শাহাজাদী বেগম:
ধানমন্ডির রাস্তায় বের হলেই পোড়া মাংসের গন্ধ। নাকে সুড়সুড়ি লাগে, পেটে ক্ষিদে ভাব জাগে, জিভে স্বাদ নেবার জন্য পানি আসে।
চকবাজারের বাতাসেও পোড়া মাংসের গন্ধ! ওখানেও কি অমন নাকে সুড়সুড়ি লাগছে, একবার যেয়ে দেখবো নাকি, ক্ষিদেটা চাগাড় দেয় কিনা?
এই যে এতো ধ্বংস্তুপ! কই আমার জীবন তো এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকেনি। তিনবেলা খাওয়া, সংসার, বেড়ানো, ঘুম, সহবাস, কিছুই তো বাদ দেইনি! তবে কি আমার শীৎকার স্বজনহারার চিৎকার ছাপিয়ে গিয়েছিল? নাহ, সে সুযোগ নিজেকে দিলে তো! আমি স্বজনদের আহাজারি শুনছিই না। আজকাল টেনশন নিতে পারি না জন্য টিভি দেখছি না, পরিস্থিতি থেকে একরকম পালিয়ে বেড়াচ্ছি বলা যায়।
আহাজারি যতটুকু ভার্চুয়াল ফেইসবুকেই, বাস্তবের ফেইস কিংবা বুকের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। খবর দেখলে কান্না আটকাতে পারবো না, বুক ধড়ফড় করবে, ব্যথা উঠবে, স্বজনহারাদের চিৎকারে নিজের শীৎকার ভুলে যাবো ভয়ে খবর দেখছি না – এস্কেপিস্ট একটা! কে পুড়ে মরলো, কয়জন পুড়ে মরলো কার কী আসে যায় তাতে!
“যারা গেলো শুধু তারা বুঝলো,
যাদের গেলো শুধু তারা জানলো”
আমি শুধু লাইক শেয়ার পোস্ট এর মধ্যেই থাকলাম।
মন্ত্রী, এমপি কিংবা অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের অমর বাণীর সাথে আমার পার্থক্যই বা কতটুকু?
প্রিয় ঢাকা, তোমার আর কত ক্ষিদে বলতো! জীবনের চেয়ে আর কোন খাবার তোমার মুখে রোচে না? ৮৬ টা জীবন মুহুর্তেই পুড়ে কাবাব! আহা এই দুর্মূল্যের বাজারে এর চেয়ে সস্তা স্বাদু খাবার আর কোথায় মিলবে বলো! তবুও তো তোমার খিদে মিটবে না, নিমতলীতে মেটেনি, তাজরীনে মেটেনি, জাপান গার্ডেন সিটিতে মেটেনি, মিটেনি একের পর এক বস্তি জ্বালিয়ে!
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সেদিন ভাল খেতে পারোনি, “মানুষ” সেদিন মানুষকে বাঁচিয়েছিল, তারই শোধ নিয়েছো চকে?
এর পরের ঘটনাগুলো কী হবে, আমরা জানি। একে অন্যকে দোষ দিবে, বাতাসে প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ভাসবে, রাত জেগে টকশো হবে, দুর্দান্ত ছবি তোলার জন্য কিংবা মা-বাবাহারা শিশুসন্তানের এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ এর জন্য কেউ কেউ পুরষ্কার পেয়ে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য টাকা বরাদ্দ দিবে। কত টাকা দাম পড়বে যেন এক একটি জীবনের! যাই হোক সেটা ধানমন্ডির কাবাবের দামের চেয়ে কম তা আমি হলফ করে বলতে পারি। আর সেইসাথে বিবাহযোগ্য কন্যা থাকলে তার বিয়েও হয়ে যাবে আল্লাহর রহমতে। তবে আর ভাবনা কী!
ঢাকার আবার ক্ষিদে পাবে, আবার আগ্রাসী হয়ে উঠবে, টার্গেট হবে অন্য কোন চক। (উপরের লেখাটি লিখেছিলাম চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর। মৃত্যুর মিছিলে কেবলই সংখ্যা বাড়ে!)
মাস ঘুরতেই আবারো আগ্রাসী ঢাকা -তার কাবাবের “তেষ্টা” পেয়েছে। পুরান ঢাকার বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর কিংবা নতুন ঢাকার কাবাব ফ্যাক্টরি সব কটিতেই তার সমান আগ্রহ, লোভে চোখ চকচক করে! কাঁচঘেরা এসি রুম, ব্যাকগ্রাউন্ডে মাস্ত কালান্দার কিংবা বিটোভেন, কাঁটা চামচ আর ছুরির অবিরত সংগমে টুকরো পোড়া মাংস রাইতাতে চুবিয়ে মুখে তুলে রসিয়ে রসিয়ে চিবানো – নাহ, ওসবে তার পোষাবে না। তার চাই আস্ত আস্ত মানুষের কাবাব – গর্ভবতী নারীর কাবাব, একই ভবনে কাজ করা দম্পতির ঝলসানো দেহ, অফিসে আসা নারী পুরুষের আস্ত পোড়া শরীর; ব্যাকগ্রাউন্ডে গগনবিদারী আর্তচিৎকার, বেঁচে থাকার আকুতি, মুঠোফোনে স্বজনের কাছে শেষ বার্তা, অন্তর্জালে নিজেদের অসহায়ত্ব – ক্ষমা করো, নো স্কোপ! এসব নাহলে তার আবার “জোশ” আসে না।
এস্কেপিস্ট আমি এবারও চেয়ে চেয়ে দেখি -ফেইসবুকে দেখি, লাইক দেই, কমেন্ট করি, শেয়ার করি। আসলে আমি কিছুই করি না, বুকের মধ্যে জমাট কষ্ট নিয়ে নিত্যকাজে মন দেই! উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যায় সন্তান! ভেসে যায় সম্ভাবনা! বিদ্রুপহাসিতে ফেটে পড়া ঢাকাকে আমি চিনতে পারি না, ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে রই!
(এই লেখাটাও পাঠিয়ে দেবার পর শুনি গুলশানের ডিসিসি মার্কেট আর ধানমন্ডি আবাসিক ভবনে আগুন লাগার খবর!)