রামায়ণে অকালবোধন কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব

সাজু বিশ্বাস:

শরৎকাল ঋতু হিসেবে বেশ চমৎকার। পরিস্কার নীল আকাশে মোচার খোলার মতো ছোট ছোট নীল নীল খণ্ড মেঘেরা ভেসে বেড়ায়। জলজ -সাদা- গন্ধওয়ালা বুনো ফুল ফোঁটে এই সময়।
কিছুদিন আগের বৃষ্টিতে গাছের পাতাগুলো ধুয়ে মুছে ঝকমকে সবুজ হয়ে উঠেছে। কোনও কোনও গাছে নতুন নতুন পত্রপল্লব।

এইরকম প্রাকৃতিক প্রশান্তির সময় যদি একটা উৎসবও সামনে চলে আসে, তাহলে তো আর কথাই নেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শুরু করে অক্টোবর নভেম্বর ডিসেম্বর পর্যন্ত শরৎকাল চলে। গ্রীষ্মের পরে আস্তে আস্তে শীতের বরফে প্রকৃতি ঢেকে যাওয়ার আগে শীত আসার পূর্বাভাসের এই সময়ের নাম শরৎকাল। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে শরৎকাল হলো আধা সবুজ- হলুদ- জাফরান- লাল রঙের ম্যাপল পাতা ঝরার সময়। ঘোরাঘুরির জন্য বেশ চমৎকার আবহাওয়া থাকে এই সময়।

অনলাইনের বড় বাজারে বেশ হৈচৈ দেখছি আসন্ন শরৎ উৎসব ঘিরে। বাঙালির শারদীয় উৎসব মানে দুর্গাপূজা। আজকাল অবশ্য ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে আরেকটা শরৎ উৎসব এসে গেছে। নদীর তীরে গিয়ে কাশবনের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে শরতের আমেজ পেতে চায় সৌখিন নগরবাসী মানুষ। একবেলা – আধাবেলা, জীবনের কঠিন কঠিন সমস্যা একপাশে ফেলে রেখে মানুষের এই সামান্য আনন্দ কুড়ানোর আয়োজন দেখতে ভালোই লাগে।

শারদীয় দুর্গোৎসব নিয়ে একরকম চোরকাঁটা বিঁধে আছে কোথাও কোথাও। চার দিনের পূজার ছুটি একদিন বলে কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পর ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভা বাজারের রাজ বাড়িতে জমিদার নবকৃষ্ণ দেব ইংরেজদের সম্বর্ধনা দেবার জন্য প্রথম এই পূজার আয়োজন করেছিলেন বলে বিরাগভাজন হয় কেউ কেউ।

আদতে এগারো শতকের দিকে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি অভিনির্ণয় লিখতে গিয়ে দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দেবী দুর্গার বেশ বন্দনা করেন। তবে বিদ্যাপতির দুর্গা বন্দনা পড়ে মানুষ দুর্গাপূজা শুরু করে দেয়, এটা হয়তো নয়।

বাংলা ভাষায় সংস্কৃত রামায়ণের অনুবাদক হলেন কৃত্তিবাস ওঝা। ১৩৮১ থেকে ১৪৩১ পর্যন্ত কৃত্তিবাসের জীবনকাল। কৃত্তিবাসের নিজের পরিচয়ের ভণিতায় তিনি বলছেন, তিনি গৌড়েশ্বরের আদেশে রামায়ণ লেখা শুরু করেন। বাংলায় তখন বেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এমনকি কৃত্তিবাস নিজেও ছোটবেলায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজশাহীর প্রেমতলী এলাকার জন্মস্থান ছেড়ে নদীয়ার ফুলিয়ায় চলে এসেছেন।

ধারণা করা হয়, কৃত্তিবাস যে গৌড়েশ্বরের কাছ থেকে রামায়ণ লেখার নির্দেশ পেয়েছিলেন তার নাম রাজা গণেশ। গণেশ ১৪১৫ থেকে ১৪১৮ পর্যন্ত বাংলার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ লিখতে লিখতেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে যায়। ১৪১৮ সালে জালালউদ্দীন মাহমুদ শাহ ক্ষমতায় এসে পড়েন। কৃত্তিবাস নতুন মুসলিম শাসককে খুশি করতে গিয়ে রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকিকে রত্নাকর দস্যুতে পরিণত করেন, যে কাহিনী মূলত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার। বা নিজাম ডাকাতের। এমনকি ইউরোপের উপকথার একচোখা দৈত্যর কাহিনীও রামায়ণে ঢুকে পড়ে।

কৃত্তিবাস আরেকটা কাজ করেন, স্থানীয় পাঁচালি ও পূজার উপাখ্যান পুরাণ থেকে রামায়ণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন।

বাংলার ঘরে ঘরে নারীরা বহুদিন ধরে অন্দরমহলের মধ্যে চণ্ডি, কালী, ষষ্ঠী, লক্ষ্মী এইসব দেবীর পূজা করে আসছে। কৃত্তিবাস কায়দা করে কালিকা পুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে দেবী দুর্গাকে নিয়ে এসে সোজা রামচন্দ্রের সামনে রেখে রামের হাতে একশো সাতটি নীলপদ্ম ধরিয়ে দিয়ে রামচন্দ্রকে পূজায় বসিয়ে দেন!

বাল্মীকি মুনি আর্য অনুশাসনওয়ালা মানুষ। তাঁর রচনা করা রামায়ণে রামচন্দ্র আগাগোড়াই যোদ্ধা এবং প্রজাপালক রাজা। কিন্তুকৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রকে করুনাময় করে বাঙালির নরম মনের উপযুক্ত করে নিজের মতো কাহিনী দিয়ে বাঙালির অন্তরের রামচন্দ্র করে তুলেছেন কৃত্তিবাস।

সাজু বিশ্বাস

রামচন্দ্র কমললোচন, মানে তাঁর পদ্মের মতন চোখ এবং একশো আটটির বদলে একশো সাতটি নীল পদ্ম জোগাড় হওয়ায় রামচন্দ্র তার তীরের ফলা দিয়ে যেই না নিজের একটা চোখ তুলে দেবীর পায়ে দেবার জন্য তীর ধরেছেন, অমনি দেবী দূর্গা তাড়াতাড়ি এসে হাজির হয়ে রামের হাত ধরে সেই অঘটন ঠেকিয়ে দিলেন। এই কাহিনির নাম বাঙালির দুর্গাপূজার অকালবোধন এবং এই কাহিনীটুকু বাংলার কবি কৃত্তিবাসের অবদান। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে অবশ্য দশেরা বা দশহেরা পালন করে দশমীর দিন, —যেদিন রাবণকে মারা হয়।

কৃত্তিবাস ত্রিমাত্রিক এবং পয়ার ছন্দে রামায়ণ লেখেন। পুরোপুরি পাঁচালি এবং সুর করে পড়ার উপযুক্ত। এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর বাল্মীকির রামায়ণ বহু বহু তফাত। কিন্তু বাঙালির মনে কৃত্তিবাসী রামায়ণ স্হায়ীভাবে জায়গা করে নেয়। বাঙালি বাল্মীকির ব্যাকরণসম্মত রামের চেয়ে কৃত্তিবাসের ভাবানুবাদ এবং নিজের মনমতো কাহিনী জুড়ে তৈরি করা কমললোচন রামচন্দ্রকে বেশি পছন্দ করে।

এই কারণে আমার ধারণা কৃত্তিবাসের অকালবোধনের জনপ্রিয়তার কারণে বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।

১৪৮০ সালের দিকে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার কংস নারায়ণ রায় এক রাজসূয় যজ্ঞ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পুরোহিত তাকে পরামর্শ দেন দুর্গাপূজা করার। সেই আমলে আট লাখ টাকা খরচ করে কংস নারায়ণ দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে বলেন, এটিই বাংলাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক দুর্গাপূজা।

এরপরে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে জমিদাররা উৎসব পালন করার জন্য এই তিন চারদিনব্যাপী দুর্গাপূজাকে পালন করেছেন। এবং আস্তে আস্তে অন্দরমহলের মধ্য থেকে বের হয়ে মা দূগ্গা বাজারের মোড়, চৌরাস্তা, বটতলা, হাটখোলার পাশে বসে গেছেন পুজো আদায় করার জন্য।

সব সময়ই মানুষ বিজেতার বন্দনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর কলকাতার বড় জমিদার নবকৃষ্ণদেব ছুঁতো খুঁজছিলেন কী করে ইংরেজদের কাছাকাছি হওয়া যায়। সেই মোতাবেক ভালো উপলক্ষও তিনি পেয়ে যান, —দূর্গাপুজা। কলকাতার শোভাবাজারে নিজের বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন করে ইংরেজদের ডেকে এনে তিনি আদর আপ্যায়ন করেন। এতে দুর্গাপুজার দোষ হবার কথা নয়। নবকৃষ্ণর কাজের ভার দেবী দূর্গা বইতে যাবেন কেন!

তবু অনেকেই এই পর্যন্ত গল্পটা বলে থেমে যান।
তাতে হয়তো কিছু রাজনৈতিক লাভালাভ হলেও হতে পারে।

এদিকে দুর্গা দেবীও বসে নেই।

১৭৯০ সালে হুগলির গুপ্তীপাড়ার বারোজন প্রতিবেশী বন্ধু মিলে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন তারপর থেকে দুর্গাপূজার নাম হয় বারোয়ারী দুর্গাপূজা।

প্রায় পৌনে দুইশো বছরের ইংরেজ শাসনের পর মানুষের মন থেকে যখন ইংরেজ মোহ ছুটে গেছে, সেই সময় দেবীদূর্গা আবার রণক্ষেত্রে আবির্ভূত হোন।
যেই ইংরেজদের স্বাগত জানানোর জন্য এক হিন্দু জমিদার দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল, সেই ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য হিন্দুরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আবার দুর্গাকে ডাকাডাকি শুরু করে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে মা দুর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

এরপরে একদিন বাঙালির ঘরে ঘরে শরৎকাল আর দেবী দুর্গা আর কাশের ফুল ঢাকের শব্দের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ঘটা করে বাঙালি হিন্দু সারা বছরের মধ্যে এই একটা উৎসব পালন করে যেখানে মণ্ডপের বাইরে কোনও জাতপাতের বাছ বিচার নাই। মণ্ডপের ভিতরে যে নিষ্প্রাণ প্রতিমা থাকে, মণ্ডপের বাইরে সব ধরনের মানুষের কোলাহলের মধ্যে সেই প্রতিমা সচল হয়ে গ্রাম থেকে গঞ্জ, শহর পেরিয়ে উৎসবের আমেজ নিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে ভালো ভালো খাবার দাবার নতুন কাপড় আর কয়েকদিনের বিশ্রামের আনন্দে মিশে যায়।

সবচেয়ে বড় যদি কোনও ভূমিকা দেবী দুর্গার থেকে থাকে, তা হলো রাস্তার মধ্যে বাঙালির জাত-পাত ছোঁয়াছুয়ির ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়া। সব রকম মানুষ সেখানে নাচন- কুদন- ঘোরাঘুরি করছে। কে ধনী, কে গরীব, কার ঘর কিবা, এই নিয়ে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।

আমি এখনো মানুষের মুখে শুনতে পাই, — বিয়ের পাত্রী দরকার, তোমার জাতের।
আমার জাত কিবা! আমি নিজেই জানি না।
দুর্গা এই জায়গায় দামি। সে কারোর জাত নিয়ে মাথা ঘামায় না। সব জাতের মানুষের সামনে সব মন্দিরে তার পূজা চলতে পারে।

শেয়ার করুন: