নিজের ও অন্যের ‘সীমানা’ স্পষ্ট করা জরুরি

আনন্দময়ী মজুমদার:

বাউন্ডারি বলতে ক্রিকেট মাঠের চারদিকের সীমানা বোঝায় সাধারণত। ব্যাটস ম্যান চার বা ছক্কা হাঁকালে আমরা সে দলের হয়ে লাফঝাঁপ করি।

তবে আরেক সীমানা আছে বাড়িঘরের। জানলা খোলা থাকলেও বাড়ির সীমানা আছে। দেয়াল আছে। এক গৃহ থেকে আরেক গৃহ আলাদা করার জন্য। এমন কি এক ঘর থেকে আরেক ঘরকে আলাদা করার জন্যও আছে দেয়াল বা সীমানা।

কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে কোনো সীমানা টানা নেই। কল্পনা চিন্তা ভাবনার সীমানা অপার। এখন অবশ্য সে কথা বলছি না।

আনন্দময়ী মজুমদার

প্রতিটা মানুষ তাঁর ব্যক্তিত্ব, পছন্দ-অপছন্দ আর বাস্তবতা শিক্ষা-দীক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা সৃজনশীলতা পারিপার্শ্বিক নিয়ে আলাদা। সেই ঈশপের শেয়াল আর বকের গল্পে ফিরে যাই। শেয়াল বককে নেমন্তন্ন করলো বাড়িতে। খেতে দিল প্লেট থেকে। বক তাঁর লম্বা চঞ্চু দিয়ে প্লেট থেকে চুক চুক জিভ চেটে শেয়ালের মতো খেতে না পেরে বাড়ি গিয়ে ফন্দি আঁটলো শেয়ালকে উচিত শিক্ষা দেবে। তারপর শেয়ালকে ডেকে এনে লম্বা সরু কলসিতে দিল খেতে। শেয়াল সুবিধে না করতে পেরে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ফিরে গেলে।

একজনের জামার সাইজ আরেকজনের কাজে লাগে না। একজনের চাহিদা আরেক জনের বিরক্তি। একজনের মূল্যবোধ কখনো কখনো আরেকজনের অস্বস্তি। বড়ো সমাজে একসঙ্গে বাস করতে গেলে আমরা প্রায় জেনে বা না জেনে আরেকজনের সীমানা পার হয়ে তাদের মুশকিলে ফেলতে থাকি।

উল্টোটাও হামেশাই হচ্ছে। আমার যা পেতে ইচ্ছে করে, করতে ইচ্ছে করে, সেই ইচ্ছেগুলোকে অন্যের কাছে ঠিকমতো তুলে ধরতে না পেরে আমরা নিজেরাই নিজেদের সীমানাকে অস্বীকার করি। অথবা অন্যেরা তা না জেনে করলে মনে মনে গজগজ করি। অথচ আমরা সীমানা পরিষ্কার করে তুলে ধরিনি, এটা তো আমাদের দায়। আরেক জনের তো জানার কথা নয় সবসময়। কারণ সকলের সীমানা-বোধ আলাদা।

সীমানা পেরোনোর আপাত মজাদার ঘটনা,

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। একজন ফকির দরবেশ জাতীয় লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি ছাত্রদের একজনকে ডেকে বললেন, যা ওকে কিছু দিয়ে আয়। ছাত্র স্বয়ং কবির বিছানা থেকে চাদরটা টেনে সেই দরবেশকে দান করে এলো!

আমি শুনেছি বস্তুগত সীমানা লঙ্ঘনের খবর। একজন মাফিয়া জাতীয় লোক একজন কৃষকের এক ফালি জমি দখল করে নিল। হামেশাই হচ্ছে। ঘর দখল, সম্পত্তি দখল, এসব একচেটিয়া। এগুলো বুঝতে পারা যায়। কিন্তু এক বাড়িতে শুনেছি একজনের টুথব্রাশ আরেকজনে ব্যবহার করতো! প্রত্যেক বাড়িতে সীমানার ‘কন্সেপ্ট’ আলাদা, এটা বলতেই হবে!

আমার বস্তুগত সম্পত্তি সে যত হেলাফেলার হোক, কেউ না বলে নেবে, ব্যবহার করবে, বা আমাকে না বলে দিয়ে দেবে কাউকে, এটা আমার জন্য মেনে নেয়া খুব কঠিন।

টের পাই আমি হুট করে এখন আর বারোয়ারিভাবে দশজনের সঙ্গে ঘর শেয়ার করতে পারবো না। আমার ছেলে আলো জ্বালানো থাকলে রাতে ঘুমুতে পারে না। কেউ কোনো কাজ সৌজন্য ও সহানুভূতি রেখে না করলে সেই কাজে আমি হাত দিতে রাজী হই না। এইসব আমি আমাদের ছোটো-বড়ো সীমানা বলে চিহ্নিত করেছি। আমি আমার মতো। কাউকে আঘাত না দিয়ে আঘাত না খেয়ে মসৃণ বাঁচার চেষ্টা নিরন্তর। শান্তিটাই কাম্য। কিন্তু নিজেকে অশান্তিতে রেখে অন্যকে শান্তি দেওয়া যায় না।

সীমানা সম্পর্কে সচেতন থাকলে আমরা একজন আরেকজনের থালায় তার অপছন্দের খাবারটা ফেলবো না, তার মত না নিয়ে তার কম্বলটা আরেক জনকে দান করবো না, তার পোশাকটা না বলে নিয়ে পরবো না, তার পছন্দের বইটা তার হাত থেকে কেড়ে নেবো না, তাকে বাইরে গাঁকগাঁক মাইক চালিয়ে তার অপছন্দের গান শুনতে বাধ্য করবো না, রাস্তাঘাটে বিশাল শব্দ করে হর্ন বাজাবো না, লোকজনের জরুরি কাজের সময়ে বিঘ্ন ঘটাবো না, অন্য কারো পছন্দের জন্য তাকে দোষী করবো না, সিংগল অবস্থায় বাচ্চা দত্তক নেবার ব্যাপারে কড়া হবো না, মেয়েটি সাংবাদিকতা পড়তে চাওয়ার জন্য বিরূপ হবো না, এবং তার প্রেফারেন্সটা জেনে নিয়ে সর্বদা চলবো। এটুকুই এক জন আরেকজনের জন্য করতেই পারে। একই সঙ্গে সে যা করতে পারে তা হলো, অযাচিত ব্যক্তিগত উপদেশ এবং রায় কাউকে না দেওয়া, কোনো আলোচনা তার মনের মতো না হলে সেই আলোচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, কোনো কাজের পরিবেশে নেতিবাচক কথা হলে সে যে এ ধরনের কথা পছন্দ করে না সেটা জানিয়ে দেওয়া, বুলির সঙ্গে সঠিক সীমানা টেনে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ তাঁর নিজের প্রেফারেন্সকে সর্বসমক্ষে বার বার সুন্দর সহজ সাবলিল ভঙ্গিতে প্রকাশ করতে দ্বিধা না করা। এবং অপরের প্রেফারেন্সটাকেও সমান ভাবেই দাম দিতে শেখা।

এক ডাকসাইটে ভালো ছাত্রকে চিনতাম যে এই সব সীমানা বুঝতো না। তাই সে তার প্রেফারেন্স কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারতো না। বলাই বাহুল্য সে এই মনোস্তাত্বিক নীলনকশা তার বাড়ির শিক্ষাদীক্ষা থেকে পেয়েছে। খুব লক্ষ্মী ছেলে যাকে বলে। একবার কে যেন তাকে জুতো কিনে দেবে বলে বড়ো দোকানে নিয়ে গেল। অনেক দাম দিয়ে এক মশমশে জুতো কেনা হলো। ‘কি স, চলবে তো?’ এ কথার উত্তরে ছেলেটা হাসি হাসি মতো মুখ নিচু করে নিচে তাকিয়ে রইলো। সুতরাং সে যে জুতোটা কিনতে চায় না, কস্মিনকালে সেটা পরবে না, সেটা আর ভদ্রতা করে জানাতে পারলো না। আর বড়োলোক আত্মীয় জুতোটা কিনে দেবার অনেক দিন পরে এর বাড়ি এসে দেখলেন জুতোটা তখনো নতুন প্যাকেটের গাদায় পড়ে আছে! তাঁর বেজায় দুঃখ হলো। সৌজন্য রেখেই নিজের পছন্দের জুতোর স্টাইলটা বললে সেদিন কাউকে অসুবিধেয় পড়তে হতো না।

লজ্জায় মিশে পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করলে সীমানা পরিষ্কার থাকে। আমি অনেকদিন নিজের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মাথা ঘামাইনি। হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার অন্যের পছন্দের জামা পরতে হচ্ছে, অন্যের পছন্দের খাবার খেতে হচ্ছে এবং অন্যের পছন্দের জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এক সময় সেই করতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম।

প্রাণী তাঁর পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে স্বচ্ছ কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে আসে বলেই সাফ সাফ জানিয়ে দেয়।

কোলের শিশুকে তার অমতে একটা ভাতও খাওয়াতে পারবে না কেউ। তবে দুঃখের কথা হলো খুব অচিরে তাদের নিজেদের মধ্যের এই সুস্থ মাত্রাজ্ঞান আমাদের সমাজ অভদ্রতা মনে করে নষ্ট করে দেয়। ভদ্রতা মানে যে বশ্যতা বা স্বভাবের সঙ্গে আপোস, নিজের কণ্ঠকে হেলাফেলার ব্যাপার মনে করা সেটাই শিখিয়ে দেয়। আবার কোনো কোনো মানুষ মনে করেন, তিনি যা ভাববেন, চাইবেন তাই শেষ কথা। তাঁর আশেপাশের সমস্ত মানুষকেও তাই ভাবতে হবে। সে আরেক জুলুম।

আমার ধারণা সমাজে শান্তির রাস্তা হিসেবে, সহজ মিটমাটের জন্য পারস্পরিক আলাপ, শ্রদ্ধা আর মিউচুয়াল আপোস ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। খুব কঠিন ব্যাপার এই সব।

কারণ দুই পক্ষকে সমঝোতার চোখ রাখতে হবে।

সীমানা মানতে হবে দুই দিকেই। শুধু নিজের নয়। অন্যেরও।

সমাজে চলতে গেলে নিজের এবং অপরের পছন্দ অপছন্দকে নিয়ে জোরাজুরি করা ঠিক না। দুটো দিকই সত্য। এটাই বলার ব্যাপার। অন্যের পছন্দকে অপছন্দকে শ্রদ্ধা করুন, চাপিয়ে দেবেন না। নিজেরটাও ব্যক্ত করুন।

রফা না হলে অন্য সিদ্ধান্ত নিন।

অন্য পথ নিন।

তাই বড়ো হয়ে রুদ্রতা ধারণ না করে, নম্র, শুভ্র আচরণ করেও ভদ্রতা ও সৌজন্য বজায় রেখেও সেটা করা যাওয়া উচিত। সেটাই ভালো সম্পর্ক রেখে এবং নিজেকে সুস্থ রেখে চলার প্রথম শিক্ষা।

শেয়ার করুন: