আগে তুমি মানুষ হও, তারপর পিতা

শাহানা লুবনা:

ছোটবেলায় খুব আগ্রহ নিয়ে টিভিতে একটি অনুষ্ঠান দেখতাম। যার নাম ‘নতুন কুঁড়ি’। শিশুদের অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান। সে সময় আমরা যারা শিশু ছিলাম তাদের অনেকেরই অন্তরে আজও সেটি গেঁথে আছে। সেই অনুষ্ঠানের একটি থিম সং বা সূচনা সঙ্গীত ছিল। ‘আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন নন্দনে……।’ কবি গোলাম মোস্তফা রচিত সেই গানের একটি লাইন ছিল,’ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। সে সময় এই লাইনটির অর্থ বুঝতে পারিনি। কৌতুহল হয়েছিল জানতে। পিতা কেন, কীভাবে শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকে!

জীবনে প্রথম যখন সন্তান জন্ম দিলাম, মা হলাম, তখন এই লাইনটির যথার্থতা বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম মা হওয়া যতটা সহজ, বাবা হওয়া ততটা সহজ নয়। জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। বাবা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

সন্তান জন্মদানে মায়ের ভূমিকাই বেশি। মা তার শরীরের সমস্ত নির্যাসটুকু দিয়ে দশ মাস দেহের ভিতর একজন সন্তানকে লালন পালন করেন এবং একটি কষ্টকর শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন। এক্ষেত্রে একজন বাবার ভূমিকা কেবল একফোঁটা স্পার্ম বা শুক্রাণু দান।
ফলে একজন সন্তান জন্মের পর থেকেই তার নাড়ির টানে মাকে খুব সহজেই চিনতে পারে। মায়ের শরীরের গন্ধ, মায়ের সকল অনুভূতি সে বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে এটিই তার মা।

অপরদিকে বাবা নামক অস্তিত্বটি তার মধ্যে সুপ্ত থাকে, ঘুমিয়ে থাকে। তাকে জাগাতে হয়। তবেই সে বাবা, তবেই সে পিতা। বিষয়টি অত সহজ কাজ নয়। অনেকে অবশ্য অল্প সময়ে কাজটি করতে পারে। অনেকের বছরের পর বছর লেগে যায়। আবার অনেকে সারা জীবনেও পারে না কিংবা চায় না। কেবল জন্মদাতা হয়েই থাকে। যাস্ট লাইক অ্যা স্পার্ম ডোনার। এ সমাজে এমন অনেক আছে, আমার আপনার সকলের চারপাশে।

সেদিন রিকশা করে যাচ্ছিলাম। জ্যামে বসে আছি। পাশের রিকশায় তাকিয়ে দেখি ছোট্ট একটি পরিবার। বাবা মা এবং তাদের আট/দশ মাসের একটি কন্যা সন্তান। বাবা তার কোলে পরম যত্নে কন্যাটিকে আগলে ধরে আছেন। ফুটফুটে বাচ্চাটি বাবার কোলে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু সে তার কোমল হাতটি দিয়ে মায়ের একটি আঙ্গুল শক্ত করে চেপে ধরে আছে। দৃশ্যটি দেখে মনে হলো বাবা তার নির্ভরতার জায়গাটি হয়তো এখনও অর্জন করতে পারেনি। জাগাতে পারেনি শিশুটির মনে বাবার অস্তিত্ব, বাবার বিশালতা। হয়তো একদিন এই বাবাই হবে শিশুটির সবথেকে বড় নির্ভরতার স্হান। সেদিন হয়তো সে নিজের অজান্তেই গাইবে, “মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না আয় খুকু আয়…”।

আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মায়ের লালন পালন এবং বাবার আদর্শ নিয়েই একজন সন্তান বড় হয়। এটিই এ সমাজের বাস্তবিক, চারিত্রিক রূপ। ফলে এর প্রেক্ষাপটে একজন বাবাকে প্রথমে মানুষ হওয়া জরুরি, তারপর জন্মদাতা এবং পরে পিতা।

অনেক পরিবারে দেখা যায় বিপথে যাওয়া সন্তানকে শোধরানোর বিকল্প পথ হিসেবে বেছে নেয় তাকে বিয়ে করিয়ে দেয়া। যদি সে সংসারের মোহজালে আবদ্ধ হয়ে শুধরে যায়, মানুষ হয়। কিন্ত এই ‘যদি’ শব্দটি মানায় কেবল লটারির টিকিট কেনা বা জুয়া খেলায়। যদি লেগে যায়, যদি পেয়ে যাই। জীবন তো কোনো জুয়া খেলা নয়। আপনার এই ‘যদি’ চিন্তা যে কতগুলো জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে, সেটা কি ভেবে দেখেছেন?

যে সন্তানকে দুই যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে অভিভাবক বা পিতা মাতা হিসেবে আপনি বা আপনারা সুপথে আনতে পারেননি, মানুষ করতে পারেননি, তাকে কি করে ভিন্ন পরিবার থেকে আসা একটি মেয়ে সুপথে আনবে, মানুষ করবে? আপনার ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার চিন্তা কি আপনার চলার পথটিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে না? সুপথে আনতে আপনি নিজেও বিপথ অবলম্বন করলেন! কেবল নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্যে, নিজের সন্তানের জন্যে।

এই সন্তানই একসময় জন্মদাতা হয়। হতে পারে না পিতা কিংবা বাবা। বঞ্চিত হয় জন্ম নেয়া শিশু সন্তান পিতার আদর্শ, পিতার স্নেহ থেকে। যে অন্যায়ের বীজ পরিবারটি একসময় বপন করে তার বিষাক্ত রসে আস্বাদিত হয় গাছটির ডালপালা, ফুল, ফলও। যে সমাজ পিতার পরিচয়ে সন্তানের বেড়ে ওঠাকে প্রাধান্য দেয় সে সমাজে এই সন্তানেরা তখন বৈরিতার মুখোমুখি হয়। নিষ্পেষিত হয় মানসিকভাবে। সেক্ষেত্রে দায়ী কেবল জন্মদাতাই নয়, তার পুরো পরিবার…।

শুধু তাই নয়, এমন অনেক পরিবারও আছে যারা সন্তানের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে প্রত‌্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেন। সন্তান নেশাখোর, বহুগামী কিংবা ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তেমন কিছু যায় আসে না। ছেলে মানুষের এমন একটু আধটু থাকতেই পারে মন্তব্য ছুঁড়ে অভিভাবকের গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

সমাজকে কুক্ষিগত করে রাষ্ট্রকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে এরাই বাড়িয়ে তুলছে অপরাধের চত্বর। এহেন গুণধর সন্তানদের আবার অন্যের জীবনের সাথে জড়িয়ে ধ্বংস করছে নিরপরাধ আরও কতগুলো জীবন।

কিন্তু প্রকৃতি তার বিরুদ্ধাচরণ কখনও মেনে নেয় না। যে বিষাক্ত বীজ একসময় তারা বপন করে, তার বিষাক্ত অনলে তাদেরও একদিন পুড়ে মরতে হয়।
ইতিহাস তাই বলে…..।।

কাজেই সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। সে যেন তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেকে একজন মানুষ, একজন আদর্শ পিতা হিসেবে তুলে ধরতে পারে। পরিবার নামক একটি পবিত্র স্হান যেন সে তার সন্তানের জন্য তৈরি করতে পারে। এবং তার ভিতটিও হয় যেন মজবুত।

না হলে একদিন সন্তানেরাই আঙ্গুল তুলবে তার দিকে…। চিৎকার করে বলে উঠবে, “আগে তুমি মানুষ হও, তারপর পিতা…”।

সময় এসেছে সমাজকেও শোধরানোর, বদলানোর। যে বিষাক্ত কালো ছায়া সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।
গর্ভধারিণী রানীর পুত্র বা কন‌্যার নামকরণ রাজপুত্র, রাজকন্যার অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে সজীবতা ফিরিয়ে আনতে হবে। যেন আগামী প্রজন্মের প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাস হয় সজীব, প্রাণবন্ত……।

শেয়ার করুন: