সুচিত্রা সরকার:
ক্যাশ কাউন্টারের ওপাশ থেকে প্রশ্ন- নাম কী?
সুচিত্রা।
বয়স?
ব্যস! আর কোনো প্রশ্ন করে না আল্ট্রাসাউন্ড করাতে গেলে নিজ দায়িত্বে জেন্ডারের ঘরে ফিমেল লিখে দেয়। এবং সব পূরণ করে স্লিপটা ধরিয়ে দেয়। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি আমার নাম শুধু সুচিত্রা সরকার নয়। মিসেস সুচিত্রা সরকার।
আচ্ছা, আমি কি তাদের বলেছি যে, আমি মিসেস?
তাহলে?
তাহলে হলো এই যে সমাজের নিয়মে শুধুমাত্র ‘মিসেস’রাই প্র্যাগনেন্সি প্রোফাইল টেস্ট করাতে পারবে।
আমি ভাবছি, যে মেয়েটা বিবাহিত নয়, কোনো কারণে গর্ভধারণ করেছে- হতে পারে বিয়ে না করেই বা স্পার্ম ব্যাংক থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে মা হয়েছে- তারা কী করবে?
এই যে হুট করে জিজ্ঞেস না করে মিসেস লিখে দেয়া, তাতে কি সেই মেয়েদের প্রতি আচরণটা আরো ইনসেনসেটিভ হয়ে গেল না?
এমনিতেই বর্তমান সমাজ কাঠামোয় সিঙ্গেল মাদার একটা টাফ ব্যাপার! তার উপর যে মেয়েটা উপরের দুটো অবস্থার একটায়ও গর্ভধারণ করে, সে তো আরো চাপে পড়ে যাবে!
কাল একটা হাসপাতালে দেখলাম প্র্যাগনেন্সির ডাক্তারের চেম্বারের পাশেই ইনফারটিলিটি চিকিৎসার চেম্বার। একদম লাগোয়া। কী অমানবিক!
যে মেয়েটা দিনের পর দিন চেষ্টা করছে মা হতে, সে যখন পাশেই দেখবে গর্ভবতী মেয়েটাকে, তার অনুভূতিটা কী হবে?
একটু হৃদয় দিয়ে ভেবে কি এগুলোর ব্যবস্থাপনা করা যায় না? সমাজে তো এখনো কাঁদা ছোড়ে মেয়েটিকেই! যেদিন ছোড়া বন্ধ হবে, সেদিন না হয় ভাবা বাদ দেবেন! এখন অন্তত হৃদয়ে তাদের ব্যথা ধারণ করুন!
২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। সেদিন বড়দিনের ইতিহাস বলতে শুরুই করা হয় এই বলে যে কুমারী মাতা মেরীর সন্তান যিশু…।
কুমারী মাতা কী? মা তো মা-ই! উপরন্তু সঙ্গী তাঁর সঙ্গেই ছিল। তাহলে? মেইল গেইজ ধারণা থেকে এই অভিধা কি মাতা মেরীকে বিদ্ধ করে না আজও? আমাকে করে, বহু আগে থেকে।
সঙ্গী সঙ্গে থাকা প্রসঙ্গে একটা কথা মাথায় এলো। সেদিন একজনের সঙ্গে কুতর্ক হচ্ছিল। কুতর্ক এই অর্থে যে, তার যুক্তিগুলো এতোটাই কাঁচা যে বেশি কপচাতেও ভালো লাগছিল না। তাকে রাগানোর জন্য খুব লঘু শব্দ ব্যবহার করেছি। যেমন, সুতা দেখে সাপ, আলগা থেকে দলগা! যথারীতি সে রেগে গেছে। এবং ইংরেজিতে বক্তব্য শুরু করেছে।
তার বক্তব্যটা বলছি। তার আগে বলা দরকার, যে মানুষটা মাস্টার্স পাশ করে বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে জীবনযাপন করছে, সে যদি নারীদের অধিকার, মর্যাদা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না রাখে, তবে তা সত্যি দুঃখজনক।
এই দুঃখে শামিল হয়েই বলছি, প্রাক প্রাথমিক শিক্ষায় মন্দির- মসজিদভিত্তিক পড়াশোনার চেয়ে জরুরি জেন্ডার নিয়ে পড়াশোনা। সেই বয়স থেকেই নারী পুরুষের সমানাধিকার, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান। মস্তিকে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক গেঁথে দিতে হবে নারী পুরুষের সমতার। তাহলে এতো এতো ডিগ্রি লাভ করা মেয়েটা বলতে পারবে না যে, মেয়েদের সন্তান জন্ম দিলেই হয় না- প্রয়োজন তার স্বীকৃতির। পিতার স্বীকৃতি!
হুম, মানুষটি লিঙ্গে নারী। এবং তার কথার সারাংশ তাই। আরো কিছু কথা এরকম, পুরুষ ছাড়া মেয়েরা মা হতে পারে না, পুরুষ নারীকে আস্থা আর স্বীকৃতি দেয়। আর স্বীকৃতি ছাড়া এতো সব সহজ হয় না। যেমন অপুর (নায়িকা, যার হিপোক্রেট বরের নাম শাকিব) সময় সে একা ছিল।
এবং আমি যখন তার সঙ্গে কথা বাড়াতে না চেয়ে উপরের দুটো বাক্য বলেছি, তার বক্তব্য নারীবাদীরা অন্য মেয়েদের সঙ্গে রুড আর রাফলি কথা বলতে পারে না। তাদের ধীর হতে হয়!
আগে একটু হেসে নিই। কে বলেছে, নারীবাদীরা সর্বংসহা? কে বলেছে তারা পুরুষতান্ত্রিক নারীদের ছেড়ে কথা বলে? কে বলেছে তারা জবাব দেয় না পাল্টা অন্যদের? শুধু মেয়ে বলে ছেড়ে দেয়?
যাই হোক, মূল বক্তব্যে ফেরা যাক।
একটা মেয়ে যখন ছেলের স্পার্ম নিয়ে কনসিভ করলো, দশ মাস তিল তিল (তিল তিল ছোট না, বিরাট ব্যাপার) করে সন্তানকে গর্ভে বড় করলো, সেখানে পুরুষের স্বীকৃতি কথাটার মানে কী?
আমি ভীষণই কম বুঝি। টিউব লাইট ঘরানার। বুঝতে পারছি না। একটা পেট হয়েছে। বাচ্চা হয়েছে। মেয়েটা মা হয়েছে। মেয়েটির পেট আর গর্ভের শিশুটিই তো প্রমাণ করেছে সে মেয়েটি মা।
পুরুষটি কী স্বীকৃতি দেবে? রাজটিকা পরিয়ে দেবে মেয়েটিকে? নাকি একটা স্বর্ণমুকুট? সমাজের সামনে একটা নাটক মঞ্চস্থ করবে- যেখানে সে মাইকে ঘোষণা করবে, হে নারী তুমি আমার সন্তানের মা হলে! এ সন্তান আমার! তার দায়িত্ব নেবার আস্থা আমি তোমায় দিচ্ছি।
বলবে এসব?
আমার তো ভীষণই নোংরা মনে হয়, যখন এরকম কোনো ঘটনা ঘটে। গ্রামে বা শহরে। একটা মেয়েকে ছেলেটা যৌন হয়রানি, নির্যাতন করলো বা ধর্ষণ। ব্যাপারটা সমাধা করতে মোড়লরা মেয়েটির সঙ্গে ছেলেটির বিয়ে দিয়ে দেয়!
ধর্ষণের পর কনসিভ করলো। তারপর বিয়ে!
কী ভয়ংকর! মেয়েটা কী করে এই ছেলেটার সঙ্গে জীবনযাপন করবে? এই … (অমুদ্রণযোগ্য) স্বীকৃতি দিয়ে সে কি ধুয়ে খাবে?
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পরবর্তীতে সন্তান জন্ম নিয়েছেন তাঁর কোল আলো করে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো একজন যদি এসে বলে, এই নারীর সন্তানের বাবা আমি, তাতে হবেটা কী?
সে একটা স্বীকৃতি পাবে।
কী সেই স্বীকৃতি? কী হয় তা দিয়ে? সমাজের বিভিন্ন খাতায়, তালিকায়, হাসপাতালের চোথায় আর শিশুর স্কুল ভর্তির রেজিস্টারে বাপের নামটা উজ্জ্বল হয়? সেই নারীকে করা অপমান লাঘব হবে?
বড় পাশ করুন বা ছোট। পড়ালেখা শিখুন বা না শিখুন। আদতে মেয়েদের মর্যাদাটা কীসে, সাদা চোখে না দেখে বুদ্ধি আর মগজের ঘরটা খুলে বিচার করুন।
স্বীকৃতি, সম্মান, মর্যাদা এভাবে অর্জিত হয় না।