‘ম্যারিটাল রেপ’ সামাজিক ভদ্রতার আড়ালে এক ভয়াবহ ব্যাধি

শাহরিয়া খান দিনা:

বিবাহপূর্ব কিংবা বিবাহ বহির্ভূত রেপ যতটা গুরুত্ব পায়, বিবাহ পরবর্তী স্বামী কর্তৃক রেপ ততটাই উপেক্ষিত হয় এ সমাজে। সহজ কথায় ‘ম্যারিটাল রেপ’ হচ্ছে স্ত্রীর সাথে জোর করে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া বা এমন পরিস্থিতিতে দৈহিক সম্পর্ক করা, যা অন্য কোনো মেয়ের সাথে করলে তা রেপ হিসেবে গণ্য হতো।

বিয়ে মানেই যেন একটা নারীদেহের উপর লিখিত অধিকার পেয়ে যাওয়া। যৌন সঙ্গমে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কী যায় আসে! বাসর পরবর্তী দিনে নতুন বউটি যখন খুঁড়িয়ে হাঁটে, স্বামী নামক লোকটা পুরুষত্বের গর্বে বুক ফুলিয়ে চলে, আর আশপাশের সবাই মুখ টিপে হাসে। মেয়েটার অভিজ্ঞতা যদি ভয়াবহ হয়, তবুও তা বলা হয় না। আসলে আমাদের এখানে সেক্স নিয়ে শিক্ষা তো দূরে থাক, কথা বলাটাও ভালো চোখে দেখা হয় না। যার ফলে একটা অতি আনন্দময় উপভোগের বিষয়টাও জঘন্য অত্যাচারে পরিণত হয়।

বাঙ্গালি মেয়েদের সেক্স বিষয় আলোচনায় মুখ ফুটে তো বুক ফাটে না আর পুরুষদের সমস্যার মূল হলো সেক্স এডুকেশন মানেই পর্নো। পর্নো কখনোই শিক্ষা না, বরং উত্তেজক। ক্যামেরায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ধারণ করা দৃশ্য এডিটিং টেবিলে কাটছাঁট করে একসাথে জুড়ে দেয়া সিনেম্যাটিক ব্যাপার।

সম্প্রতি পরিচিত এক মেয়ে বিয়ের দুই মাসের মাথায় ডিভোর্স দিয়েছে স্বামীকে মানসিক অসুস্থ বলে। কারণ স্বামী তাকে পর্নস্টারদের মতো নয় কেন, ওরা পারলে তুমি কেন পারবা না ইত্যাদি বলতো এবং বাধ্য করতো।

সেক্স সহজাত স্বাভাবিক চাহিদা। এর সাথেই আসে অর্গাজম। অর্গাজম শব্দের বাংলা রাগমোচন। (গ্রীক οργασμός orgasmos থেকে, অর্থ “উত্তেজনা” বা “উচ্ছ্বাস”। বোঝানো হয় যৌন প্রতিক্রিয়া চক্রে পুঞ্জীভূত যৌন উত্তেজনার আকস্মিক ভারমুক্তি। নারী এবং পুরুষ উভয়েরই রাগমোচন ঘটে থাকে। এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন ব্যাপক, তেমনি বহু মানসিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন প্রোল্যাকটিন নিঃসরণের ফলে নিস্তেজ অবস্থার সৃষ্টি হওয়া, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাময়িক পরিবর্তন যেমন সেরেব্রাল কর্টেক্স এর একটি বড় অংশের মেটাবলিক বা শ্বসনিক কার্যক্রমের অস্থায়ী হ্রাস, যেখানে মস্তিষ্কের লিম্বিক অঞ্চলে মেটাবলিক কার্যক্রমের কোন পরিবর্তন ঘটে না বা বৃদ্ধি পায়।

রাগমোচন বিষয়ক যৌন সমস্যার পরিধিও বড়। রাগমোচনের পরবর্তি সময়টি (একে রিফ্র্যাক্টরি পিরিয়ডও বলা হয়) একটি নিস্তেজ পরিস্থিতি যার মূল কারণ হলো অক্সিটোসিন, প্রোল্যাক্টিন এবং এন্ডোরফিনস নামক নিউরো হরমোনের নিঃসরণ।

১৯৯০ এর আগে ধরা হতো স্কুয়ার্টিং সবাই পারে না, ৩% মহিলা পারে, এরপর কন্ট্রোলড এনভায়রনমেন্টে দেখা গেলো ৯৩% ই পারে। ডাটা অনেক আছে, ১৯১৪ এর, ১৯৪০, ১৯৭৫ ইত্যাদি। ১৮৯০-১৯২৫ পর্যন্ত ডাক্তারদের কাছে হিস্টিরিয়া বলে যে অসুখ ছিলো তা পুরোটাই অর্গাজম এর জন্য। ১৯৫৩ তে মেডিকেল বোর্ড হিস্টিরিয়াকে অসুখের তালিকা থেকে বাদ দেয়। অর্গাজম একটা অধিকার, এটাকে রোগ নাম দিয়ে ঢাকার কোন অর্থ নাই, তাই।

সঙ্গমে শারীরিক, মানসিক রাসায়নিক প্রভাব নিয়ে এতোকিছু জানা-শোনা বা বুঝবার সময় কই? এদেশের বেশিরভাগ এরেঞ্জ ম্যারেজের ক্ষেত্রেই বিয়ের প্রথম রাতে মেয়েটা কেবল ধর্ষিত হয়। অনেকে এর থেকে স্বাভাবিক সম্পর্কে যেতে পারলেও কারো কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন মেয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে নিজের শরীরের চরম সুখের পুলক অনুভব না করে এক জীবন শুধুমাত্র স্বামীর ইচ্ছেয় কর্ম মেনে নিয়েছেন। চরম স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির যন্ত্রণায় তাকে ছেড়ে এলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ম্যারিটাল রেপ কোর্ট পর্যন্ত যায় না।

এমনকি ডিভোর্সের পরে যৌতুক কিংবা নির্যাতনের মামলা হলেও এই ব্যাপারটা উল্লেখ করে না। এই ধরনের রেপ যে অপরাধ, তা আবার অনেকেই জানে না! ক্রিমিনাল অফেন্স এর আওতায় ম্যারিটাল রেপও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আইন এর স্পষ্ট বিধান না থাকায় অনেক দেশেই এই রেপ ক্রাইম এর আওতাধীন না। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ম্যারিটাল রেপ আজগুবি গল্প, কিন্তু অনেক দেশেই এটা স্বীকৃত আইনি ইস্যু। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম মামলা হয় ১৯৭৮ এ, ইংল্যান্ডে। স্বামীর তিন বছর জেল হয়। পেপারে হেডিং ছিলো “Husband Jails for Raping Wife.”

বাংলাদেশে রেপের ব্যাপারে কি আইন আছে? এ বিষয় বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী কাজী ওয়াসীমুল হকের রেফারেন্স থেকে উল্লেখ করি, প্রথমে আছে আক্ষরিকভাবেই ব্রিটিশ আমলের দণ্ডবিধি (১৮৬০) এবং তারপর আছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় এবং নারী শিশু আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষনের সংজ্ঞা পাবেন। এই দুই আইনেই ‘ম্যারিটাল রেপ’ অস্বীকৃত হয়েছে, ছিটেফোঁটা যা আছে, তা হচ্ছে বয়স সংশ্লিষ্ট, যেমন দণ্ডবিধিতে পরিস্কার বলা আছে স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের নিচে না হলে স্বামী দ্বারা দৈহিক সম্পর্ক রেপ হবে না, আবার উপরোক্ত নারী শিশু আইনে আছে (বৈবাহিক সম্পর্ক থাকুক না থাকুক) ১৬ বছরের নিচে কোন মেয়ের সাথে সেক্স করলে তা রেপ হিসেবে গণ্য হবে। যারা জানেন না, একই বিষয়ে দুই রকম আইন থাকলে স্পেশাল আইনের বিধান কার্য্যকর হয়।

তো সোজা বাংলায় মানে কী দাঁড়ালো? মানে দাঁড়ালো, স্ত্রী যদি ১৬ বছরের উপরে হয়, তাহলে স্বামী যেভাবেই তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করুক না কেন, অন্য মেয়ের সাথে করলে যা রেপ হতো, নিজ স্ত্রীর সাথে তা করলে রেপ হবে না।

সময়ের বিবর্তনে পৃথিবী এগিয়েছে অনেক, দেশও এখন ডিজিটাল, তো সেখানে এই আইন নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত নয়। সময় এসেছে সংশোধনের, পরিমার্জনের। আর শুধু আইন নয় আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দরকার সহনশীল মন আর সঠিক শিক্ষার। স্বর্গীয় সুখের মতো একটা ব্যাপার জঘন্য অত্যাচারে পরিণত করায় কোন কৃতিত্ব নেই। একদমই নেই। একটা পরিপূর্ণ সঙ্গম আত্মতুষ্টির স্মৃতি হিসেবে একজীবন পার করে দেবার জন্য পর্যাপ্ত না হলেও প্রয়োজনীয় শর্ত নিশ্চয়ই।

শেয়ার করুন: