সপ্রতিভ নারী বরাবরই পুরুষতন্ত্রের চক্ষুশূল

নাঈমাহ তানজিম:

উচ্ছল, স্বতঃস্ফূর্ত, হাসিখুশী নারীদের পুরুষতন্ত্র কোনকালেই পছন্দ করেনি এবং করবেও না।

পুরুষতন্ত্রের শিকার মানবগোষ্ঠী চায়, নারী সবসময় তটস্থ থাকবে, সবসময় অপরাধবোধে ভুগবে, সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকবে, এবং এই তটস্থ অবস্থা, এই অপরাধবোধ, এই দুশ্চিন্তা সবসময়ই একজন পুরুষতান্ত্রিক মানুষকে নিয়ে হবে। এক্ষেত্রে পরিষ্কার বলে দেওয়া জরুরি যে পুরুষতান্ত্রিক মানুষ কিন্তু শুধুই পুরুষ নয়। যেকোনো নারীও যেমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা লালন করতে পারে, আবার অনেক পুরুষই পুরুষ হয়েও পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পা দেয় না।

নারীর খিলখিল হাসি, নারীর আনমনে গুনগুন গান করা, নারীর খোলাচুলে বাতাসে উড়ে বেড়ানো, এসবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। আর পুরুষতন্ত্রের শিকার যে কেউ হতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, ধর্মপ্রাণ বাবা যখন কিশোরী মেয়েকে, পাশের রুম থেকে উঁচু গলায় হাসতে শুনে বিরক্ত হোন, অথবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে যখন কোনো তরুণী গান গেয়ে উঠে এবং তাতে প্রতিবেশী আন্টিরা অতি সচেতন হয়ে তরুণীর মায়ের কাছে অভিযোগ করে, কিংবা সদ্য বিয়ে হওয়া ছেলের বউকে চুল ছেড়ে অফিস থেকে ফিরতে দেখলে শাশুড়ি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে দুইকথা শুনিয়ে দেন।

নাঈমাহ তানজিম

খেয়াল করেন, এখানে কিন্তু আপনজনরা এবং নারীরাই পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করছে। কিন্তু কেন করছে? কারণ তারা নিজেরাই পুরুষতন্ত্রের শিকার। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এইসব নিয়ম সবই পুরুষ দ্বারা নির্মিত, পুরুষ দ্বারা পরিচালিত, এবং নারী-পুরুষ উভয় দ্বারা লালিত-পালিত। এখন এটাই হয়ে গেছে নিয়ম এবং স্বাভাবিক।

তাই যখন নারী এতো নিয়মকানুন আর চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে নিজের আনন্দের সবটুকু দিয়ে খিলখিল করে হাসতে চায়, সে হয় ছেলেভুলানো ডাইনী। যখন নারী গলা ছেড়ে গান গায়, তাকে সংযত হওয়ার দোহাই দিয়ে চুপ করানো হয়। বসন্তের বাতাসে যখন নারীর খোলাচুল উড়ে বেড়ায়, তখন ধর্ম ও পর্দার দোহাই দিয়ে তার চুল ঢেকে দেওয়া হয়।

এসবই করা হয় নারীর স্বতঃস্ফূর্তটাকে মলিন করার জন্য। কেউ সজ্ঞানে করে, কেউ না জেনেই করে। যারা না জেনে করে তারা সাধারণত ধর্মের ভয়ে, ‘লোকে কী বলবে’ র ভয়ে, ‘আমরা তো এসব মেনেই চলেছি, ও কেন মানবে না?’ এইসব চিন্তাধারা থেকে করে।

আর যারা সজ্ঞানে করে, তাদের থেকে শত হাত দূরে থাকবেন। এরা প্রথমত নারীকে ভয় পায়, নারীর নতুন জন্মদান করার ক্ষমতাকে ভয় পায়, সেই ভয়কে ধামাচাপা দিতে গিয়ে তারা নারীকে অনুভব করাতে চায় যে সে অধীনস্থ। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ এদের দ্বারাই রচিত। যেখানে নারীকে বারবার পুরুষের অধীনস্থ বলা হয়েছে, দাসী বলা হয়েছে, আমানত সম্পত্তি বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত এরা চায় নারী সবসময় অপরাধবোধে থাকুক। এরা নারীকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, নারী শারীরিকভাবে পুরুষের থেকে দুর্বল, নারীর কাজ ঘরে আর পুরুষের বাইরে। এতে নারী কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারায়। ফলে তার যাবতীয় প্রয়োজনে তাকে হাত পাততে হয়, এবং তখন সে একজন দাসীর মতনই অপরাধবোধ এবং গ্লানিতে ভুগে। আবার যেহেতু সে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয় এবং অন্যদেরকে খুশি রাখতে হয়। যার উপর সে নির্ভরশীল, তাকে খুশি রাখতে হয়। তা সে বাবা-ভাই-স্বামীই হোক, আর মা-বোন-শাশুড়িই হোক। যেই তাকে বাইরে কাজ করতে না দিয়ে ঘরে আটকে রাখে, তাকেই সবসময় ‘জ্বি হুজুর’ বলতে হয়। আবার ‘ইয়েস স্যার’ বলতে কোনও ভুলত্রুটি হলে তটস্থ থাকতে হয়।

তবে এখন কিন্তু আমরাও চালাক হয়ে গেছি। এখন তুমি যতই চোখ রাঙাও না কেন, আমরা আরও উচ্চস্বরে হাহাহিহি করবো, রাত ৩টা বাজে হেড়ে গলায় গান গাইবো এবং কোনদিন ইচ্ছা হলে রাঙানো এলোচুলে গোটা শহর টইটই করবো, আবার যেদিন মাথায় তেল দেওয়া থাকবে, সেদিন পরহেজগার সেজে মাথায় ঘোমটা দিবো।

হে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তুমি কচুপোড়া খাও।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.