নারী স্বাধীনতা বেশি কাপড়ে, নাকি কম কাপড়ে?

দিলশানা পারুল:

‘নারীর পোশাকের স্বাধীনতা’ এই শব্দটা আমাদের মানে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে কেন স্লিভলেস বা অল্প বসনাতেই মাপা হয়, বোঝা হয় বা চাওয়া হয়, সেইটা আসলে কখনই আমার মাথায় ঢোকে নাই। সামাজিক প্রত্যেকটা বিষয় কনটেকসচুয়াল। এরে বিশ্বায়িত করা বা জেনারেলাইজ করার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত ভুল বোঝা হয়, ভুল বুঝতে সহায্য করা হয়।

দিলশানা পারুল

ধরেন একদল সামাজিক মানুষ নারীর স্বল্প বসন নিতে পারেন না। আরেক দল মানুষ নারীর বেশি বসন নিতে পারেন না। মানে একদল বেশি কাপড় মানে হিজাব পরলে না পছন্দ করে, আরেক দল শরীর দেখানো পোশাক পরলে না পছন্দ করে।
একদল মনে করছে, নারী শরীর খুবই প্রেসাস বস্তু, কাজেই এর ঢেকে ঢুকে রাখতে হবে, আরেক দল মনে করছে, নারী শরীর খুবই আকর্ষণীয় বস্তু, কাজেই একে খুলে মেলে আকর্ষণীয় করে রাখতে হবে।
এই দুই চিন্তার মধ্যে আসলে কি মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে? বিষয়টা আমার কাছে দাঁড়ালো যে, বেশি কাপড়ে যদি নারীবাদ না থাকে, তাইলে কম কাপড়েও নারীবাদ নাই।

এইটা ঠিক, নারী পোশাক কী পরবে সেইটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঠিক করে। আর সমাজ কী ঠিক করবে সেইটা নির্ধারণ করে কনজুউমার ওয়ার্ল্ড।

“ব্যক্তি স্বাধীন নারী বলছে, আমার ইচ্ছা তাই আমি এমন পোশাক পরবো” এইটা কি আসলেই ব্যক্তি নারীর ইচ্ছা? ধরেন, চুল রং করলে ব্যক্তি নারীর ভালো লাগে, তিনি ভালো বোধ করেন। কাজেই তার ইচ্ছা তিনি চুলে রঙ করেন। এখন চুল রঙ করলেই যে আপনার ভালো লাগবে, কেন নাক বা কান রঙ করলে আপনার ভালো লাগে না! এই বোধটা কোত্থেকে এলো?
লরিয়াল যদি ক্রমাগত আপনার কানের কাছে প্যান প্যান না করতো, চুল রঙ করো, দেখো, তোমারে কত্ত ভালো লাগে, তোমার মন ভালো হয়ে যাবে, তাইলে কিন্তু আপনার আসলেই মনে হতো না চুলটা বেগুনি করি! তার মানে এই যে আমরা নারীরা ‘আমার ইচ্ছা আমার স্বাধীনতা’ বলে চিল্লাচ্ছি, সেইটা কি আদতেই শতর্হীনভাবে আমার স্বাধীন ইচ্ছা? আমি নিশ্চিত আমার এই স্বাধীনতা মাপার ইন্ডিকেটরটা অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে না?
কোন সিদ্ধান্তে যাচ্ছি না, কারণ আমি নিজেও কনফিউজড এই প্রশ্নে।

পদ্মা নদীর মাঝিতে কপিলা এবং মালা দুটো চরিত্রই পুরো সিনেমাটা করেছে ব্লাউজ এবং অন্তর্বাস ছাড়া। তাও পুরান কাপড় পরে। পুরোটা সিনামায় রূপা গাঙ্গুলী এবং চম্পা দুই জনেরই অসংখ্যবার, লম্বা লম্বা দৃশ্য জুড়ে তাদের বুকের পুরো আকার বোঝা গেছে! রূপা গাঙ্গুলীর চূড়ান্ত রকম কামনাময়ী উপস্থাপনও আছে। এই ছবির পর এই দৃশ্যের জন্য কেউ প্রতিবাদ করেছিলো কীনা আমার অন্তত জানা নাই। এইখানে শরীরের উপস্থাপনটা কাহিনীর প্রয়োজনে জরুরি ছিলো। যে কারণে সেটা মানানসই এবং গ্রহণযোগ্য। তার মানে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেয়াটা জরুরি।

২০১৫ সালে সিলেটে গ্রামে গবেষণার ডাটা কালেকশনের জন্য টিম গেছে। ছেলেদের টিম। এদরে মধ্যে একজন কি দুইজন বৃষ্টির দিন হাফ প্যান্ট পরে ডাটা কালেকশন করেছে। গ্রামের মুরুব্বিরা বিষয়টা নিয়ে এমনই রাগ করেছে, এমনই রিঅ্যাক্ট করলো যে পুরো টিমটা আমাদের উঠিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে ডাটা কালেকশন বন্ধ করে। এরা কিন্তু সব ইয়াং ছেলে। তার মানে পোশা বাঙলাদেশে পুরুষের ক্ষেত্রেও একটা বিষয়।

কয়েকদিন আগে ফেইসবুকে একটা কবিতার বই এর এড করেছে একজন নারী। কবিতার বইয়ের সাথে অর্ধ নগ্ন নারীদেহ। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি শরীরটা যে কী সুন্দর মেয়েটার! মুশকিল হলো কবিতার বইটার নাম ‘খারাপ খারাপ কবিতা’। তাইলে যে কবিতার বইয়ের নাম ‘খারাপ খারাপ কবিতা’ তার সাথে অর্ধ নগ্ন নারীদেহ জুড়ে দেয়ার অর্থ কী দাঁড়ায়? তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে নগ্ন নারীদেহ মানে খারাপ? তাইলে তো আমার সাংঘাতিকরকম আপত্তি এই মাকের্টিং এ।

ধরেন, এই কবিতার বইটার নামই যদি হতো “শরীর কাব্য” অথবা “নগ্নতা” বা “শরীরের সৌন্দর্য” অথবা “নারী দেহ” অথবা ইত্যাদি ইত্যাদি … তাইলেই আমি মার্কেটিং এর নান্দনিকতায় আসলেই বিমুগ্ধ বা দগ্ধ সবই হয়ে যেতাম!

মোদ্দা কথা, বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসংগিকতাটা জরুরি! কাপড় কম পরলেন না বেশি সেইটা বিষয় না, বিষয় আপনি প্রাসংগিকে আছেন কিনা! নারী বেশি পোশাক পরলে নারী মুক্তি আসবে, না কম পোশাক পরলে আসবে, আমি সেই বিষয়ে নিশ্চিত না। ওই জন্য এই বিষয়ে কোন অনুমিত সিদ্ধান্তে যেতে চাই না।

গরম গরম থাকতে আলোচনাটা করতে চাইনি। এইটা একটা প্রয়োজনীয় আলোচনা। মাথা ঠাণ্ডা করেই ভাবা এবং বলা দরকার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.