পারিশ্রমিক পেলে কি গৃহিনীদের সম্মান বাড়বে?

বৈশালী রহমান:

আমি ইদানিং অনেক সচেতন মানুষকেও বলতে শুনছি, গৃহকর্ম সম্পাদনের জন্য গৃহিণীদের পারিশ্রমিক দেওয়া প্রয়োজন। অনেকেই বলেন, এই পারিশ্রমিক দেওয়ার কারণে নাকি গৃহিণীদের সম্মান বাড়বে। কিন্তু আমার কাছে সংসারের কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেওয়ার বিষয়টাকে নারীর জন্য খুব সম্মানের মনে হয় না। কারণগুলো এক এক করে বলছি।

১। কাজের বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক গৃহিণী নেবেন, সেটা কার কাজ? অন্যের ঘরের বা প্রতিষ্ঠানের কাজ কি? না, সেটা তাঁর নিজের সংসারের কাজ। অর্থাৎ তিনি নিজেই যে ঘরের অধিবাসী, সেই ঘরের কাজ করে তিনি পারিশ্রমিক পাবেন। তার মানে যে ঘরে তাঁর মালিক হওয়ার কথা, সেখানে তিনি হয়ে যাচ্ছেন বেতনভুক্ত কর্মচারি।

২। গৃহিণী যে পারিশ্রমিক নেবেন, সেটা নেবেন কার কাছ থেকে? নিশ্চয় “গৃহকর্তা”র কাছ থেকে! অর্থাৎ পারিশ্রমিক নেওয়ার বিনিময়ে তিনি বাইরে গিয়ে রোজগার করা পুরুষটির দাসী হয়ে যাচ্ছেন। পুরুষটিকে সুপিরিয়র হিসেবে নিচ্ছেন। যে সম্পর্কটা হওয়া উচিত ছিল বন্ধুত্বের, সহযোগিতার, সেটি হয়ে যাচ্ছে প্রভু ভৃত্যের।
যতোই এখানে আপনারা শ্রমের মর্যাদা নিয়ে আসেন না কেন, এটা নিশ্চয় অস্বীকার করবেন না যে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আর কর্মচারির মর্যাদা সেই প্রতিষ্ঠানে সমান নয়। যিনি পারিশ্রমিক দেন, অর্গানাইজেশনাল হায়ারার্কিতে তিনি উপরেই থাকেন। কারণ তিনি সম্পদের মালিক। অতএব, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটিকে প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক বানিয়ে নারীর মর্যাদা কীভাবে বৃদ্ধি হয়, এটা আমার বোধগম্য নয়।

বৈশালী রহমান

৩। সংসার স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ে মিলে গঠিত হয়। অতএব সাংসারিক বা পারিবারিক কাজ দুজনেরই। এক্ষেত্রে একপক্ষ টাকা দিয়ে সার্ভিস কিনবে, আবার অপরপক্ষের বাইরে চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে স্বাধীনভাবে কাজ করে অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা থাকলেও অন্যের এঁটো থালা মেজে, বাচ্চার কাঁথা ধুয়ে, মানে যেসব কাজে ব্রেইন ওয়ার্ক তেমন লাগে না আরকি, তার বিনিময়ে টাকা উপার্জন করবে, বিষয়টা কেমন বিশ্রী লাগে না?

তাহলে উপায়টা কী? এই যে গৃহিণীরা সারাদিন ঘরের কাজ করেন, যে কাজে আবার তাঁদের অপদার্থ পুরুষ সঙ্গীদের কোনো সহায়তাই পান না, এই পরিশ্রম কি বৃথা যাবে? এর কি কোনো অর্থমূল্যই থাকবে না?

উত্তর হলো, থাকবে। তবে সেই অর্থমূল্যের নাম পারিশ্রমিক হবে না, এই অর্থমূল্যের নাম হবে ক্ষতিপূরণ বা কমপেনসেশন।

এখন আমি ব্যাখ্যা করছি, আমি কেন সাংসারিক কাজের মূল্যকে ক্ষতিপূরণ বলছি।

আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলেরই বিয়ে করার পেছনে অন্যতম একটি মোটিভ হচ্ছে, নিজের কাজকর্ম, সেবাযত্ন এবং নিজের মা-বাপসহ চৌদ্দগুষ্টির সেবার জন্য বিনামূল্যের একটি দাসী পাওয়া। তারা ঘরের কাজ করতে অক্ষম, বাচ্চা পালতে অক্ষম, তারা অপদার্থ, তারা গুড ফর নাথিং। এইজন্য তারা অন্য বাড়ি থেকে একটি মেয়ে নিয়ে আসে, ঘরের কাজ এবং বাচ্চা লালনপালনের ৯০% দায়িত্ব ওই মেয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গুছায়।
এদিকে মেয়ে হয়তো ছাত্রজীবনে তার চেয়েও মেধাবী ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র তার “স্বামী”র ঘর সংসারের কাজে এবং সন্তান লালনপালনে সহযোগিতার অভাবে তাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গৃহিণীর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। তাহলে মেয়েটির যে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের একটি সম্ভাবনা ছিল, শুধুমাত্র তার “স্বামী”র ঘরসংসারের কাজ সমানভাবে ভাগ করে না নেওয়ার কারণে সেই সম্ভাবনাটি কি ক্ষতিগ্রস্ত হলো না? এই ক্যারিয়ারজনিত যে ক্ষতি, সেটি সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে পুষিয়ে দেওয়াটা যে লোকটি স্ত্রীর ক্যারিয়ার, পড়াশোনা নষ্ট করছে, তার দায়িত্ব বলেই আমি মনে করি।

এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে মাসে মাসে নির্দিষ্ট অর্থের মাধ্যমে নয়। বরং স্ত্রীকে সম্পত্তির মালিক করে দিয়ে যে সম্পত্তি হতে মাসে মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় আসবে যার পরিমাণ হবে স্বামীর আয়ের অর্ধেক, অথবা ভবিষ্যতে উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা যাবে। হতে পারে সেটা কোনো ফিক্স্ড একাউন্ট, বা সঞ্চয়পত্র, জমি, অথবা স্বর্ণালংকার। যে ছেলে নিজে ঘর সংসারের কাজ এবং বাচ্চা পালন করতে ব্যর্থ হবে, সে তার স্ত্রীকে এভাবেই ক্ষতিপূরণ দেবে, যেহেতু তার নিজের ব্যর্থতার জন্য সে স্ত্রীর ক্যারিয়ার নষ্ট করেছে। আমার মতে এতে করে সবদিক ব্যালেন্স হয়।
একদিকে স্ত্রী কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিয়ে নিজ ঘরেই কর্মচারী হয়ে থাকবে না, বরং সম্পত্তি অর্জন করার মাধ্যমে মর্যাদাশালী হবে। অপরদিকে পুরুষেরাও পদে পদে অনুভব করবে যে স্ত্রীর সাথে সমানভাবে ঘরসংসার এবং বাচ্চার দায়িত্ব না নেওয়াটা তাদের এক ধরনের ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতারই জরিমানা তারা দিচ্ছে।

পুরুষদের কাছে যদি এই সিস্টেম আনফেয়ার বলে মনে হয় তবে সমাধান সহজ। ঘরের কাজকর্ম, বাচ্চা লালনপালন এবং মা বাবার পরিচর্যার সমান দায়িত্ব নিন। যাতে করে এসব দায়িত্ব একাকি পালন করতে গিয়ে স্ত্রীর ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর মেয়েদের প্রতি পরামর্শ হচ্ছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করুন, সম্পদের মালিক হোন, নিজের ঘরের ডিসিশন মেকার হোন, অন্যের হুকুমের চাকর না।

(যেসব মেয়ের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে সারাজীবন অন্যের পয়সায় খাবে, তারা এই পোস্টের আওতার বাইরে। যারা পড়াশোনা বা অন্য বিশেষ কারণে কেরিয়ারে সাময়িক ব্রেক নিচ্ছেন, তাঁরাও)।

সংযোজন: এই বক্তব্য শুধুমাত্র সেইসব নারীর জন্য যারা বাধ্য হয়ে এবং পার্টনারের দায়িত্ব ভাগ করে না নেওয়ার কারণে গৃহিণীর জীবন বেছে নিয়েছেন এবং ঘর-সংসারের জন্য নিজেদের স্যাক্রিফাইসের কোনো মূল্য পাচ্ছেন না। কোনো পুরুষেরই স্ত্রীর প্রফেশনাল জীবনে এবং তিনি কী পেশা বেছে নেবেন সে ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার নাই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.