এই সন্তানহারা মাকে কী বলে সান্ত্বনা দেই!

সুপ্রীতি ধর:

নিচে ছবির মা’টাকে একবার দেখেন, কী মনে হয়? সন্তানহারা এক মা পাগলের মতোন প্রলাপ বকছে সবার সাথে, একই কথা বার বার বলছে। চিরাচরিত সেই বর্ণিল সাজ নেই, কপালে বড় টিপ নেই, চোখে কাজল নেই, হাতে গলায় মালা বা চুড়ি নেই, পাট করে পরা নেই শাড়ি।
সাদা থান পরা এ কোন নারী? ধানমন্ডি লেকের ধারে বাঁধানো নোংরা সিঁড়িতে বসে লেকের ধার ঘেঁষে বাস করা কিছু ছেলেপিলেকে জড়িয়ে ধরে আছে সে, যেন ওদের ওই হাত দুটি তারই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের হাত। কারণ এই হাতগুলো দিয়ে ওরা এই মায়ের বুক খালি করে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের হাতটি শেষবারের মতোন ধরেছিল। বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। তাই সে বার বারই ওদের কাছে সেদিনের সেই গল্পটি শুনতে চাইছে, এই শোনার মাঝেই সে সান্ত্বনা পাচ্ছে হয়তো! সে ধরে আছে, যেন হারানো ঋদ্ধকেই সে ধরে আছে।

ভাবতে পারছেন একবারও? বুকের ভেতরটা খান খান হয়ে যাচ্ছে না আপনাদের? আপনিও যদি মা হোন, আপনার নাভিমূলে প্রচণ্ড একটা ব্যথা অনুভব করছেন না? আপনি যদি পিতা হোন, আপনারও সর্বস্ব হারানোর অনুভূতি হচ্ছে, জগৎ অন্ধকার হয়ে আসবে চারপাশ থেকে।

আমার হচ্ছে। ঋদ্ধ আমার পেটের সন্তান নয়, জন্ম আমি দেইনি। কিন্তু ও বড় হয়েছে সেই সাত বছর বয়স থেকে আমার চোখেরই সামনে। সেই ফুটফুটে পুতুল পুতুল বাবুটা একটু একটু করে শরীরে বড় হচ্ছিল। আমরা দুই বাসা (একতলা নিচে-ওপরে) একাকার হয়ে মিলেমিশে থেকেছি প্রায় দশটা বছর। কখন আমাদের ছেলেদের গলার স্বরে পরিবর্তন আসলো, কবে গালে খোঁচা খোঁচা গোঁফ জন্মালো, কবে তাদের লজ্জাবনত হাসি দেখে ঠাট্টা তামাশা করেছি আমরা একইসাথে। আজ এই খবরটাতে তাই আমিও নি:শেষিত প্রায়। দূরদেশে বসে কেবলই মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে আমি যদি এই নি:স্ব মা’কে বুকে জড়িয়ে থাকতে পারতাম!

তৃষ্ণা যখন বলে উঠে, ‘দিদিরে, আমার সতের বছরের জার্নি শেষ হয়ে গেল’! ভিতরটা আমারও একেবারে শূন্য হয়ে যায়। এই জার্নিটা যে আমারও চেনা, এই খানাখন্দের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কতশত বার রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি আমরা দুজনই, সেতো আমাদের জানা! আমার ঘরের সোফায় বসে জানালা দিয়ে চাঁদ দেখা যায়, আমরা দুই মা বসে একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরে সেই চাঁদের আলো বা অন্ধকারে নিজেদের একাকি জীবনের ভার লাঘব করার চেষ্টা করেছি, কখনও গলা ছেড়ে গান গেয়েছি। সবই তো একসাথে, একজোট হয়ে। সেই একটা মা আজ আরও একা হয়ে গেল, ওর মনের ভেতর কী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, আমি তা জানি।

হৃদয়ঙ্গম ঋদ্ধ। কী সুন্দর নাম, যেমন ছেলে তেমনি তার নাম। ছোটবেলায় নাম জানতে চাইলে বলতো, হৃদগমগম ঋদ্ধ। আমরা হাসতাম। নামের কারণেই হোক, আর কর্মের কারণেই হোক, সে মাত্র সতের বছরেই তার সতীর্থ, বন্ধু বা ছোট ছোট শিশুদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। হ্যাঁ নিয়েছিলই বলতে হচ্ছে এখন। সেই বন্ধুরা এখন কাঁদছে। যে মেয়েটিকে ঋদ্ধ পছন্দ করতো, কিন্তু কোনদিন বলা হয়নি সেকথা, সেই মেয়েটিও অঝোর ধারায় কাঁদছে প্রিয় বন্ধুর জন্য। কাঁদছে ছোটবড় সকলেই। শিক্ষক-শিক্ষিকারা। নালন্দা স্কুলের বাচ্চারা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভিন্নভাবে বেড়ে উঠে। ঋদ্ধরাও তাই ভিন্ন। ওর বাচ্চা বয়স থেকেই ছবি আঁকায় যে পারদর্শিতা, তা দেখে মুগ্ধ না হওয়ারই কোনো উপায় নেই। ঋদ্ধর আঁকা ছবি ছাড়া স্কুলটির অনুষ্ঠান হতো না। এই বয়সেই অসম্ভব লিডারশিপ ক্ষমতা ছিল ছেলেটির। আজ তাই ছোটবড় সবার মনে এই হারানোর বেদনা বড়বেশি করে বাজছে।

আর মায়ের কান্নায় কাঁদছে মায়ের বন্ধুরা, আন্দোলনের সাথীরা। গত দুদিন ধরে আমাদের অনেকের জীবন স্থবির হয়ে গেছে, ভিতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। ঘুমাতে গেলেই ঋদ্ধ চলে আসে, তৃষ্ণা চলে আসে, চলে আসে ঋদ্ধর রেখে যাওয়া পিঠাপিঠি বোন শ্রেষ্ঠা। কী করে এরা পাড়ি দিবে জীবন? কীভাবে দেয় অন্যরা, যাদের প্রিয়জন হারিয়ে যায়? বিশেষ করে এমন করুণ করে?

আমি তো দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি ঋদ্ধর বেহালা বাজানোর দৃশ্য। অনেক গভীর রাতে ওর রুম থেকে ভেসে আসতো সেই সুর।

আজ বৃহস্পতিবার সহজ পাঠ স্কুলে ঋদ্ধের উদ্দেশ্যে স্মরণসভা হয়েছিল। ওখান থেকে বেরিয়েই তৃষ্ণা ধানমন্ডি লেকের পাড়ে ওই ঘাটটিতে চলে যায় যেখান থেকে হারিয়ে গেছে ঋদ্ধ। মিতালী দাসের বর্ণনায় …

“মসজিদের পিছনে ঘাটে গিয়ে দেখি দিদিকে ঘিরে কয়েক জনের জটলা। মসজিদের আশে পাশে যে ভবঘুরে অথবা পার্কের এই অংশটিতে যারা নিয়মিত ঘোরাঘুরি করে তারা দিদিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। দিদি দুজনকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একজন হৃদয় খান অন্যজন শান্ত বিশ্বাস। তারা বর্ণনা দিচ্ছে ঋদ্ধকে কীভাবে দেখেছে”।

“বৃষ্টিতে মসজিদের দরজায় শেডের নীচে কয়েকজন দাঁড়ানো ছিল (আমি নিজেও মর্নিং ওয়াক করতে এসে এই শেডে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখেছি)। গেট দিয়ে ঋদ্ধ ঘাটলায় এসে হাত-পা ধুতে গিয়ে পিছলে পড়ে ভিজে যায়। তারপর ঘাটলায় বসেই বাঁশী (হারমোনিকা) বাজাতে থাকে। হঠাৎ করে তিনটা ছেলে (১০/১২) বছরের
একই গেট দিয়ে এসে পানিতে নামে। ওদের সাথেও ঋদ্ধ কথা বলেছিল। হঠাৎ করেই ওর জুতা পানিতে পড়ে যায়। পাশ থেকে একজন বলে…. আপনার জুতা পানিতে পড়ে গেছে। জুতা তুলতে আরো একটু নেমে গিয়ে জুতা তোলে, তুলে পকেটে গুঁজে। ততক্ষণে ওই তিনজনের একজন/দুজন সাঁতার কাটতে নেমেছে এবং বাচ্চাদের সাথে ওর ভাব হয়ে গেছে। বাঁশী (মাউথ অর্গান) বাজানো থামিয়ে সেও বাচ্চাদের সাথে সাঁতরাতে থাকে। (এই বর্ণনা লেখা আমার জন্য খুবই ক্লান্তিকর)। অর্ধেকের বেশি গিয়ে “বাঁচাও বাঁচাও” বলে চিৎকার শুরু করে। ছোট বাচ্চাগুলো হাসাহাসি করছিল, ভেবেছিল মজা করছে। পরে বুঝতে পেরে দ্রুত পাড়ে আসে আর চলে যায়। হৃদয় আর শান্ত পাড়ে গাছের নীচে বসে ছিল। ওরা পানিতে ঝাঁপ দেয়। টেনে তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু ঋদ্ধ ক্রমশ ডুবে যায়।

ঋদ্ধ ডুবে যায় হৃদয় আর শান্তের সামনে। ঋদ্ধ হারিয়ে যায় মসজিদের দরজায় শেডের নিচে দাঁড়ানো লোকগুলোর সামনে। ঋদ্ধ নাই হয়ে যায় ঘাটলায় ছাতার নিচে বসা একটা ছেলে আর একটা মেয়ের সামনে বাঁশী (মাউথঅর্গান) বাজাতে বাজাতে।

হৃদয় খান, শান্ত বিশ্বাস খালি হাতে ফিরে আসে। হৃদয় খান ব্রিজে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশকে জানায়। ট্রাফিক পুলিশ তাকে পাশের ফাঁড়িতে জানাতে বলে। পুলিশ ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। রাত ৮/৯ টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কাউকে খুঁজে না পেলে হৃদয় খান সাঁতার কেটে দেখিয়ে দেয় ঋদ্ধ কোথায় ডুবে গেছে। পরে তাকে তুলে এনে মসজিদের কাছে যখন শোয়ানো হয় বাম চোখের কোণা দিয়ে রক্ত পড়ছিল। লোকজন বলাবলি করছিল… এতো সুন্দর ছেলে… কার ছেলে গো…!”

তৃষ্ণা’দি হৃদয় খান, শান্ত বিশ্বাসের হাতে কপালে মাথায় হাত বুলায়, শূন্য চোখে কাঁদে আর বারবার কী ঘটেছিল শোনে। মসজিদের লোক খালাদের কাছে জানতে চায়, কে? খালারা বলে… মা। তারা দিদিকে দেখতে আসে। আর দিদি প্রলাপ বকতেই থাকে।

বল, আমার সাথে যোগাযোগ রাখবি?
তোরা আমার ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিস! আয় বাবা আয়…তুই যদি না দেখিয়ে দিতি আমার ছেলে তিন দিন পরে ভেসে উঠলে তো চিনতেই পারতাম না…”

চমকে উঠি…..
আর লিখতে পারছি না।
নতুন চশমা পড়া চোখ ঝাপসা লাগে”। …

এক দুর্ঘটনায় ঋদ্ধকে হারানোর পর থেকে আমরা ওদের পরিবারের কাছের-দূরের সবাই কমবেশি বিপর্যস্ত। এরই মাঝে আবার একদল মানুষ এই ঘটনাকে নিয়ে নানারকম গল্প তৈরি করতে সচেষ্ট, যা কিনা ঋদ্ধের বন্ধুমহল থেকে শুরু করে পরিবার সবাইকে নতুন করে শোকের সাগরে ভাসাচ্ছে। আর সেকারণেই আমাদের আরেক বন্ধু তাসলিমা মিজি লিখেছেন সবার উদ্দেশ্যে –

“ঋদ্ধর অকাল মৃত্যুতে ওর পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুরা শোকে জর্জরিত। ঋদ্ধ অনেক আবেগী ও সংবেদনশীল একজন শিশু ছিল। ওর ভিতরে বাস করতো একজন উদীয়মান শিল্পী। ওর মা তৃষ্ণা সরকার একজন শিল্পী, প্রতিবাদী, সংগ্রামী ও জনদরদী মানুষ। জীবন সংগ্রামের লড়াকু একজন মায়ের পুত্র হিসেবে ঋদ্ধ ও তার পরিবারের সকলের চলার পথ কখনো মসৃণ ছিল না। মানুষের প্রয়োজনে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়া হলো তৃষ্ণাদির চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ছেলেও মায়ের মানবিক গুণাবলীর ছোঁয়া পেয়েছিল। ছেলে হারিয়ে দিদি এখন পাগল প্রায়।

সবার কাছে অনুরোধ, শোক প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু বলবেন না বা লিখবেন না যেটা দিদির ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে পুনরায় আঘাত হানে। বন্ধুর পুত্রের অকাল প্রয়াণে শোক প্রকাশ নিতান্তই আমাদের মানবিক গুণাবলীর একটি। কিন্তু আবেগ প্রকাশে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত শব্দ চয়ন আর কল্পিত ও সময়-অনুপোযোগী বিচার বিশ্লেষণ অনাকাঙ্খিত”।

সবার প্রতি অনুরোধ, আমাদের সবাইকে এই শোক এই কষ্টটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন।

শেয়ার করুন: