শাশুড়িনামা: যে গল্প শেষ হওয়ার নয়

ইশরাত জাহান স্টেলা:

আমি জানি লেখাটি পড়ে অনেকেই (অবশ্যই বেশিরভাগই নারী) আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ইতিবাচক উদাহরণ টানবেন নিজ জীবনের। তুলনা তর্কে মেতে উঠবেন।

যাকগে, সেসব কথা। লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে হিন্ট দিই আগে। শাশুড়ি নামক ব্যক্তিটি কীভাবে যুগ যুগ ধরে একই পদে আছেন, কেন পদোন্নতি হচ্ছে না, এগুলোই বলতে চাই। যাদের পদোন্নতি হয়েছে, তারা সংখ্যায় এতোটা কমই বা কেন? একদম ঘরের মানুষগুলোর নিজের গল্পগাছা দিয়ে বলতে চাই। ও হ্যাঁ, এই ঘটনার সাথে আমার পরিচিত কারো ঘটনা মিলে গেলে বুঝে নিও বা নিয়েন যে তা অনভিপ্রেত কাকতাল নয়।

এই শাশুড়িটির পুত্রখানা দেখতে মাশাল্লাহ্। চলন-বলনও মন্দ নয়। দোষের মধ্যে একটাই, প্রেম করে বিয়ে করেও প্রেম ফুরোচ্ছে না। স্টকে প্রেমের পরিমাণ এতো বেশি যে বিলোতে শুরু করেছেন বিয়ের পর থেকে, বউ বাদে অন্যদেরও। বউটি কিন্তু উচ্চশিক্ষিত। সমাজে প্রতিষ্ঠিত নারীদের ওপরের কাতারে অবস্থান। তাতে কী? প্রতিবাদ করতে গেলে, পুত্রের পক্ষ নিয়ে তিনি (শাশুড়ি) মা-রূপে চূড়ান্ত ভূমিকায়। নিকেশ করতে চান বউটিকে। ঠিকই শুনছেন, বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে চান পুত্রবধুকে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একই ঘটনা তার সাথে তার স্বামীও ঘটিয়েছিলেন। তাই তিনিও জীবন শিক্ষাকে একইভাবে কাজে লাগালেন। বই-পত্রের শিক্ষা তারও কম ছিলো না বইকি! কিন্তু হয়ে রইলেন শাশুড়িই।

এক কাছ- সম্পর্কের বোনের শাশুড়ি নাকি বউকে ঘুম থেকে উঠে গোসল করতে দেখলে রেগে টং হয়ে যেতেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুত্রের জন্মের কিছু পরে মারা যাওয়া স্বামীহীনা নারীটির দাবি, দীর্ঘদিন স্বামী সোহাগহীনা তার অবস্থা নাকি সদ্য বিবাহিতা বউটিকেই বুঝতে হবে!

এক তুতো বোনের অভিজ্ঞতা এক কাঠি সরেস। পেশায় শক্ত অবস্থানে থাকা বোনটির শাশুড়ি তাকে বার বার মনে করিয়ে দেয় নিজ কন্যার কথা। কন্যাটি নাকি নিজ গায়ের রঙ আর পোশাক- আশাকে অত্যন্ত স্মার্ট হওয়ায় ভিনদেশী স্বামী এদেশে বসেই পেয়েছে। জেনে রাখুন, কন্যাটি স্নাতকের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি। মা’র (শাশুড়ির) যোগ্যতা না হয় তোলাই থাকলো।

সব কথায় বউয়ের বাবার গ্রামের বাড়ির ভৌগলিক অবস্থান টেনে আনা, বউয়ের শারিরীক গড়ন, গায়ের রঙের কথা উল্লেখ করার কাজটা গর্বের সাথেই করেন শাশুড়িরা। সেসবে সমর্থন আছে অধিকাংশ বউয়েরও। কারণ যুগ যুগ ধরে একই কাজ তারাও করছেন, যখন শাশুড়ি হচ্ছেন। ওই পদে গিয়ে গুণগুলো আহরণ করেন সহজাত প্রবৃত্তিতে।

নিজের কন্যা থাকলে তো কথাই নেই। সে অপদার্থ হলে আরো যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠেন কোনো কোনো শাশুড়ি। বউয়ের গুণগুলো হয়ে যায় ছাইপাশ। কিন্তু মনের অজান্তেই বউটির মতোই মেয়েটিকে গড়ে তুলতে চান। ভুলেও অবশ্য মুখে বলেন না। যদি পদ হারান!

খুব চুপচাপ শান্ত, জীবন যুদ্ধে পরাজিত নারীটিও শাশুড়ি হয়ে পদের যথাযথ ব্যবহার করেন। একই বাড়িতে দু’টি বউ এলে তার সমর্থন স্বাভাবিকভাবে যায় শিক্ষাসহ সবগুণে পিছিয়ে থাকা বউটির দিকে। তিনি হয়ে ওঠেন চুলচেরা বিচারে দক্ষ। শার্লক হোমসের গুণেরও দেখা মেলে তার মাঝে। ইনিয়ে-বিনিয়ে ভালো থাকতে চান নিজের সন্তানের কাছে।

মুমূর্ষু অবস্থায়ও মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না যোগ্যতা সম্পন্ন বউটির একমাত্র দুর্বলতার কথা। ছেলে ও বউয়ের সম্পর্কের রসায়নের তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। করবেনই তো, ইতিকথা বলে, নিজ বাবার বহু বিবাহে তার ও তার মায়ের নাভিশ্বাস ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। সেসব কথা একবারও মনে করে নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করেননি এই শাশুড়ি। তাই পদোন্নতির প্রশ্নই ওঠে না। (এটিও একটি সত্য ঘটনা)

কেবল নারীদেরই দায় নয় শাশুড়ির পদোন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করার। অবশ্যই পুরুষেরও এক্ষেত্রে অনেক দায় রয়েছে। সেটা না হয় অন্য লেখার জন্য তোলা থাকলো। তবে শাশুড়ির পদোন্নতি ঘটানোর জন্য মেয়েরা এগিয়ে আসুন সবার আগে। মাকে বোঝান, তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সাহায্য করুন। আর বউ হয়ে যাবার পর, নিজে হয় প্রতিবাদ করুন, নয় ইতিবাচক অভিজ্ঞতা জমা করুন। নিজে শাশুড়ি হয়ে গেলে, জীবনের ঝালগুলো বউয়ের ওপর না ঝেড়ে আত্মিক উন্নতি ঘটান। তবেই মিলবে পদোন্নতি। নয়তো বান্ধবীর মতো শাশুড়ি হবার বা পাবার স্বপ্ন অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ ছবিতেই সীমাবদ্ধ রাখুন, আর হাপিত্যেশ করুন। পদোন্নতি নাগালের বাইরেই থাকবে। শেষ হবে না শাশুড়িনামা।

১২ই সেপ্টেম্বর ২০১৮

শেয়ার করুন: