স্থান-কালের সাথে পরিমিতিবোধটাও জরুরি

লতিফা আকতার:

শৈশব হতে পড়ার বেশ একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। নেশার মতো। যা পাওয়া যেতো তাই পড়ে ফেলা। গল্প, উপন্যাস, ম্যাগাজিন। আর পড়ার সময় না পেলে নানান তরিকা ছিলো সময় বের করার। শীতের রাতে লেপের মধ্যে টর্চ জ্বালিয়ে বই পড়া ছিলো চরম অভিজ্ঞতা। যদিও তার আফটার ইফেক্ট খুব একটা ভালো হয়নি। উত্তম, মধ্যম পড়তে বাকি ছিলো আর কী! আমি বেচারা আসলে বুঝতেই পারিনি এটায় দোষের কী হলো!

বই পড়ার একটা গ্যাং তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের মহল্লায়। এক বই হাত ঘুরতে ঘুরতে সবার মনে শান্তি আনলেও সৌন্দর্য হারিয়ে তার অবস্থা বেহাল। দুই এক সময় পাতায় হলুদের টিপসইও উঁকি দিতো।

যাইহোক, আমার বন্ধু মিতু, তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার এর মেয়ে। আমরা উভয়ে বেশ বই আদান প্রদান করতাম। একবার ওদের বাসায় গিয়ে মারিয়া পুজোর “গডফাদার” বই চোখে পড়লো। পেপারব্যাকে ঝকঝকে দুটো নতুন বই টেবিলের উপর রাখা। পড়ার জন্য নিতে চাইলে মিতু’র উত্তর ছিলো- এটা এখন পড়া যাবে না। প্রশ্ন করলে, ও জানালো এটা এডাল্ট বই। আঠারো হওয়ার পর পড়া যাবে। তাঁর বাবা বলেছে। তখন আমরা ক্লাস নাইনে।

যাইহোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। গডফাদার আর মাথা থেকে যায় না। কী ছিলো সে বইয়ে? কতোখানি বড় হলে পড়তে হয়? নীলক্ষেতে বই কিনতে গিয়ে আবার সেই মারিয়া পুজো আমার সামনে। এখন আমি এডাল্ট এবং মোটামুটি স্বাধীন জীবন যাপন করছি। তো গডফাদারকে আর আটকানোর কেউ নেই। পড়লাম। কিছু কিছু জায়গা এডাল্ট। কাহিনী’র প্রয়োজনে, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের কারণে সে জায়গাগুলোকে আর অড মনে হয়নি। চমৎকার কাহিনী। পরবর্তীতে সেই কাহিনী নিয়ে বলিউডের নির্মিত মুভি “সরকার রাজ” দেখলাম। কিছু বিষয় উহ্য রয়ে গেলো। নতুন করে বুঝলাম- পরিবেশ বিশাল বিষয়। সব জায়গায় সব কিছু প্রাসঙ্গিক নয়। তাই একই জিনিস একটু এদিক ওদিক করে নেওয়া যায়। খুব বেশি মৌলিকতা হারায় না।

পরিবেশ, সমাজ, সংস্কৃতি একটি দেশের বহু বছরের জীবন যাপনের ফল। চাইলেই চট করে একে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এডাল্ট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলাম। এডাল্ট হয়ে এসেছি, এডাল্ট হওয়ার জন্য নয়। নয়টা পর্যন্ত গেট খোলা। সময়টাকে যে যেভাবে কাজে লাগায়। সৌন্দর্যের সেই সময়ে ভাষা ইনস্টিটিউটের বাগানের দৃশ্য আজও মাঝে মাঝে চোখে ভেসে ওঠে। কেন ওঠে এটা একজন মনোবিজ্ঞানী ভালো বলতে পারবে। একটি জুটি ছিলো- তাদের অবাধ প্রেমের জায়গা ছিলো ঐ স্থানটি। আমি বহু বছর ক্যাম্পাসে ছিলাম। এই রকম হাতে গোনা কয়েকটি জুটি ছিলো। যাঁরা ভালোবাসা’র জন্য সঠিক স্থানে না গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসকে বেছে নিয়েছিল। একান্ত কিছু বিষয় ভিন্ন পরিবেশে দেখতে কেমন লাগে তা নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা ছিলো না। বা হয়তো বুঝতোই না যে কোন পরিবেশে কোনটা মানায়!

মানানো না মানানো আসলেই একটা বিষয়। যেটা বিশ্ব সংস্কৃতির সব জায়গায়ই পরিলক্ষিত হয়। আর এর সাথে মন, শরীর সম্পৃক্ত থাকে। এর ব্যত্যয় হলে সুদূরে নেতিবাচক প্রভাব পরে। তাই দ্বাবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও, শৈশবে বাচ্চার বই পড়ার অভ্যাসের জন্য আজও আমরা কতো না টেকনিক অবলম্বন করি। ইন্টারনেট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করি। কোন কোন সাইটে শিশু ঢুকছে তা নিয়ে কিঞ্চিত চিন্তিত থাকি। আজও আমরা জানি সবকিছুর একটা সময় আছে। সবকিছুর জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ লাগে।

সময়, পরিবেশ আজ ও আমাদের ভাবায়। তাই আমরা এখনও ভাবি। একটা শিশু কন্যা যখন আপাদমস্তক ঢেকে জবুথবু হয়ে স্কুলে যায় তখন আমার কষ্ট হয়। তার গরম লাগছে বা দেখতে বিশ্রী লাগছে বলে নয়। এই ভেবে যে জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময়- তাঁর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। কিংবা যখন কোনও মৃত বাড়িতে কেউ খুব সাজগোজ করে উপস্থিত হয়, তখনও খারাপ লাগে। কেননা একটা শোকের বাড়িতে তাঁকে বেমানান লাগছে বলে নয়- বরং কারো শোককে তামাশা করা হচ্ছে বলে মনে হয়।
সবার শোক সবাইকে ছুঁয়ে যাবে, এমন না। কিন্তু উপস্থিতি এমন জানি না হয় যে অন্য মানুষের কষ্টকে গুরুত্বহীন করে তোলে। এই তোলা না তোলা আজও সমাজের কিছু মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। তাঁরা সুদূরের প্রভাব নিয়ে আজও চিন্তা করে।

জীবন- ছোট পর্দা, বড় পর্দা, অন স্ক্রিন, অফ স্ক্রিনের সমন্বয়। তাই একটা যখন আর একটার মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন কিছুটা হলেও দৃষ্টিকটু লাগে। আর এই দৃষ্টিকটু লাগা কিন্তু একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। ব্যক্তি স্বাধীনতা এক জিনিস। কিন্তু সমষ্টিগতের সাথে ব্যক্তি স্বাধীনতা মিলিয়ে ফেলাও আর একটা না বোঝার বিষয়ই হয়তো। একজন রাতের পোশাক পরে অফিসে করতে চলে আসলে সেটাকে ঠিক কেমন জানিই লাগে। আবার শাড়ি পরে কেউ যদি প্যারাগ্লাইডিং করতে যায় সেটাও শুধু বেমানানই নয়, রিস্কও।

যাই হোক, নিকট আত্মীয় পাশ্চাত্যের একটা দেশে বসবাস করে। অফিস থেকে তাঁকে লিমুজিন দেওয়া হয়েছে। বেশ ভাবসাব। সে অফিসের অধিকাংশই বাঙালি কালচার এর নয়। বাঙালি খাবারের মশলার গন্ধটা তাঁরা নিতে পারে না। কেউ খাবারের গন্ধ মাখিয়ে অফিস করতে যায় না। কিন্তু যে অভ্যস্ত নয়, তাঁর কাছে হালকা গন্ধও তীব্র লাগে। তো অন্যের যাতে সমস্যা না হয় সে জন্য খাবারের পাট চুকিয়ে তারপর রেডি হওয়া যায়। এটা ভয় নয়। ভদ্রতা। পাবলিক প্লেসে নিজেকে উপস্থাপনের তরিকা। যদিও আমরা আজও ঘরোয়া আর পাবলিক, ফরমাল আর ইনফরমাল এ ঘুরপাক খাচ্ছি।

শেয়ার করুন: