ফারহানা আনন্দময়ী:
প্রত্যেক মানুষেরই একটি নিজস্ব আকাশ থাকা খুব প্রয়োজন। যে আকাশে তার ভাবনাগুলো ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে…কখনো ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলা চপলা চড়ুই’এর মতো, কখনো স্থির চিলের মতো। সাথে একটা নিজস্ব বৃক্ষ থাকলেও খুব ভালো হয়। ক্লান্ত মনটা সেই সবুজ বৃক্ষের নিচে শ্বাস নেবে, ছায়া নেবে, মনের বড় আরাম হতো …তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একটা নিজস্ব আকাশ আর সবুজ ডালপালা বিছানো বৃক্ষ থাকলে আমাদের কারোর ভেতরটা কখনো নিঃসঙ্গ বোধ করতো না। নিজের ভাবনা, আপন চিন্তা ও চেতনার মতো বিশ্বস্ত বন্ধু তেমন করে আর কেউ হয় না।
কবি বলেছেন, “একলা চলো রে…।” একলা চলাই যায়, ক্লান্তিহীন হয় সেই পথ চলা… যদি আপন আকাশটা আমায় রোদ্দুর দেয়, বৃষ্টি দেয় আর ওই যে মনের অদূরে উঠোনে দাঁড়ানো বৃক্ষটা- সে যদি ছায়া দেয়। সেই আকাশ আর সেই বৃক্ষটা আর কিছু নয়, তা হলো আত্মনির্ভরশীলতার মাটিতে দাঁড়িয়ে গড়া নিজস্ব এক জগৎ।
এই প্রসঙ্গে একটু আমার মায়ের কথা বলি। কোনোদিন তিনি নিজের জন্য একটা সেই আকাশ খোঁজার কথা ভাবেননি, তাই বোধ হয় সেই চেষ্টাও তিনি করেননি। স্বামী, কন্যা, বিপুল আয়তনের যৌথ সংসারের অন্য সকলের ইচ্ছের, চাওয়ার ডানা মেলতে মেলতে কখন যে নিজের অজান্তে নিজের ওড়ার ডানাটি ভেঙেছেন নিজেও জানেননি।
সেই সময়ের মেয়েদের বা মায়েদের একমাত্র দায়িত্বই কি ছিল শুধু নিজেরটা ছাড়া বাকি সকলের মনের আনন্দ-কুসুম ফোটানো ? বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন, সাহিত্যে আনাগোনা ছিল… কিন্তু সংসারের দায় মেটাতে কখনো মা’কে মনের দাবী মেটাতে দেখিনি। ছিলেন কন্যা, হলেন বধূ, শেষে মাতা…কত শত পরিচয়ে আঁকা তাঁর জীবনগাথা। এতো পরিচয়ের হট্টগোলে ‘আমি’ সেই আসল পরিচয়টাই বারবার হারিয়েছে…কখন হারিয়েছে টেরও পাননি।
আমার মা বলতেন, ‘আমরা, নারীরা, প্রত্যেকটি নারীই কী দারূণ প্রতিভাবান সুঅভিনেত্রী।’…ভাবতেই অবাক হতে হয়। কারো মেয়ে, কারো বন্ধু, কারো স্ত্রী, কারো মা, কারো পুত্রবধূ, কারো বোন- আরো কত চরিত্র… কত চরিত্রই না আমাদের নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে হয় জীবনের মঞ্চে। মা কী কখনও ভেবেছিলেন, এই দ্বৈত অভিনয় বা যৌথ অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের মনের মঞ্চে একটা একক অভিনয়ের মঞ্চও সাজাতে হয় ! যে মঞ্চে আমি পছন্দ মত সময়ে প্রবেশ করতে পারি, মন চাইলে অভিনয় করতেও পারি, আবার না চাইলে মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও আমার কাছেই থাকবে। কোন কাজ করবো আর কোনটা নয়, মন যোগাবো, না মন জাগাবো সেই সিদ্ধান্ত আমিই নেবো… মা, জেনেছি, এর নামই তো স্বাধীনতা; মুক্তি।
আজ যখন কোনো একলা দুপুরে উদাসী স্বরে কোন আক্ষেপ না লুকিয়ে মা আমায় বলেন, “ভুলই বোধ হয় করেছি জীবনভর। নিজের করে কিছুই রাখলাম না। নিজের একটা স্বতন্ত্র পরিচয়, সেটাও না।” ঠিক তখুনি বুকের ভেতরটা কুকড়ে ওঠে বেদনায়… ম্লান ধূসর এক অব্যক্ত বেদনা ! মা’কে বলি, মা, এতোদিনে ? সময়ের অনেক পরে এসে তুমি সময়ে ফিরতে চাইলে মা। কতোবার তোমায় বলেছি তোমার জীবন তোমার আর আমাদের জীবন আমাদেরই… শুধু আমি আর আমাদের সকলের জন্য তুমি জীবনপাত কোরো না। তুমি করেছিলে কী ? তোমার জীবনটা সকলের ক’রে দিয়েছো। আজ দিনশেষে এসে যখন ভেতরপানে চোখ মেলে চাইছো, কোথাও একটুকরো আকাশ দেখছো না যে তোমায় রোদ্দুর দেবে, যে তোমায় এক ফোঁটা বৃষ্টি দেবে। মন হাতড়ে একটা সবুজ বৃক্ষও খুঁজে পাচ্ছো না, যে তোমার একলা সময়কে ছায়া দেবে। তোমার একাকীত্ব আমায় কষ্ট দেয় আজ, তোমার বিষন্ন একাকী মুখ ব্যথিত করে তোলে আমার মনকে।
এই মাতৃত্ব আর সংসারের প্রতি ত্যাগস্বীকারকে এই সমাজে যুগে যুগে যতই মহিমান্বিত করা হোক না কেন, এ আমার দৃষ্টিতে পুরুষশোষিত সমাজে আমাদেরই পাতা এক নির্মম ‘ফাঁদ’। যে ফাঁদে তোমার মত মায়েরা মমতার টানে নির্দ্বিধায় পড়ে যায়। নারীশক্তি কেবল মমতা আর ভালোবাসার নয়। নারীকে তার শক্তি নিয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াতে হয় আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মাধ্যমে। মায়েরা যেন বোধের গভীরে ততটুকু আত্মবিশ্বাসী হন, যতটা হলে সন্তানকে দৃঢ়চিত্তে বলতে পারেন, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।” মায়েদেরও চিন্তার মুক্তি প্রয়োজন, এই ভাবনাটাই তোমার ভাবনায় কখনো আসেনি। তুমি সন্তান আর সংসারের মায়ায় মুক্তি পাবে ভেবেছিলে। মুক্তি কি আসলো? পিতৃতান্ত্রিকতার দাসত্বে এক বন্দীজীবন পার করলে।
সন্তানস্নেহ, আদর, মায়া, ভালোবাসায় তুমি তুলনাহীনা। তবে সন্তানের কঠিন সময়ে তার হাতটা শক্ত ক’রে ধরতে তুমি কোথাও যেন দ্বিধাগ্রস্ত। জীবনভরই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছ। কখনো ভালো লাগতো না এই বিষয়টা আমার। তোমার যাপন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম খুব সচেতনতায়। তাই নিজের জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে আর ভুল করিনি, মা। তাই তো, কন্যাকে আজ দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি, “কন্যা, বাঁচো নিজশর্তে।”
আজ প্রশ্নটা তোমার কাছেই, কেন তুমি কেবলই সংসার-পরায়ণ স্ত্রী আর মমতাময়ী মা-ই হতে চেয়েছিলে জীবনভর? তোমার কি কোনদিনও একটুও ‘তুমি’ হতে ইচ্ছে করেনি? অথচ এই তোমরা তো আমাকে ‘আমি’ হয়ে-ওঠার সুযোগ দিয়েই বড় করে তুলেছিলে। তবে কি তোমার ভেতরের মানুষটি কখনো অন্তরাত্মা ছুঁয়ে তোমায় বলেনি, ‘প্রিয় সখা আমার, তুমিও একজন ‘তুমি’ হয়ে বাঁচো,আকাশ, রোদ্দুর, বৃষ্টি আর সবুজকে ছুঁয়ে।’ আমি নিশ্চিত জানি, ফিরে যদি জীবনটাকে আবার প্রথম থেকে পাও, বন্ধনেও মুক্তি থাকবে তেমন এক জীবন তুমি বেছে নেবে।
মা, তোমাকে ভালোবাসি বলেই আজ এ কথাগুলো বলা। দিনশেষের তোমার এক বেদনাহত মুখ আমাকে ব্যথিত করে বলেই তোমার হাত ধরে থাকা।