আমার বৈষম্যহীন শিশুবেলা

শান্তা মারিয়া:

আমি বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান আমার ভাই আহমদ ইয়ুসুফ আব্বাস উদয়। আমি তার চেয়ে আট বছরের ছোট। আমার জন্ম হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভোর সাড়ে চারটায়। ফজরের আজান পড়ছে তখন। এর মধ্যেই বাবা আমার জন্মের ঘোষণা হিসেবে আজান দিলেন। আশপাশে থাকা কয়েকজন বললো, ‘সে কী শুনলাম, তো মেয়ে হয়েছে। ছেলের জন্ম হলেই শুধু আজান দিতে হয়, এটা জানেন না?’

বাবা এককথায় তাদের বললেন, ‘আমার কাছে দুই সন্তানই সমান’। তখন আমরা থাকতাম পুরান ঢাকায় আলুবাজারের বাড়িতে। মাত্র চারজনের পরিবার। মায়ের দেখাশোনা করার মতো দুটি কাজের লোক ছাড়া কেউ ছিল না। বাবা অফিস থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিলেন সংসার ও স্ত্রীর যত্ন নেওয়ার জন্য। নরমাল ডেলিভারি, মাস খানেকের মধ্যেই মা সুস্থ হয়ে গেলেন। এরপরও অফিসের সময়টুকু ছাড়া বাবা সন্তানদ্বয়ের দেখাশোনা ও ঘরের কাজে অংশগ্রহণ চালিয়ে গেলেন। মেয়ের জন্ম হওয়ায় বাবা ও মা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। আমার ভাই একটু মন খারাপ করেছিল। কারণ তার ইচ্ছা ছিল ছোট ভাই হলে তাকে বক্সিং শেখানোর। তার ধারণা ছিল আমাকে হাসপাতাল থেকে কিনে আনা হয়েছে।

বারে বারে মাকে অভিযোগ জানাতো, ‘ছোটবাচ্চাই আনা হলো যদি, তাহলে একটু বড়সর ছেলে বাচ্চা আনলে ভালো হতো, মারপিট করা যেত। এত নরম নাইলনের পুতুলের মতো বোন দিয়ে কী হবে?’ তবে কিছুদিনের মধ্যে তার এই মনখারাপ কেটে গিয়েছিল। বিশেষ করে যখন ভাইয়ার পছন্দে আমার ডাকনাম রাখা হলো ভ্যালিয়া। এটা হলো তার তন্ময় হয়ে সোভিয়েত গল্পের বই পড়ার ফলাফল। মা-বাবাও প্রথম নারী নভোচারী ভ্যালেনটিনা তেরেসকোভার এই ডাকনামটি পছন্দ করলেন। বাবা সারাজীবনই আমাকে ভ্যালেনটিনা বা ভ্যালেন বলে ডাকতেন।

এরপর শুরু হলো আসল নামকরণের পালা। বাবা নাম রাখলেন ‘ঊর্মিমালা ঢেউয়ের মালা ঊষা নদীর কূলে’। মা বললেন, এতো বড় নাম রাখা যাবে না। রাখলেন চন্দ্রাবতী দেবী। মা বললেন, পুরানো আমলের বাংলা সিনেমার নায়িকা মনে হচ্ছে। এরপর বাবা জিদ ধরলেন কুন্দনন্দিনী শান্তা মারিয়া নামটা রাখতেই হবে।

মা বললেন, শান্তা মারিয়া তো কলম্বাসের জাহাজ। বাবা ব্যাখ্যা করলেন, কুন্দনন্দিনী হলো বঙ্কিমের বিষবৃক্ষের নায়িকা। এই নামে বাঙালি ঐতিহ্য রক্ষা হবে। আর শান্তা মারিয়া হলো আন্তর্জাতিক। শান্তা শব্দটি আর্যধারার। আর মারিয়া হলো সেমেটিক ধারার। উচ্চারণও সহজ। শান্তা মারিয়া নামটি বিশ্বের যে কোন দেশের মানুষ উচ্চারণ করতে পারবে। কোন ধর্মের তাও কিছু বোঝা যাবে না।

মা মন্তব্য করলেন, সারা বিশ্বের মানুষের আমার মেয়ের নাম ধরে ডাকাডাকির দরকারটাই বা কী? কিন্তু বাবা তখন আমার ভবিষ্যত নিয়ে অতি উচ্চাশা পোষণ করায় মায়ের আপত্তি ধোপে টিকলো না। কুন্দনন্দিনী শান্তা মারিয়া বহু বছর বহাল রইলো। আকিকাও হলো ওই নামেই। আকিকার সময় দুটি ছাগল আনা হলো জবাই দিতে। আজও পর্যন্ত ছাগল দুটির জন্য আমার অপরাধবোধ হয়। আমার জন্মের কারণে দুটি প্রাণীকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে কেন?

পাড়ার মৌলভী সাহেব বাবাকে বুদ্ধি দিলেন, দুই ছাগলের কী দরকার? মেয়ে বাচ্চার আকিকায় একটাই যথেষ্ট। বাবা তার পুরনো বুলি আওড়ালেন, ‘আমার কাছে দুই সন্তানই সমান’। দুই ছাগলে তেমন আপত্তি না করলেও কুন্দনন্দিনী শান্তা মারিয়ার নামে আকিকা দিতে মৌলভীর ঘোরতর আপত্তি দেখা গেল। এটা নাকি মারাত্মক রকম খ্রিস্টানি ও হিন্দুয়ানি নাম, এমনকি ইহুদি-নাসারা হ্ওয়াও অসম্ভব নয়।

বাবা বললেন, ‘আপনার আপত্তি থাকলে সরুন, আমি অন্য কাউকে ডাকছি।’ মৌলভির সহকারি জুনিয়র মৌলভি বুদ্ধি বাতলালেন, মেয়ের নামের সঙ্গে তকিয়ূল্লাহ নামটি যোগ করুন। বাবা জবাব দিলেন, ‘মেয়ের নামের সঙ্গে বাপের নাম, স্বামীর নাম কোনকিছুই যোগ করতে হবে না, উপাধি, পদবীরও দরকার নেই। সে নিজের নামেই পরিচিত হবে’। আজ যখন অনেক প্রগতিশীল নারীকেও নিজের নামের পিছনে স্পাউসের নামের লেজ লাগাতে দেখি তখন বাবার কথাটা আমার মনে পড়ে যায়।

কুন্দনন্দিনী অংশটি অবশ্য বাদ পড়েছিল কয়েক বছর পরে। বাংলা উপন্যাসের সিরিয়াস পাঠক মা সেটি বাদ দিয়েছিলেন একটা কুসংস্কার থেকে। বিষবৃক্ষে কুন্দনন্দিনীকে বিষ খেয়ে মরতে হযেছিল, সেটা মা কখনও ভুলতে পারেননি।
পুত্রসন্তান না থাকলে নাকি অনেক বাবা কন্যাকে পুত্র সন্তানের মতো করে গড়তে চান। কিন্তু প্রথম সন্তানটি পুত্র হওয়া সত্ত্বেও বাবা তার কন্যার শিক্ষায় দারুণ মনোযোগী হলেন।

কার্ল মার্কস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুং নামগুলো মুখস্ত হয়ে গেল ছোটবেলাতেই। সাম্যবাদ, ইতিহাস আর মিথোলজির ভুবনে আনাগোনা শুরু হলো বাবার হাত ধরে। পড়ালেন গীতা, বাইবেল, কোরান, ত্রিপিটক, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। রামায়ণ মহাভারত, ইলিয়াড অডিসির গল্পগুলো জানলাম, পরে পড়লাম বই থেকে, রীতিমতো পড়া মুখস্ত করার স্টাইলে, প্রশ্ন-উত্তর ধরে। পৃথিবীর ইতিহাস প্রাচীন যুগ আর রুশ ইতিহাসের কথাকাহিনীও পড়া হলো। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মানব সমাজ আরেকটু বড় হযে পড়তে হলো বাধ্যতামূলকভাবে। ছোটবেলা, বড়বেলা এমনকি বুড়োবেলাতেও বাবা আমাকে পড়িয়েছেন অসংখ্য বই। পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পের ইতিহাস, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শন থেকে শুরু করে ক্ল্যাসিক সাহিত্য। বাবার কাছে এসব পড়া ছিল আনন্দদায়ক। কারণ তিনি কাউকে কোনদিন কড়া কথা বল‘তেন না। আমি খুব আগ্রহ নিয়েই এসব বই পড়তাম। শিশুবেলাটা নতুন নতুন জানার আগ্রহে রঙিন হয়ে উঠেছিল।

ভাইয়াকেও পড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার এদিকে একেবারেই আগ্রহ ছিল না। ভাইয়া তখন টিভিতে ছোট্ট খবর পড়তেন আর নানা রকম অনুষ্ঠান করতেন। তার আগ্রহ ছিল ম্যাজিক, ধাঁধাঁ, অংক আর পাজলের চমক লাগানো বিদ্যায়। ভাইয়া আরও পছন্দ করতেন গোয়েন্দা গল্প। শার্লক হোমস, ফেলুদা, কিরীটি রায়।

বাবা আমাকে ও ভাইয়াকে নামাজ পড়তে শিখালেন। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তাম। আবার তার হাত ধরেই যেতাম বনগ্রাম লেনে দুর্গাপূজার প্রতিমা দেখতে। কালীপূজায় বাবার জন্মদিন পালন করা হতো নিতান্ত ঘরোয়াভাবে কারণ তিনি জন্মেছিলেন দীপাবলীর রাতে। সেসময় চিনির পুতুল কিনে আনতেন নিজেই। আবার লক্ষ্মীপূজার সময় পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারের মেলা থেকে আমার জন্য কিনে আনতেন লক্ষ্মীপূজার পট, মাটির পুতুল। ইতিহাসের কচকচি ভাইয়ার একটুও পছন্দ ছিল না। বাবাও জোর করেননি। আমাকে নিয়ে যেতেন নীমতলীর পুরানো জাদুঘরে। পাল আমল, সেন আমল, মোগল পাঠানের ইতিহাস তাই বই পড়ে মুখস্ত করতে হয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে আমি বাবার সঙ্গে যেতাম। ভাইয়া ঘুম ত্যাগ করে যেতে পারতো না কখনোই। বাবার সঙ্গে বাংলা একডেমি আর শিল্পকলা একাডেমিতে যেতাম নানা কাজে। অনেকে বলতেন, ‘আপনার ছেলেকে দেখি না কেন? সবসময় মেয়েকে নিয়ে আসেন?’ বাবা বলতেন, ‘মেয়ের এসব দিকে আগ্রহ, তাই ওকে নিয়ে আসি। ছেলের লেখালেখিতে কোন আগ্রহ নেই।’ অবশ্য ঈদের নামাজে মসজিদে ভাইয়া ও বাবা একসাথে যেতেন।

ব্যাংকের চেক লেখা, ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল জমা দেওয়ার কাজও শৈশবেই শিখলাম বাবার কাছ থেকে। বাবা তখন বিজেএমসিতে(বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন)চাকরি করতেন। নদীর ওপারে ঢাকা জুটমিল। স্কুল ছুটি থাকলে প্রায়ই বাবার সঙ্গে তার অফিসে যেতাম। মিলের বাগানে খেলা করতাম। জুটমিলের ফুলগাছগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাবা প্রায়ই আমার জন্য রুমালে বেঁধে ফুল নিয়ে আসতেন।

মতিঝিলের বিভিন্ন অফিসে কোনো কাজে গেলে আমাকে নিয়ে যেতেন। মা বলতেন ‘ওকে নিয়ে অফিসে অফিসে ঘোরো কেন তুমি?’ বাবার বক্তব্য ছিল, ‘অফিসের পরিবেশ দেখুক। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলা অভ্যাস হোক। ব্যাংক থেকে টাকা তোলাও শেখার ব্যাপার। মেয়ে তো ঘরে বসে থাকবে না। ওকে তো কাজকর্ম করে খেতে হবে।’ স্কুলও তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল কো-এডুকেশন। বাবা-মা দুজনেই একমত হয়েছিলেন যে, কো এডুকেশনে পড়লে ছোটবেলা থেকেই সকলের সঙ্গে সহজভাবে চলতে শিখবে। বাবা আমাকে বলতেন, মেয়ের জন্য আলাদা বিশ্ব তো গড়ে দিতে পারবো না, সেটার দরকারও নেই। সমাজে ছেলে মেয়ে সবার সঙ্গে সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে, চলতে ফিরতে শিখতে হবে। বড় হয়ে যখন দেশে বিদেশে ঘুরবে তখন পুরুষ দেখলে লজ্জায় গুটিয়ে থাকবে না। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে সকলের সঙ্গে চলাফেরা, সভাসমিতিতে কথা বলতে জানাটা ছোটবেলা থেকেই দরকার।

বাবার পরিচিতরা তাকে বলতেন ‘তকিয়ূল্লাহসাহেব আপনি তো মেয়েকে ছেলের মতো করে বড় করছেন’। বাবা কথাটায় আপত্তি করতেন। বলতেন, ‘মেয়েকে মানুষের মতো করে বড় করছি। কিংবা মেয়ের মতো করেই বড় করছি। ছেলের মতো করবো কেন? ছেলে কি মেয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নাকি?’। ছোটবেলায় আমি ভাইয়ার মতো পোশাক পরতে খুব পছন্দ করতাম। ভাইয়ার বেলবটম প্যান্ট, জ্যাকেট, কডের আর জিন্সের প্যান্ট, সুইসভয়েলের শার্ট আমার কাছে খুব স্মার্ট বলে মনে হতো। আমাকেও একই সঙ্গে দরজিবাড়িতে নিয়ে ওরকম শার্ট প্যান্ট বানিয়ে দেওয়া হতো। আবার পাশাপাশি ফ্রক, টপ স্কার্টও ছিল। টিনএজে হলিউডি ছবি দেখে আমার ওয়েস্টার্ন পোশাক যেমন টপ স্কার্ট , গাউন, মিনিফ্রক, লং ইভনিং-গাউনের শখ হয়। বাবার রুশপ্রীতি ছিল। তিনি সোভিয়েত নারী পত্রিকা দেখে আমার পোশাকের ডিজাইন ঠিক করতেন। তখন বাজারে এত রকম রেডিমেড কাপড় পাওয়া যেত না। নবাববাড়ি, রমনা ভবন, নিউ মার্কেটের কাপড়ের দোকান থেকে নানা রকম কাপড় কিনে নানা ডিজাইনে পোশাক বানানো হতো।আশির দশকে ম্যাক্সি, মিডি, কাফতান জনপ্রিয় হলে সেগুলোও বানানো হতো একটু আনকমন নকশায়।

আমার অষ্টম জন্মদিনে বাবা ঠিক করলেন পোশাক রাখার জন্য আলাদা আলমারি কিনে দিবেন। যাওয়া হলো আসবাবের নামি দোকান ল্যামারাসে। বেলজিয়ান গ্লাস লাগানো কাঠের উপর খোদাই করা বার্মাটিকের যে ডবল আলমারিটি আমার পছন্দ হলো তার দাম বিশ হাজার টাকা। সেটা বোধহয় ১৯৭৮ সাল। তখন অত টাকা বাবার কাছে নেই। ঠিক হলো প্রতি মাসে এক হাজার করে দিয়ে ইনস্টলমেন্টে আলমারি কেনা হবে। সেই আলমারিটি এখনও আছে, আমার বেডরুমে। বাবার স্নেহের উপহার হিসেবে এটি আমি আজীবনই রাখবো। যতই পুরনো ডিজাইন হয়ে যাক না কেন।

ভাইয়াকে যে বাবা কম স্নেহ করতেন তা নয়। সত্যি কথা বলতে কী তিনি ডাইভারসিটি বা বিভিন্নতাকে সম্মান করতেন। বলতেন যার যেদিকে আগ্রহ। আমার কবিতা লেখাকে তিনি উত্সাহ দিতেন। ভাইয়ার লেখালেখিতে আগ্রহ ছিল না। যদি থাকতো তাহলে সেও বাবার কাছ থেকে সমান উত্সাহই পেত সন্দেহ নেই।

সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বাবা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন। এমনিতে তিনি সম্পত্তি চেতনার বিরোধী ছিলেন। বলতেন সমাজের সাধারণ সম্পত্তি থাকতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির দরকার কী? তার নীতি ছিল each according to one’s ability and each according to one’s need. পরিবারে ও সমাজে সবাই সবার সাধ্যমতো খাটবে এবং প্রয়োজন অনুসারে গ্রহণ করবে।

যতদিন ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ না হচ্ছে ততোদিন উত্তরাধিকারের বেলায় নারী পুরুষের সমান বন্টন। তার পৈতৃক সম্পত্তি তিনি নিজের দুই সন্তানকে সমানভাবে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি আমাদের বাড়িতে ভাইয়া ও আমার সমান ভাগ, সমান উত্তরাধিকার। এই বোধটা তিনি আমার ভাইযের মধ্যেও সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। ভাইয়াও কখনও আমাকে হিংসা করেননি। কখনও আমার অধিকার লংঘনের চেষ্টা করেননি।

শেয়ার করুন: