মায়েরা থাকুক আলোয় আলোয়

ইলা ফাহমি:

আমার মা এই বিশাল পৃথিবীতে পাঁচশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট দুইরুমের বাসায় গত পঁচিশ বছর কাটিয়ে দিলো। সন্তানদের আত্মনির্ভরশীল, শক্ত, সক্ষম একটা জায়গায় দেখবার স্বপ্নেই সে কাটিয়ে দিয়েছে একটা গোটা জীবন। আমাকে জন্ম দিয়ে মায়ের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিলো। অথচ আমারও মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার বাতিক আছে।

আমি স্বপ্ন দেখি আমার মা কুয়াশাজড়ানো ভোরে শিউলি ফুল কুড়োচ্ছে, ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাচ্ছে, সন্ধ্যেয় বই নিয়ে বসেছে পড়ার টেবিলে, অংক বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই রেখে গোগ্রাসে গিলছে শরৎ কিংবা ইলিয়াস। আরেকটু বড় হয়ে সে দুনিয়া ঘুরতে বের হবে, ছোট দু’রুমের বাসাটাই তার দুনিয়া হবে না! আমার মায়ের প্রেমিক থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ ধরে হেটে যাবে দুটো তরতাজা যুবক-যুবতী। আমার মা স্লোগানে স্লোগানে ভরিয়ে তুলবে ব্যানার ফেস্টুন, তার চিৎকারে নড়ে উঠবে দালালের মগজ। আমার মা ফুলের ডালি হাতে একুশের ভোরে শহীদ মিনারে ফুল দেবে, আমার মা গান গাইবে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’।

আমি স্বপ্ন দেখি আমার মা নতুন জীবন শুরু করেছে পছন্দের মানুষের সাথে। সেখানে গৃহস্থালি শ্রমের সুষম বন্টন আছে, আছে অর্থনৈতিক সুষম স্বাবলম্বিতা, আছে মত প্রকাশের শ্রদ্ধা ও স্বাধীনতা। আমার মা দর্শন নিয়ে তর্ক করবে, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করবে, মানুষের জন্য মানুষের পাশে বসবে মানুষ হয়ে। তারপর আমার জন্মের পর দুইহাতে তুলে হাসিমুখে বলবে-‘সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যই একমাত্র মানুষ জন্ম জরুরী’।

আমাকে লালনপালনেও দায়িত্বের সুষম বিন্যাস থাকবে। আমি স্বপ্ন দেখি আমার জন্য আমার মা নিজেকে এবং নিজের স্বপ্নকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করছে না, কারণ এ রাষ্ট্র আমার মা’কে মুক্তি দিয়েছে মহিমান্বিত ত্যাগের শেকল থেকে। আমি বেড়ে উঠছি আমার মায়ের ঘ্রাণে এবং আদর্শে।

মা মানেই শুধু ঘাম আর দুধের ঘ্রাণ নয়, মা মানেই সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করা নয়। মা মানে মতাদর্শও, মা মানে প্রতিবাদ, মা মানে একুশের গান, মা মানে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, মা মানে আত্মনির্ভরশীলতা, মা মানে জ্ঞান প্রজ্ঞা দর্শন।

যেসব মানুষ ‘ত্যাগে মহিমান্বিত বাঙালি মাতৃত্ব’কে নিয়ে গর্ব করে এবং সেভাবেই মা নামক নারীদের দেখতে চায়, তাদেরকে আমার মা উচ্চস্বরে বলবে -‘মায়ের এতো ত্যাগের ওপর বীরদর্পে দাঁড়িয়ে বাঙালী কতটুকু সভ্য শিক্ষিত উন্নত হতে পেরেছে? আমাকে এতো গ্লোরিফাই করার কোন দরকার নেই। পৃথিবীকে এগিয়ে নেবার জন্য যে মানুষের প্রয়োজন, তাকে মায়ের মহিমান্বিত ত্যাগের শেকলের ঝুমঝুমি শুনবার প্রয়োজন হয় না। বরং সেই মানুষ মা’কে মুক্ত দেখতে চাইবে ‘মা’ নামক পিতৃতান্ত্রিক দাসত্বের বন্দিশালা থেকে। সন্তান জন্ম দেয়াটা প্রাকৃতিক এবং সারাজীবন সংসার-সন্তানের জন্য নারীর ত্যাগ করে যাওয়াটা হলো ম্যানমেইড কালচার!’

মায়েরা থাকুক দুধে-ভাতে, মায়েরা হোক প্রজ্ঞা-জ্ঞানের আলো, মায়েরা হোক আত্মনির্ভরশীল, মায়েদের চিন্তার মুক্তি ঘটুক, মায়েদের আসুক স্বাধীনতা।

শেয়ার করুন: