রূপকথার আলাদীন কেন আমাদের পাশের বাসায় থাকে না!

প্রমা ইসরাত:

জহিরের সাথে আমার দেখা হলো দশ বছর পরে। জহির আগের চাইতে সুন্দর হয়েছে দেখতে। আমি আগে খেয়াল করিনি। খেয়াল করে দেখলাম জহির বেশ লম্বা, শরীরের গঠন সুন্দর, পেটে হালকা মেদ আছে, কিন্তু বাঙালি পুরুষ হিসেবে এই শারীরিক গঠন সুন্দর।
জহিরের মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। নিশ্চয়ই তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা ছাদে মাল নেই বলে তাকে খ্যাপায়। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, নিচের ঠোঁট একটু মোটা, নাকটা একটু থ্যাবড়া। জহিরকে দেখে আমার ভালো লাগলো। বেশ ভালো লাগলো। প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে কোন একদিন আমার মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে একটা টেক্সট এসেছিলো, লেখা, বিয়ে করছি, আমি খুব সুখি, ভালো থাকবেন।
জহির বিয়ে করছে জেনে আমার ভালো বা খারাপ কিছুই লাগেনি। জহিরের বিয়ে করা না করা নিয়ে আমার কিছুই যায় আসেনি। আমরা ছিলাম দুই ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ।

প্রমা ইসরাত

দশ বছর আগে ভার্সিটিতে পড়ার সময় জহিরের সাথে আমার পরিচয় হয়। কোন এক কাজিনকে ভর্তি করাতে এসেছিলো। কেমন যেন অস্থির প্রকৃতির এক মানুষ। প্রচুর কথা বলছে আর প্রচুর ঘামছে। পুরু কাঁচের চশমার আড়ালে বড় বড় চোখগুলো দেখে আমার সেদিন মায়া লেগেছিলো খুব। বাচাল মানুষদের দেখলে আমার মায়া লাগে, আমার মনে হয় তারা নিজের কিছু একটা লুকোবে বলে অনেক কথায় অন্যদের ভুলিয়ে রাখে। জহির লুকিয়ে রাখতো নিজের অপারগতা।

জহিরের একটাই স্বপ্ন ছিলো, বিয়ে করা। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের সাথে শারীরিক সম্পর্কের ফ্যান্টাসিতে ভোগে, আশা করে প্রেম করবে, ঘুরবে, ফিরবে, মাস্তি করবে, কিন্তু বিয়ে করে ঘর করবে, সংসার করবে, এবং এটা হবে জীবনের স্বপ্ন, এমনটা আমি কাওকে এতো সরাসরিভাবে বলতে শুনিনি। আমি জহিরের কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম, এবং আমার সেদিনই মনে হয়েছিলো, আমরা বাস করি ভিন্ন দুটি পৃথিবীতে।

আমার জহিরের ছোটবেলায় দেখতে ইচ্ছে হয়েছিলো সেদিন। তাঁর মা তাকে আদর করে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে, আর বলছে লক্ষ্মী বাবা ভাত খাও, একদিন তুমি কত্ত বড় হবে, তোমাকে পরীর মতো বউ এনে দিবো। কিংবা জহিরের ছোটবেলায় জহির এতো আদর পাচ্ছে না, সে দেখছে তাঁর বাবা মা কেবল ঝগড়া করছে। শুধু দ্বন্দ্ব হচ্ছে দ্বন্দ্ব। জহিরের সরকারি কর্মকর্তা বাবা বারবার করে তাঁর মাকে বলছে, “চাকরির দরকার নেই, তুমি তোমার চাকরি ছেড়ে দাও, আমার সাথে চলো”।

জহির হয়তো সেই সকল ঝগড়াকে ভুলে মনোযোগ দিয়ে খেলছে ভিডিও গেইম। তাঁর জীবনে কোন ঝগড়া, জটিলতা নেই, কোন চাপ নেই, বাইরে গিয়ে খেলার যেহেতু তাঁর অনুমতি নেই, সে খেলছে ভিডিও গেইম। সেই ছোট্ট জহির কি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতো, তাঁর হবে এমন এক সংসার, যেখানে কেউ ঝগড়া করবে না! কোন গালিগালাজ, বকা চলবে না! সবাই একজন আরেকজনের সাথে কথা বলবে হাসিমুখে। একজন আরেকজনকে আদর করে জড়িয়ে ধরবে। সবাই একসাথে থাকবে। তাঁর একটা বউ হবে, যে হবে তাঁর জীবনের বন্ধু, তাঁর সঙ্গী, তাকে নিয়ে ভাববে, তাঁর জন্য ভাববে।

জহিরকে নিয়ে ভাবতে বসে আমার মনে হতো, জহির কেন আমার মতো নয়! কিংবা আমি কেন জহিরের মতো ভাবতে পারি না! আমার মনটা কেন বোহেমিয়ান! আমার কেন ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করে না!
আমার ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করে না। আমার পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে, আমার ইচ্ছে করে সমুদ্রে যেতে, আমার ভালো লাগে খোলা আকাশ, আমার ভালো লাগে নদী আর সবুজ, আমার ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে বনে, গাছে ঝুলে থাকা থোকা থোকা ফুল দেখে বলতে ইচ্ছে করে, কী সুন্দর! এক ঝাঁক পাখির উড়ে যাওয়া দেখে বলতে ইচ্ছে করে কী সুন্দর! এক আকাশ তারা দেখে অবাক হয়ে বলতে ইচ্ছে করে, কী সুন্দর!

জহিরের সাথে দশ বছর পর দেখা হওয়াটা অবাক করা একটা ব্যাপার। যখন শুনলাম, জহির যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিলো, তাঁর সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, আমার খারাপ লাগলো। কারণ জহির বিয়ে করছে, সেটা সে আমাকে জানিয়েছিলো, এবং সে লিখেছিলো সে খুব সুখি। ততদিনে আমি জেনে গেছি, ডিভোর্সের আসল কারণ আসলে বিয়ে।

আমার জহিরের জন্য খুব মায়া লাগলো। একটা মানুষের স্বপ্ন ভেঙে গেলে তাঁর ভেতরের জীবনটা মরে যায়। জহির সবার সামনে নিশ্চয়ই কাঁদে না। সমাজ তো শিখিয়েছে, পুরুষ মানুষকে শক্ত হতে হয়, পুরুষ মানুষকে খুব ধৈর্য্য ধরতে হয়। কিন্তু জহির হয়তো একা একা কাঁদে। তাকে কি তখন কেউ জড়িয়ে ধরে?

আমি জানি না। আমার জহিরকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিলো। না, ওটা এই পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির, ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ির কালো মোটা ফ্রেমের জহির না। ওই ছোট্ট জহির, যে স্বপ্ন দেখতো, তাঁর একটা নিজের সংসার হবে, তাঁর একটা মিষ্টি, লক্ষ্মী বউ হবে। তাঁর একটা জীবনসঙ্গী হবে, যে তাঁর সাথে থাকবে, তাকে বুঝবে, ভালোবাসবে।

আমার বুকের একটা অংশ কেঁপে উঠলো, ভেতরে জহিরের জন্য মনটা কেঁদে বলে উঠলো, আমি যদি তোমার পৃথিবীর হতাম।

জহির এর স্বপ্নভঙ্গ আমাকে ছুঁয়ে গেলো, আমি ঘুমুতে পারলাম না। আমার কষ্ট হলো। আমার রাগ হলো, কেন জহির একটুও আমার মতো ভাবতে পারে না। কেন জহিরের একবারও বোহেমিয়ান হতে ইচ্ছে করে না। জহিরের কেন ইচ্ছে করে না আমার সাথে পাহাড়ে যেতে।

আমি জহিরের জন্য ভাবি। আমি ভাবি, একটা সুন্দর মিষ্টি হাস্যোজ্জ্বল সংসার জহিরের হবে। স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা অতিক্রম করে সে আবার বাঁচবে। জহির ভালো থাকবে। আরো বছর দশেক পরে, আবার আমাদের দেখা হবে, আমরা দুটি ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ দূর থেকে হাত নেড়ে যাবো হাসিমুখে।

কিন্তু আমার ভেতরের রূপকথারা তবু কেন লিখতে চায় আশ্চর্য গল্প?
রূপকথার আলাদীন কেন আমাদের পাশের বাসায় থাকে না?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.