দ্রৌপদী একুশ শতকে

শতাব্দী দাশ:

দ্যূতক্রীড়ায় প্রথমে সব ধনসম্পদ হারালেন যুধিষ্ঠির। তারপর একে একে বাজি রাখলেন ভাইদের৷ হারলেন। নিজেকে বাজি রাখলেন। হারলেন। শকুনি বললো, নিজের কাছে কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকতে নিজেকেই বাজি রাখা যায় না। অতএব পাঞ্চালীকে বাজি রেখে যেন রাজা নিজেকে মুক্ত করেন।

দ্যূতক্রীড়ায় বাজি রাখার আগে যা বাজি ধরা হচ্ছে তার গুণ বর্ণনা করতে হতো৷ অতএব ধর্মপুত্র বর্ণনা করলেন দ্রৌপদীকে। তিনি অধিক লম্বাও নন, বেঁটে-খাটোও নন। অধিক ফর্সা নন, আবার অধিক কৃষ্ণবর্ণও নন। তিনি ক্ষীণকটি। তাঁর গাত্রলোম বিরল… ইত্যাদি।

আমি মহাভারত বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই বক্তব্যের আগে দ্রৌপদীর এতটা যৌনগন্ধী বর্ণনা সম্ভবত মহাভারতে নেই। যতদূর মনে পড়ে, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী  বলেন, ব্যক্তিমানুষকে যুধিষ্ঠির বাজি ধরতে পারেন কিনা তা নিয়ে বর্তমান যুগের বক্তব্য, বিশেষত নারীবাদীদের বক্তব্য তিনি শুনেছেন। ( ‘নারীবাদী’ কথাটা ব্যবহার করেন না তিনি। ‘স্বাধীনচেতা নারী’, ‘প্রগতিশীলা’ ইত্যাদি বলেন)। কিন্তু (তিনি বলেন) মনে রাখতে  হবে, যুধিষ্ঠির শুধু পাঞ্চালীকে নয়, বাজিতে হেরেছিলেন নিজের পুরুষ ভাইদেরও।

শতাব্দী দাশ

নিশ্চয়। এর আগেও, নিয়ম মেনে  যুধিষ্ঠির একে একে বর্ণনা করেছেন নিজ ভ্রাতাদের। কিন্তু ভাদুড়ী মশাই যা হয়তো ইচ্ছা করে ‘আন্ডারলাইন’ করেননি,  তা হলো, তখন শৌর্য-বীর্য, ধীশক্তি ইত্যাদির কথা এসেছিল। শরীরের আকার, বর্ণ, কটিদেশের ব্যাস, দেহলোমের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচ্য হয়নি। অর্থাৎ  দ্রৌপদীকে বাজিতে হারলে তাঁর স্ত্রীর ‘শরীর’ নিয়ে কী কী করা যায়, কী কী করা হবে, তা ধর্মপুত্র জানতেন।

এরপর দ্রৌপদীকে হারলেন যুধিষ্ঠির। দাসীপুত্র বিদুর প্রথম আদেশ পেলেন দুর্যোধনের কাছে। ‘হে দাসীপুত্র, সেই দাসীকে নিয়ে এসো সভায়। পরে না হয় আমরা তাকে দাসীমহলে রাখার ব্যবস্থা করবো।’  হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে দাসীরা শুধু খিদমত খাটে না, তারা বহুভোগ্যা। সে কথা দাসীপুত্র বিদুরের অধিক আর কে জানবেন? তাঁর মা-ও তো মহর্ষি ব্যাসের সঙ্গে সঙ্গমে বাধ্য হয়েছিলেন।

বিদুর চেষ্টা করলেন দ্রৌপদীকে বাঁচানোর। তিনি যে যুক্তিক্রম ব্যবহার করলেন, তা পরবর্তীকালে ব্যবহার করবেন সভার অনেকেই। যুক্তিটি ছিল, যুধিষ্ঠির আগেই নিজেকে হেরেছেন। যে নিজেকে হেরেছে, তার নিজস্ব বলতে কিছু নেই ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে বাজি ধরেন, তখন দ্রৌপদী আর তাঁর সম্পত্তি ছিলেনই না। কিন্তু যদি যুধিষ্ঠির নিজের আগেই দ্রৌপদীকে বাজি ধরতেন? তাহলে এই যুক্তির ঢালটুকুও আর থাকতো না ৷

প্রতিকামী যখন বারংবার দ্রৌপদীকে ডাকতে যাচ্ছে, একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদী বলে পাঠাচ্ছেন, রাজা আগে নিজেকে হেরেছেন না তাঁকে, সেই খবর নিয়ে আসা হোক সভা থেকে। অর্থাৎ দ্রৌপদী, যিনি সীতার মতো মিতবাক, অসহায় নন, তিনিও আত্মরক্ষার্থে একই যুক্তিজাল ব্যবহার করছেন। তিনিও মেনে নিয়েছেন, রাজা নিজেকে আগে বাজিতে হেরে না থাকলে অন্তত কোনো যৌক্তিক বাধা নেই স্ত্রীকে বাজি ধরতে।

পিতামহ ভীষ্মও পরে মাথা চুলকে দ্রৌপদীকে বলছেন, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম ব্যাপার। একদিকে নিজেকে হেরে যাওয়া ব্যক্তি অন্য কাউকে বাজি রাখতে পারেন না। অন্যদিকে স্ত্রীর সত্ত্বাধিকারী অবশ্যই স্বামী। সুতরাং দ্রৌপদীকে বাজি রাখা যেত কিনা তা অতি ‘সূক্ষ্ম’ বিবেচনার বিষয়, কোনো চটজলদি উত্তর তাঁর জানা নেই।

এই ছিল দ্বাপর৷

সত্যযুগে ধর্ম আর অধর্মর বিভেদ এতো সূক্ষ্ম-টূক্ষ্ম ছিল না৷  ন্যায় ও নীতিবোধের ধারণা ছিল সরলতর। তাই হরিশ্চন্দ্র ‘সত্যরক্ষা’ করতে অবিচলচিত্তে স্ত্রী পুত্রকে বেচে দিয়েছিলেন। সহজ ব্যাপার।

এখন ঘোর কলি। ন্যায় ও অন্যায়ের ধারণা গেছে ঘেঁটে। অনেকে আবার বলেন, সব সত্যই নাকি স্থানিক। এবং নীতিবোধ মানেই নীতিপুলিশি। সেই লজিকাল এক্সট্রিমে যাচ্ছি না ৷ অন্তত নীতিবোধের যে পরিবর্তন হয়েছে তা তো খালি চোখেই দেখা যায়। লিঙ্গগত, শ্রেণিগত, বর্ণগতভাবে প্রান্তিক মানুষের মুহুর্মুহু চিৎকারে আমাদের নীতিকাঠামো কিছু অংশে সফলভাবে বদলেছে। অন্তত আইন-কানুনের পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা জেনেছি, স্ত্রী স্বামীর ‘সম্পত্তি’ নন৷ জুয়া খেলায় তাঁকে বাজি রাখা যায় না। তাঁকে বেচে দেওয়া যায় না। তা দণ্ডনীয় অপরাধ।

কিন্তু সত্যি কি আত্তীকরণ আত্মীকরণ করেছি এই বদল? কতজন করেছি? তাহলে কীভাবে জৌনপুরের ব্যক্তি জুয়া খেলায় ২০১৯ সালে বাজি রাখেন স্ত্রীকে? কীভাবে জুয়ায় জেতা ব্যক্তিরা মেয়েটিকে বারংবার ধর্ষণ করে? থানা কেন অভিযোগ নেয় না? আদালতকে মাথা গলাতে হয় কেন থানাকে শুধু প্রাথমিক এফআইআরটি নিতে বাধ্য করতে?

অগাস্ট, ২০১৯-এর ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় খবর নিঃসন্দেহে কাশ্মীর অধিগ্রহণ৷ তার আড়ালে চলে যাচ্ছে উত্তর প্রদেশের জৌনপুর জেলায় ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনাটি৷

মেয়েটি জানিয়েছে, তার ‘স্বামী’ ছিল নেশাসক্ত, জুয়াড়ি ৷ জুয়ায় বাজি রেখেছিল স্ত্রীকে। সেই খেলায় হারার পর ‘স্বামী’র বন্ধুদ্বয় তাকে ধর্ষণ করে, ‘স্বামী’-র সম্মতিক্রমে ৷ মেয়েটি অপমানে, ভয়ে, লজ্জায়, বাড়ি ছেড়ে পালায়। আশ্রয় নেয় এক আত্মীয় বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও হানা দেয় ‘স্বামী’। এবার অনুতপ্ত ভঙ্গি। ভুল স্বীকার করে, ক্ষমা চায়। মেয়ে অবশেষে বরের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে রাজি হয়। ফেরার পথে গাড়ি থামায় পুরুষ। আবার সেই দুই বন্ধুর হাতে তুলে দেয় মেয়েটিকে। আবার ধর্ষণের শিকার হয় সে। মেয়েটির বাড়ি জাফরাবাদ থানা এলাকায়। থানা এফআইআর নিতে চায় না। কোর্টে কেস করে থানাকে বাধ্য করতে হয় এফআইআর নিতে।

মহাকাব্যিক বস্ত্রহরণকালে অমঙ্গলের কিছু মিথিক্যাল দ্যোতকের উপস্থিতি অন্তত নিশ্চিত করেন কবি/রা । শেয়ালের আর্তনাদ, পেচকের ডাক… অর্থাৎ, সেই পিতৃতান্ত্রিক কবি/দের মনেও কোথাও একটা বোধ ছিল যে এ’ অন্যায়। কার কাকে বাজি ধরার অধিকার আছে সেই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, অন্যায় হচ্ছে এক নারীর সঙ্গে এবং সেই অন্যায়ের অভিঘাত সুতীব্র হতে চলেছে।

আজ সব এতো চুপচাপ কেন? যেন সবাই মেনে নিয়েছি যে এমনটা হয়েই থাকে! যেন এমনটা হতেই পারে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.