তানিয়া কামরুন নাহার:
আমাদের দেশের পুরুষেরা পশ্চাৎপদ। তাই নারীদের সামনে এগিয়ে যেতে দেখতে দেখলে তারা সহ্য করতে পারে না, বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে কিছু সিলি উদাহরণ দিতে চাচ্ছি।
প্রতিষ্ঠিত, সফল কোনো নারীর জীবনসঙ্গী হিসেবে সাধারণত তারই মতো প্রতিষ্ঠিত ও সফল কাউকে আমরা দেখতে পাই। এর অন্যথা যে হয় না, তা নয়। সেসব ক্ষেত্রে ফলাফল ডিভোর্স কিংবা নিজের সকল সাধ-আহ্লাদ-অধিকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে অত্যন্ত অসুখী জীবন যাপন করতে হয় নারীকে। এখন কথা হচ্ছে, একজন সফল ও প্রতিষ্ঠিত নারী কেন আরেকজন সফল পুরুষকেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়? কারণটি খুব সোজা, সেই নারীর পক্ষে পিছিয়ে পড়া একজন পুরুষেরা সাথে জীবনভর মানিয়ে চলা সম্ভব নয়।
অথচ আমাদের সমাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখে থাকবো যে, সফল, প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চ শিক্ষিত বহু পুরুষ খুব সহজেই অসফল, অপ্রতিষ্ঠিত, এমনকি স্বল্পশিক্ষিত/অশিক্ষিত নারীদের সাথে জীবনসঙ্গী নিজেকে দিব্যি হিসেবে মানিয়ে নিতে পারেন।
পারেন এজন্যই যে, তারা হয়তো সনদপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু মানসিকভাবে তারা পশ্চাৎপদ। মানসিক দৈন্যের জন্যই তারা পারেন না তারই মতো সফল ও উচ্চশিক্ষিত আরেকজন নারীর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে। অথচ একজন সফল ব্যক্তির, তার জীবনসঙ্গিনীকেও তারই মতো সফল হবার জন্য উৎসাহ ও প্রেরণা দেওয়ার কথা। আর আমাদের দেখতে হয় উল্টোটা।
আমাদের দেশের পুরুষেরা এতই পশ্চাৎপদ যে তারা নারীদেরকে তাদের বস হিসেবে ভাবতেও পারে না। নারীর অধিনস্থ হয়ে কাজ করাকে পৌরুষহীনতা মনে করে। আর নারীদের সফলতা-ও তারা মেনে নিতে পারে না। নারীর নিজে মেধা, যোগ্যতাতেই সফলতা, পুরুষদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর মেধা ও যোগ্যতাকে নাকচ করে দিয়ে পুরুষ তাকে শুধুই যৌন পণ্য মনে করে। আর তা-ই নারীর সফলতাকে অত্যন্ত খাটো চোখে দেখে পুরুষেরা। একই কারণে কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই নারীকে সহকর্মী ও বসদের মাধ্যমে নানা রকম মানসিক ও যৌন হেনস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
পুরুষেরা যদি এইভাবে পিছিয়ে থাকে, তবে নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা নিঃসন্দেহে অমসৃণ থেকে যাবে।
পশ্চাৎপদ পুরুষদের রিপ্রেজেন্টিটিভ হলো আরেকদল পশ্চাৎপদ নারী, যাদেরকে পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত নারী বলা-ই বেশি ভালো। এই পশ্চাৎপদ নারীরাও সামনে এগিয়ে যাওয়া নারীদের দেখে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তাদেরও ইচ্ছে করে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু তারা তো পুরুষতন্ত্রের বুলি শেখা খাঁচায় বন্দি সেই তোতা পাখি! তাই তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারেন না। পিছিয়ে থাকা যে কত ভালো, তার গুণগান করেন এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া নারীদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান।
বেগম রোকেয়া জন্মেছিলেন ১৩৭ বছর আগে। ঐ সময়ে তিনি যেভাবে চিন্তা করতে পেরেছিলেন, লিখতে পেরেছিলেন, কাজ করতে পেরেছিলেন…সে কথা ভাবতে গেলে অবাক লাগে। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে ২০০ বছর এগিয়ে ছিলেন। তাঁর ভাই ও স্বামীর অবদান-ও এক্ষেত্রে স্মরণ করতে হবে।
আর বর্তমানের নারীরা এখন শুধু পিছনে যাচ্ছে, ৫০০ বছর পেছনে চলে যাচ্ছে নারীরা। পোশাকে তো বটেই, চিন্তা-চেতনাতেও। অথচ এই নারীদের অন্তত ১০০০ বছর এগিয়ে থাকার কথা। যারা এগিয়ে আছে, তারাও সেই ‘সুলতানা’স ড্রিম’ লুপে আটকে আছে। নতুন কোন স্বপ্নের কথা এখনো আমরা ভাবতে পারছি না।
আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারি না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরপাক খাই, খাবি খাই। অথচ আমাদের সবার একসাথে সামনে এগিয়ে যাবার কথা।
হে পুরুষগণ, নারীরা কেন আরো সামনে এগিয়ে যাবার বদলে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে?
হে পুরুষগণ, নিজে সামনে আগান, অপরকেও সামনে এগোতে দিন।