত করে, তাহলে মূলধারার মিডিয়াগুলোর পক্ষে সম্ভব হতো না নারীবাদী আন্দোলনকে “পুরুষ বিদ্বেষী” হিসাবে উপস্থাপন করতে। পুরুষদের মাঝে এই সচেতনতা গড়ে তোলা গেলে তা নিজেই নানান ধরনের নারীবাদ বিরোধী পুরুষ সংগঠনগুলোকে গড়ে উঠতে বাধা দিতো। এই সকল নারীবাদ বিরোধী পুরুষদের সংগঠনগুলো প্রায়শই গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ের নানান ধরনের নারীবাদী সংগঠনের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া হিসাবে। যেমন “লাইফ স্টাইল ফেমিনিজম” ধরনের এই গ্রুপগুলো এমন সব নারীদের টার্গেট করে যারা পিতৃতন্ত্র বা পিতৃতান্ত্রিক শোষণমূলক ব্যবস্থাকে আক্রমণ না করে কেবল পুরুষের নানান বিষয় আশয় নিয়ে সমালোচনা করে।

ভবিষ্যতের নারীবাদী আন্দোলন এই ভুল করবে না। ছেলেদের জন্যে এবং পুরুষদের এমন প্রেক্ষিত দরকার যেখানে পিতৃতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকেও স্বীকার করা হবে, মূল্যায়ন করা হবে। পুরুষদের সহযোদ্ধা হিসাবে পাওয়া ছাড়া নারীবাদী সংগ্রাম এগুবে না। নারীবাদ হচ্ছে “পুরুষ বিদ্বেষ” এই মানসিক ধারণাটি সাংস্কৃতিকভাবে এতো গভীরভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেছে আমাদের মাঝে যে এটাকে ভাঙ্গার জন্যে একটা পর্বত সমান কাজ করতে হবে আমাদেরকে।

নারীবাদ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে। যে পুরুষ নিজের পুরুষ আভিজাত্যবোধ ত্যাগ করতে পেরেছে, যে নারীবাদী রাজনীতিকে আলিঙ্গন করতে পেরেছে, তিনি নারীবাদীদের সহযোদ্ধা “কমরেড”, তিনি কোনোভাবেই নারীবাদের জন্যে হুমকি নন, আবার অন্যদিকে যে নারী এখনো পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে, আচার আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে আছেন, বরং তিনিই নারীবাদী আন্দোলনের জন্যে ভয়ংকর হুমকি।

নারীবাদী সচেতনতা চক্রগুলোর সবচাইতে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো নারীবাদীদের মাঝে তাদের অন্তর্গত পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার দাবি তোলা, পিতৃতন্ত্রের নানান প্রথার প্রতি তাদের আনুগত্যকে চ্যালেঞ্জ করা, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং তাদের প্রতিশ্রুতির নারীবাদী রুপান্তর ঘটানো। নারীবাদী চক্রগুলোর এই ভূমিকা এখনও জরুরি।

যারা নারীবাদী রাজনীতির প্রতি আগ্রহী, তাদের সকলের জন্যেই এটা জরুরি। এই সংগ্রামে বাইরের শত্রুর সাথে লড়াইয়ের আগে আমাদের ভেতরের শত্রুকে, আমাদের মনোজগতের রুপান্তর ঘটাতে হবে সবার আগে। এই শত্রু এই হুমকি হচ্ছে আমাদের নিজেদের ভেতরের পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী চিন্তা এবং আচরণ। নিজেদের ভেতরের এই গহীন সঙ্গোপন পিতৃতান্ত্রিকতাকে মোকাবিলা না করে নারীবাদীরা যতই নারীবাদের পতাকা তুলে ধরুন না কেনো, সেই সংগ্রাম ব্যর্থ হতে বাধ্য।

নোটস

… AA আমেরিকার পানাসক্ত মানুষদের সাহায্য করার একটি সামাজিক সংগঠন, যারা খুব ব্যক্তিগত পরিসরে মানুষ কে সাহায্য করে থাকে।
… আমি জেনেছি ইংরাজী “Gender Studies”, “Women Studies” এই শব্দগুলোকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরাজিতেই রেখে দেয়া হয়েছে, বাংলা করা হয়নি, তাই এই লেখাতেও ইংরাজিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
… কয়েকটি শব্দ যেমন “Power Feminism”, “Lifestyle feminism” এর যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ পাইনি, তাই এই শব্দগুলোই রেখে দিয়েছি।

শেয়ার করুন: