সম্পত্তি বণ্টনে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হবে কবে!

শিল্পী জলি:

একজন নারী টিভি রিপোর্টার বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রশ্ন করেছিলেন, মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মেয়েরা যে ছেলেদের অর্ধেক সম্পত্তি পায়, এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? কোনো উত্তর শোনা গেল না, শুধু দেখলাম মেয়েটির মাথায় কেউ একজন চা বা লাসসি ছুঁড়ে দিয়েছে।
উন্নত চিন্তা মানুষের উন্নতি ঘটায়। আর নিচুতায় ঘটে এমন অধঃপতন। যেখানে প্রশ্নের জবাব শুধু মুখ দিয়েই দেয়া যেতো, তেমনটিই হবার কথা, সভ্যতার চর্চাও ওটিই, সেখানে আইন ভঙ্গ হলো। সাজা যোগ্য অপরাধও ঘটলো। কথায় আছে, ‘কচু গাছ কাটতে কাটতে লোকে ডাকাত হয়।’ অসভ্যতার অনুশীলন মানুষকে আরও অসভ্য বানায়। একে জাতীয়ভাবে দমন না করলে লোকে জাতীয় বর্বরতায় পারদর্শি হয়ে ওঠে।

মুসলিম উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন মানে আপনজনদের মাঝে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির ভাগাভাগি, যেখানে ‘নারী পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তির হকদার। বিষয়টি সত্যিই বিভীষিকাময় কেননা শুধু লিঙ্গের ভিন্নতার কারণেই এই অসমতা। অথচ রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের অধিকার সমান হবার কথা। কেন এই লৈঙ্গিক বৈষম্য?

জন্মলগ্ন থেকেই অধিকাংশ পরিবারে ছেলে সন্তান অধিক মনোযোগ পায়, অধিক সুযোগ পায় নিজেকে গড়ে নেবার। অনেকাংশে বোনরাও সরাসরি কন্ট্রিবিউট করে ভাইয়ের উন্নতিতে। বোন বড় হওয়ায় ভাইদের দেখেছি ক্ষণে ক্ষণে বোনের কাছে দৌঁড়ায়– এটা কী, ওটা কী শিখে নেয়। শুরুতে অংকে কিছুটা কাঁচা ছিল, পরে তা দূর হয়ে যায়। বুঝিয়ে শুনিয়ে বোনই ভাইকে অংকে একেবারে পোক্ত করে দিয়েছে। পড়তে গিয়ে আমার বড়বোনও যখন বৃত্তি পায় তখন নিজের জন্যে কিছু না কিনে দুই ভাইকে দিয়েছিল দু’টো ঘড়ি কিনে। সাত দিনের মাথায়ই তারা ঘড়ি দু’টো হারিয়ে ফেলে।

আরেক পরিবারে মেয়েরা বাজারে গিয়ে কোন শাড়ী ছুঁলেই তাদের পিতা সব শাড়ী নিয়ে আসতেন বাসায়। মেয়ে ছুঁয়েছে শাড়ী আর তিনি সেই শাড়ী না কিনে বাসায় আসবেন? অতঃপর একে একে তার মেয়েদের বিয়ে হয় আমেরিকায়। আর মেয়েরাও দলে দলে ভাইদের নিয়ে আসেন এখানে। বুড়ো থুনথুনে হয়ে গেলেও এখনও তারা এবং তাদের স্বামীজনেরা শালক কূলের তদারকিতে এমন হেন কোন কর্ম নেই যে বাদ রাখেন। তথাপি এতো ভালোবাসার বাবা জীবিত থাকতেই মেয়েদের বঞ্চিত করে সব ছেলেদের নামে ঢাকার বিশাল বাড়িটি লিখে দেন যেনো তার মেয়েরা বাড়ির কোন অংশই না পায়। পরবর্তীতে চার/পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একজন ভাই শুধু বলেছে, বাবার সম্পত্তিতে সব সন্তানেরই সমান অংশ থাকা উচিত। আমাদের বাবার দলিল যাই হোক না কেন আমরা বোনদের বঞ্চিত করবো না। ঐ ভাইটি শুধু বোনদের প্রতিই নয়, বাইরের লোকদের প্রতিও মানবিক।

কঙ্গনা রানাওয়াত বলেছিলেন, তার বাড়িতে যখন ভাইয়ের জন্যে রুম বানাবার কথাবার্তা চলছিল, কিন্তু তার রুমের নামগন্ধ হচ্ছিল না, তিনি শুধু অবাক হচ্ছিলেন, ভাবছিলেন তার রুমের কী হবে? আজ তার নিজেরই এতো সম্পত্তি, নিজেরই হাতে গড়া যে এখন তিনি শুধু ভাই-ই নয়, তার ফরটিন জেনারেশনকেও ধনসম্পত্তি দিয়ে ভাসিয়ে ফেলতে পারেন। কথা ওখানে নয়, কথা হলো মানুষের ছোট চিন্তায়, ভেদাভেদে।

হিসেবের ফর্মূলায় একই পরিবারের ছেলেমেয়ের অনুপাত দুই : এক।

সেবার দেশে বান্ধবী জোর গলায় বললো, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত এমনই সম্মান মায়েদের। ঐ মা’রাই যখন স্বামী হারা হোন, তখন মৃত স্বামীর সম্পত্তির আট ভাগের একভাগ অংশ পান হিসেব অনুযায়ী, বাস্তবতায় অনেকের সেটুকুও মেলে না। অথচ বাবা বউ হারা হলে বাবা মৃত স্ত্রী’র সম্পত্তি পেতেন সেই তুলনায় ডাবল। সহজ কথায় বলা যায় যে শুধু লিঙ্গ নারীর হলেই প্রাপ্তি হবে পুরুষের অর্ধেক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই প্রাপ্তিটুকু থেকেও তারা বঞ্চিত। সেই সাথে থাকে কোন ভাই না থাকলে সম্পত্তি অন্য পরিবারে চলে যাবার আশঙ্কা।

আরও যেসব বিষয় আছে যেমন জারজ সন্তান, ধর্মান্তরিত সন্তান উওরাধিকার সম্পত্তির ভাগীদার নয়। সৎ পিতামাতা সৎ সন্তানও পরস্পরের সম্পত্তির অংশীদার নয়। নপুংসক সন্তান ছেলে বা মেয়ে ধরে হিসেব কষে যেই হিসেবে কম সম্পত্তি আসে সেটুকু পায়। দত্তক সন্তানের সম্পত্তিতে কোনো অংশ নেই। সবই কেমন যেনো অসমতা, পারিবারিক স্বার্থপরতার চর্চা! শুধু ভালো লাগলো এটুকুই যে মৃত ব্যক্তির খুনী তার সম্পত্তি কোন ভাগ পাবে না।

একসময় যৌথ পরিবার ছিল। বাবা-চাচাদের মাঝে বন্ধন ছিল অতি গভীর। তখন তাদের সন্তানরাও সন্তানসম ছিল। আজকাল তেমন আর চোখে পড়ে না– নিজের সন্তানরাই এখন পিতামাতাকে দেখতে চায় না, সেখানে ভাইয়ের সন্তান আর কতটা কী করবে?

চার মেয়ের এক বাবা উকিলের কাছে গিয়েছেন। তিনি চান না মরে গেলে তার সম্পত্তি তার ভাই বা ভাইয়ের সন্তানরা পাক। চান সবটুকুই যেনো নিজের মেয়েরা পায়। উকিল বললেন, ভাই, কিছু মনে করবেন না, মেয়েছেলেদের কেউ না কেউ দেখেই। তাদের জীবন থেমে থাকে না।

আমার এক বান্ধবীর চাচা মৃত্যুশয্যায় ভাতিজার হাতে অবিবাহিতা তিন কন্যার বিয়ের দায়িত্ব সঁপে দিয়ে বচন নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯ বছরের ভাতিজা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এসব কী বলেন চাচা? কথা দিলাম ওদেরকে অবশ্যই দেখবো। পাঁচ/ছয় মাস পর ভাতিজা নিখোঁজ। বোনরা খুঁজতে খুঁজতে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পায় তার লাশ। বাসে উঠতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল সে।

অনেক কন্যা সন্তানের পিতামাতা, অথবা দত্তক সন্তানের পিতামাতা সম্পত্তির ভাগ যেনো অন্যরা না পেয়ে যায় সেই ভয়ে জীবিত অবস্থাতেই সন্তানদের মাঝে সম্পত্তি হস্তান্তর করে লাটাই হয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপনের পথ বেছে নেন। শুধু মেয়ে লিঙ্গদের প্রতি সমতা নিশ্চিত করণের জন্যেই তাদের এতো ঝামেলা। ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে প্রবেশ। অথচ মানুষ আসে খালি হাতে, যায়ও খালি হাতেই।

অনেক নারীর জীবনেই ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ নেই, সন্তান পালন করতে করতেই তাদের জীবন যায়, সেই সাথে আজীবনই যাপন করেন পরাধীন অনিশ্চিত একটি জীবন। তথাপি তাদের জীবন থেমে থাকে না। নারী সম্পত্তি পেলে, সম্পত্তির সমবণ্টন ঘটলে ওগুলো ভোগ করে তারই সন্তান, তার কাছের জন। অনগ্রসর একজন নারী যদি পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তির উপর নির্ভর করে জীবন চালিয়ে নেবার সাহস করে, তাহলে সম্পদের সমবণ্টনে পুরুষের কেন এতো আপত্তি?
কোথায় এই কাঙ্গালপনার শিকড়?
কেনই বা?

লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর হোক, জাতির চিন্তাচেতনায় মুক্তি আসুক।
এখনই সময় উন্নত হবার, মুক্ত চিন্তার, বিশ্ব জয়ের।
জীবনে পরিবর্তনশীল, আইনও।

শেয়ার করুন: