আপনারাই যখন একেকজন খুনি ও ধর্ষক

সুপ্রীতি ধর:

পুরো অনলাইন জুড়ে চলছে বরগুনার ঘটনায় স্বামীকে বাঁচাতে চাওয়া মেয়েটির চরিত্রের পোস্টমর্টেম। যেন প্রতিযোগিতা চলছে কে কার চাইতে বেশি আগে এসব ‘তথ্য’ দিতে পারবেন! সাংঘাতিক সব তথ্য একেকটা! নারী-পুরুষ কেউ বাদ যাচ্ছে না এই হীন প্রতিযোগিতা থেকে। সবাই ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচার দাবি না করে বা প্রতিবাদ না করে মেয়েটির প্রেম এবং বিয়ে নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছে। একটি প্রাণ ঝরে গেল, আমরা সবাই তা দেখলাম চোখের সামনে, যেন রাস্তায় কোনো মজার ঘটনা দেখে বাসায় এসে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি!

আর সাংবাদিকরা একেকজন সব বিশাল বড় অনুসন্ধানী রিপোর্টার বনে গেছেন, মাটি খুঁড়ে তারা তুলে আনছেন মেয়েটির জীবনের নানাদিক, বিয়ে করেছিল কিনা, করলে কয়টা করেছিল, প্রেম ছিল কিনা, ছবি কার কার সাথে তুলেছে মেয়েটি, যা খুবই রসালো করে তারা পরিবেশনও করছেন। দৈনিক কালের কণ্ঠ, অনলাইন পত্রিকা জাগোনিউজসহ ভুঁইফোড় অনেক পত্রিকা তাদের কাটতি বাড়াচ্ছে এসব খবর ছেপে। আর এইসব খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে অবদমিত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা বলে আদৌ কোথাও কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ!

এতো এতো মানুষের সামনে একজন জলজ্যান্ত যুবককে কুপিয়ে মারার চাইতেও এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি। ইউটিউবে, নিউজ লিংকে মেয়েটিকে দেখে এমন মন্তব্যও করছে অনেকে, স্বামীর মৃত্যুর পরও চোখে কাজল! অথবা বার বার পোশাক চেঞ্জ করে এসে মেয়েটি নাকি হাজির হচ্ছে টিভি ক্যামেরার সামনে!

এতোটুকু রেহাই দেয়া হচ্ছে না মেয়েটিকে। দেশে এতোগুলো টিভি চ্যানেল, সবারই তার সাথে কথা বলতে হবে। একই কথা বার বার জানতে চাওয়া হচ্ছে, ‘সেদিন কী ঘটেছিল আসলে’ এমন আবাল প্রশ্নও করতে পারে কোনো সাংবাদিক? মেয়েটিও নির্বিকার মুখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, ওর মুখে কিছু কথাও বসিয়ে দিয়ে শোনানো হচ্ছে কাকাতুয়ার মতোন, বিচার চাই, স্বামীর হত্যার বিচার চাই, প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ, ব্লা ব্লা ব্লা। অথচ মেয়েটির এখন ট্রমা চলার কথা! তার এখন মানসিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন, প্রয়োজন পরিবারের, বন্ধুদের তথা রাষ্ট্রের সহযোগিতা এক্ষেত্রে। কেউ জানে সেকথা? আমাদের সমাজব্যবস্থা কবে কার মানসিক অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়েছে? রুনি-সাগর খুন হওয়ার দিন সকালেই ছয় বছরের শিশু মেঘকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ঘটনা সম্পর্কে, রানা প্লাজার ঘটনায় অনুভূতির কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল, এসবই তো আমাদের সাংবাদিকতার নমুনা। শুধুমাত্র কৌতুহলি মানুষের কারণেই না, সাংবাদিকদের কারণেও এদেশে কোনো ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়। অথচ এই সাংবাদিকরাই দেশে-বিদেশে এ সংক্রান্ত নানান প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। থাক, এ নিয়ে আর কথা না বলি।  এ নিয়ে বলতে চাইলে দিনরাত পার হয়ে যাবে আমার।

শুধু বলবো, সাধুবাদ জানাই এইসব বাঙালীকে, যারা নিজেদের খুব ভালো করে চিনিয়ে দিচ্ছে আবারও, যেমনটি চেনায় একেকটি ঘটনায়। যেখানেই নারীকেন্দ্রিক কোনো ঘটনার আভাস পায় ওমনিই সব ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন কতো হাজার বছরের তিক্ততা এই নারী সম্পর্কের সাথে! যেন মা-বোন-প্রেমিকা-স্ত্রী-কন্যা বলে কোনো শব্দই কোথাও আর বিরাজ করে না।

এই দেশে যেকোনো হত্যা, রাহাজানি, দাঙ্গাবাজি, দুর্নীতি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন বা অন্য
যে কোনও অপরাধের ঘটনাকে জায়েজ করতে সবার আগে নারীর চরিত্রকেই খুঁজে বের করে চিতায় চড়ানো হয়। যেন মেয়েটিকে পুড়িয়ে দিতে পারলেই সমাজ থেকে সমস্ত রকমের অসঙ্গতি দূর হয়ে যাবে! নারী এখানে একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে আছে সমাজের! যেন বা ‘ডাইনিদের বধ করে দাও’, এমন একটি নির্দেশের অপেক্ষায় আছে সবাই।

এইতো গেল সপ্তাহেই ‘আপনি নারীবাদী না, আমিই নারীবাদী’ শীর্ষক একটি বাহাস চলছিল অনলাইনে। অবদমিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এটাও একটা চাল। যেকোনো একটা ইস্যুকে উস্কে দিলেই হলো, মৌচাকে ঢিল মারার মতোন। দিকে দিকে গেল গেল রব উঠে গেল। ‘মেয়েরা মেয়েরা চুলোচুলি করে, আর পুরুষেরা দূরে বসে বাদাম চিবায়’-এরকমই তো অনেকটা। সাধারণ মেয়েদের বৃহত্তর সামাজিক অবস্থানের কথা না ভেবে শুধু শুধুই একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কিছুদিন গরম ছিল অনলাইন। চতুর, হীন আর দুর্বৃত্তদের অজুহাতের অভাব হয় না, তাই তলে তলে তারা একাট্টাও থাকে। অথচ একটা লড়াই হওয়া উচিত ছিল ঐক্যবদ্ধভাবে। ঐক্য থাকলে চট্টগ্রামের আকাশ-মিতুর ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মিতুকে জেলে থাকতে হতো না, দেশে মিটু আন্দোলনও মুখ থুবড়ে পড়তো না, আর আজকে বরগুনার সেই মেয়েটিও এমন বিষবাক্যে জর্জরিত হতো না। ঐক্যটা জরুরি ছিল। তাহলে অন্তত ভয় পেতো মানুষজন!

সুপ্রীতি ধর

এই যে দেশজুড়ে এতো ধর্ষণ, এতো যৌন হয়রানি, এতো নারী নির্যাতন, তবু এসবের বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে ওঠে না শুধুমাত্র এই কারণে, ঐক্যটা নেই বলেই, আর তাছাড়া এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ঘৃণিত এসব আচরণের কারণে। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করে এই সবকিছুর জন্য মূলত মেয়েরাই দায়ী এবং তাদের ধর্ষণ করা, হয়রানি করা, এসিডে পুড়িয়ে দেয়া, মারধোর করা, কুপিয়ে মারা, ধর্ষণের পর হত্যা করা অথবা নিদেনপক্ষে গৃহছাড়া করা সব ঠিকই আছে। তাই প্রতিটা ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি বা নারী নির্যাতনের পর প্রথমেই আঙুল ওঠে নিপীড়িত মেয়েটির দিকে। সবাই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসে যায় মেয়েটির চরিত্র ঠিক ছিল কিনা, মেয়েটির পোশাক ঠিক ছিল কিনা, মেয়েটির চালচলন ঠিক ছিলো কিনা, মেয়েটির কোন প্রেমিক বা পরকীয়া ছিলো কিনা!

আজ যখন অনেককেই বলতে শুনছি, এমনকি নিজেও বলেছি যে ঘটনাস্থলে উপস্থিতদের নিষ্ক্রিয় ছিল কীভাবে, আসলে ওরা নয়, সহমত গোষ্ঠী বা অজুহাত গোষ্ঠী অথবা মেয়েদের একহাত নিতে পারা গোষ্ঠীই দিনশেষে বাঁচতে দেয় না রিফাতদের। তা তারা আইনের লোক হোন, সরকারের নেতা হোন, সংসদ সদস্য হোন, সবই আপনারা।

আর সেকারণেই এই দেশে খুন হবে এবং হচ্ছেও। রিফাতের ঘটনার দিন, এবং আজকে-কালকেও আরও অনেকগুলো খুনের খবর আমরা জেনেছি। ধর্ষণের ভয়াবহতার খবর আমরা জেনেছি। এই আপনারাই এইসবের জন্য দায়ী। আপনারা প্রত্যেকেই একেকজন খুনি ও ধর্ষক।

শেয়ার করুন: