সুপ্রীতি ধর:
গত কয়েক মাস ধরেই ব্যারিস্টার সুমনের নামটা অনলাইনে ঘুরছিল। উনি সমাজের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে জনসাধারণের কাছে যাচ্ছেন, ওখান থেকে লাইভ করছেন। মানুষ কতোটা উপকৃত হচ্ছে জানি না, তবে মানুষের মাঝে একধরনের আশার সঞ্চার তিনি করতে পেরেছেন।
মূলত একটি দেশে যখন সবগুলো সিস্টেম ভেঙে পড়ে একে একে, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় যখন একটা রাষ্ট্র, তখন মানুষ খড়কুটো ধরে হলেও বাঁচতে চায়। ব্যারিস্টার সুমন তেমনই একজন। প্রান্তিক মানুষেরা, অসহায় মানুষেরা তার ভিতর একধরনের আশাজাগানিয়া মানুষ দেখতে পেয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো খবর। আমি অবশ্যই এপ্রিশিয়েট করি তার এই উদ্যোগকে।
যদিও তার বাচনভঙ্গি, ভাষা আমার ভালো লাগেনি, মানে এই ভাষায় একটা মাধ্যমে কথা বললে, তাও আবার সিরিয়াস কোনো বিষয় নিয়ে, আমি ঠিক নিতে পারি না। এটা একান্তই আমার মতামত। একটা নির্দ্দিষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের কথা বলার স্টাইল এবং তার ভাষারও পরিবর্তন হবে, এমনটা আমরা ধরেই নেই। তার মানে এই নয় যে, সবাইকে রাবীন্দ্রিক ভাষায় কথা বলতে হবে! প্রমিত বাংলা বলতে না পারলেও একটা স্ট্যান্ডার্ড তো থাকবে অন্তত! তারপরও মাঝে মাঝে শুনেছি তার বক্তব্য। অধিকাংশ সময়ই খুবই সস্তাদরের ফেমসিকার মনে হয়েছে তাকে আমার। পাশাপাশি বিভিন্ন কথা বা শব্দচয়নে লোকটাকে কিছুটা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলেও মনে হয়েছে। সেটাও আমার ধর্তব্য নয়, যেখানে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোকই এই দোষে দুষ্ট, তখন একজন ব্যারিস্টারের পক্ষেও তা হওয়াই স্বাভাবিক, আর আমার জন্যও এই বিষয়টাকে উপেক্ষা করাই স্বাস্থ্যদায়ক। নইলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে যে!
বরগুনায় রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যখন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হলো ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে এবং সারাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যখন দাঁড়িয়ে গেল মিন্নির বিপক্ষে এবং তার পক্ষে সে যখন কোনো আইনজীবীকেই পেল না, ঠিক তখনই শুনতে পেলাম যে ব্যারিস্টার সুমন যাচ্ছেন সেই মামলায় মিন্নির হয়ে লড়তে। সত্যি বলতে কী, অনেক রিলিফ অনুভব করেছিলাম সেই খবরে। এমনও আশা জেগেছিল যে, উনি মিন্নিকে ঠিকই ন্যায়বিচার পাইয়ে আসবেন! জানি না এখনও উনি সেই সিদ্ধান্তে অটল আছেন কীনা!
ঠিক তার দুদিন পরই যখন সারাদেশ উত্তাল একজন সংখ্যালঘু প্রিয়া সাহার ট্রাম্পের কাছে অভিযোগের বিষয় নিয়ে, যখন দেশের মানুষ সংখ্যালঘু প্রশ্নে যেকোনো অত্যাচার, নির্যাতনের বিষয়টিই অস্বীকার করে বসে আছে, বা স্বীকার করলেও ইনিয়ে-বিনিয়ে বিরোধিতাই করছে, উপরন্তু প্রিয়াসহ পুরো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে যখন শূলে চড়িয়ে দেয়ার মতোন অবস্থা, ঠিক তখন সেই ব্যারিস্টার সুমনই আবার স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করতে গেলেন। উনি যথারীতি বীর বনে গেলেন দেশের আপামর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর। যদিও আদালত সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছে, কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মি. সুমনের একটা চরিত্র উন্মোচিত হয়ে গেছে। তিনি ব্যারিস্টার, জানতেন যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রাষ্ট্রই করতে পারে কেবল, তারপরও তার এই অতি উৎসাহ তাকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছে, তা তিনি বুঝতে অক্ষম বলে আমার মনে হয় না।
এরপরই এলো ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকার বাড্ডায় রেনু নামের এক নারী, যে কিনা দুই সন্তানের মা, তাকে পিটিয়ে হত্যার সেই মর্মন্তুদ ঘটনা। সারাদেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। এমনি সময়েই আবারও ব্যারিস্টার সুমনের আবির্ভাব। তিনি তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে নামলেন আবারও।
এবার তিনি সেই সদ্য মা-হারা দুই সন্তানকে দুই পাশে বসিয়ে তাদের সামনেই সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা করছেন, আবার ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চাদের প্রশ্নও করছেন, মা কই? কোথায় গেছে? মাকে মনে আছে কীনা! এসব কী প্রশ্ন? এধরনের প্রশ্ন করা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটা কি উনি জানেন?
অনলাইনে মি. সুমনের এই লাইভ দেখার পর বেশকিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করলাম।
রাহাত মুস্তাফিজ লিখেছেন, “ব্যারিস্টার” লোকটাকে কেউ থামান। একটা দুই বছরের ও একটা চার/পাঁচ বছরের শিশুর সামনে কী বলা যায়, কতটুকু বলা যায়, তাদেরকে কী জিজ্ঞেস করা যায়, কী কী জিজ্ঞেস করা যায় না এই কমনসেন্সটুকু নেই লোকটার।
ছেলেধরার রিউমার ছড়িয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা রেনু নামের নারীটির বাসায় গিয়ে লাইভ করে এসেছেন লোকটা। তাঁর দু’টি শিশু সন্তানকে সে জিজ্ঞেস করছে, তোমার মা কোথায় গেছে, কী হয়েছে জানো? শিশু ছেলেটি উঠে যেতে চেয়েছিল, তাকে জোর করে ধরে পাশে বসিয়ে এইসব প্রশ্ন করা হয়েছে। কী নিষ্ঠুর রসিকতা মানুষের!
হতভাগ্য পরিবারটিকে তিনি মানসিক নির্যাতন করে এসেছেন। যেকোনো সভ্য সমাজে প্রিয়জনের মৃত্যুর বিষয় উঠলে, প্রশ্নকর্তা ব্যক্তিটি মর্মাহত হন। সাথে সাথে ‘সরি’ বলে সমব্যথী হন। তিনি যে এমপ্যাথাইজড হয়েছেন সেটি মুখের এক্সপ্রেশনে, কথায় ফুটে ওঠে।ফেইমসিকার লোকটির ভেতরে এসবের ছিটেফোঁটা নেই। এই লোকটার মানসিক চিকিৎসা দরকার। জরুরী দরকার। হিউম্যান রাইটস নিয়ে যারা কাজ করেন তারা একটু আওয়াজ তোলেন। লেখাপড়া জানা এই ‘অশিক্ষিত’ ব্যারিস্টারকে থামতে বলেন।
সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি লিখেছেন, মি: ব্যারিস্টার সুমনকে কেউ আটকায়নি কেন? পরিবারের মানুষজন উনাকে ঢুকতে দিলো কেন ঘরে? উনি তুবাকে প্রশ্ন করছেন, তোমার মা কোথায় গেছে, ছেলেটা উঠে চলে যাচ্ছে, তাকে আবার টেনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, তোমার মায়ের কথা কি মনে আছে! ওদের সামনে তিনি ওদেরই মায়ের নৃশংসভাবে মৃত্যুর কথা বলছেন! ছি ছি ছি!!এই ভদ্রলোক এইটুকু বুঝতে পারছেন না তিনি শিশুদের মানসিকভাবে নির্যাতন করছেন! একটা শিশুর মনোজগতে আঘাত লাগে এমন বিষয় থেকে তাকে দূরে রাখতে হয়, আর তিনি তাদের মা কি করে মারা গেছে সেই প্রসঙ্গে আলেখ্যা অনুষ্ঠান করতে তাদের নিয়ে লাইভে এসেছেন! শিশুর মনোজগৎ উনার মস্তিষ্কের মতো এতো অনুর্বর নয়, ভয়ই লেগেছে তার কাণ্ডকীর্তি দেখে। তিনি হয়তো জাতীয় হিরো হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েছেন, বাট আমার তাকে জাস্ট জিরো মনে হয়েছে…।
মীর মোনাজ হক লিখেছেন, বাচ্চাদেরকে ক্যামেরার সামনে বসিয়ে জোর করে তাদের সামনে তাদের মায়ের নির্মম হত্যার কাহিনী বর্ণনা করা কোন সুস্থ মানুষের লক্ষণ নয়। শিশু মনস্তাত্ত্বিক সে জানে না, এই ব্যারিস্টারের রীতিমতো মানসিক চিকিৎসা দরকার। প্রিয়া সাহাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ ঘোষণা করে মামলা দিতে গেলে বিজ্ঞ আদালত তা খারিজ করে দেয়। এবার পাগল হয়ে গিয়ে ‘শিশু নির্যাতনে’ ঢুকেছে, এই উন্মাদকে থামাবে কে?
আরও অনেকে অনেক কিছু লিখেছেন, তারা সুমনের এহেন কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করছেন, ঘৃণা প্রকাশ করছেন। সবাই অন্তত বুঝতে পারছে যে দুটি শিশুর মনস্তত্ত্বকে অস্বীকার করে বা ধরেও যদি নেই যে এটা ছিল তার ‘অজ্ঞানতাপ্রসূত’ তারপরও এমন একটি ঘটনা ঘটানো ঠিক হয়নি সুমনের। অনেকেই আবার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ছেলে মেঘকে সেইমুহূর্তে করা একটি সাক্ষাতকার নিয়ে তখন যে পরিমাণ তোলপাড় হয়েছিল, তাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

এখন কথা হচ্ছে, ব্যারিস্টার সুমন অবশ্যই আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেই ব্যারিস্টার হয়েছেন। সেই আইনের বিষয়গুলোতে কি মানবিকতা বা মনস্তত্ত্ব বা নৈতিকতা নামক কোনকিছু শেখায়? বা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত? সস্তা জনপ্রিয়তা অপগণ্ড, মূর্খদের মাঝে সহজেই অর্জন করা যায়, আর বাংলাদেশে এখন এর বাম্পার ফলন চলছে। কিন্তু প্রকৃত মানবিকতাসম্পন্ন মানুষ কি হওয়া যায়? মি. সুমনের কাছে আমার প্রশ্ন এটাই।
সবশেষে বলছি, তিনি যদি নিজেকে সেলিব্রিটি ভাবেন, অনলাইন এক্টিভিস্ট ভাবেন, তবে লাইভ ভিডিও করার ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল তাকে হতে হবে। আর যদি তিনি তা না হোন, তবে ভালোয় ভালোয় সরে যাওয়াই ভালো। মানুষের ভালো যদি না করতে পারেন, তবে খারাপটা করবেন না প্লিজ।
সম্পাদক: উইমেন চ্যাপ্টার