আনন্দময়ী মজুমদার:
১) নারী দিবসকে মাইল ফলক হিসেবে দেখে কিছু কথা ভাবতে খারাপ লাগে না। কথা বলার চেয়ে অবশ্য শুনতে ইচ্ছে করে বেশি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা, দেশের আধুনিক নারীরা কী ভাবেন, কেমন করে চলেন, কী পালটে গেল তাঁদের জন্য? শুধু রোজগার আয়ের বাইরে আর কী পাল্টেছে? তাঁদের নিজেদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা? তাঁদের জীবনকে অনুভব করার মাপকাঠি? আয় রোজগার বাড়ায় তাঁদের জীবন এখন কেমন? নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারার, নিজের মতো জীবনটা কিছুটা যাপন করার অনুভূতি কেমন?
২) সেভাবে দেখলে কোনো মানুষ খণ্ডিত না। কিন্তু চেতনা খণ্ডিত থাকে সংসারের শিক্ষার কারণে।
আমার ভাবতে ইচ্ছে করে নারীরা খণ্ডিত না। তারা সম্পূর্ণ। শাণ, ধার, যুক্তি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, অধিকার বোধ আর উচ্চশিক্ষা যেমন আছে, তেমন আছে সৌজন্যবোধ, নম্রতা, শান্তিময়তা, আত্মবিশ্বাস, নিরাপত্তাবোধ, দুঃখকে ভয় না করার মানসিকতা, নিজেকে নাজুক ফুলের মতো বাঁচিয়ে না রেখে, রোদ আর জল সহ্য করার শক্তি, দুঃখ মেনেই, ভালোবাসার হিম্মত।
আসলে এমন একটা সম্পূর্ণতা তো শিক্ষার। সেটা সকলেই পাবে এটাই লক্ষ্য হতে পারে। আমাদের বাড়িতে ছেলেকে এটা আমরা দেব, এটুকু আমরা চেষ্টা করে যেতে পারি।
দশভুজা ইমেজটা সংসারে বর্তমান। আমি সেটাকে আবার রি-ইনফোরস করতে চাইছি কি? আমি বলতে চাইছি, ওভার-ফাঙ্কশনিং না হয়েও নিটোল ভাব অর্জনের চেষ্টার কথা সমাজের নারী-পুরুষ নির্বিশেষের।
৩) আমি আমাদের সংসারের হিরো সন্তান। এটা আমার শব্দ নয়। এই শব্দ আমি কোর্স করে শিখেছি। অনেক পরিবারে প্রথম সন্তানরা এমন হয়। তারা সকলকে আগলে রাখার দায়িত্ব তাঁদের বলে মনে করে। এটা হয়তো খুব ফাঙ্কশনাল কিছু না। পরে কিছু সমস্যা হয়। কিন্তু একটা জিনিস তারা শেখে। তারা মোটামুটি শক্তি-সম্পন্ন হয়। তাই নিজের জীবনের সমস্যার জন্য অন্যদের সাহায্য চাইলেও মূল সমাধানটা যে তাঁদের করতে হবে এ ব্যাপারে তাঁদের কখনো কোনো প্রশ্ন থাকে না। তারা অহেতুক কপাল চাপড়ায় না। তারা বিকশিত হয় বৃক্ষের মতো।
মানুষকে বৃক্ষের মতো প্রাকৃতিক, বিকশিত, ছায়াবান আর সকলের সঙ্গে সমৃদ্ধ এ অবস্থায় দেখতে মন চায়।
৪) নারীদের মধ্যে এখনো একজনের সমৃদ্ধি যে আরেকজনের গরীবী একথা মনে করেন। অনেক নারী এমন মনে করেন। একজন আরেকজনের ভালো কথা বলতে পারেন না। সিস্টারহুড সুদূরপরাহত মনে হয় অনেক সময়। সে কথা থাক।
খণ্ডিত নারী যে খণ্ডিত চেতনা আর নিরাপত্তাহীনতাকে তাঁর সংসারে চালিত করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অনেক কষ্টের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে হতে আপসোস হয় এই নিয়ে। কারণ এখনো অনেক সংসারে নারীরাই হালের মাঝি। তাঁদের পারস্পরিক ডাইনামিক্স আলাদা। এই ডাইনামিক্স এখনো অবিমিশ্র আনন্দের বা সুরেলা নয়।
৫) নারীরা বাউন্ডারি সম্পর্কে খুব কম জানাশোনায় কিছু সমস্যা হয় এখানে।
৬) একবার নারী দিবস উদযাপন করার জন্য একদল জমায়েত হলো। ভিতরকার বোধ থেকে কতগুলো সরল কথা না বলে তারা বড়ো বড়ো কেতাবের পাতা উলটে কথা ধার নিচ্ছিলেন।
৭) যাদের নিরাপদে থাকার অবকাশ আছে, কিন্তু বারবার নিজেকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে বিপদের সামনাসামনি হয়, সে যা বলে তার দাম আছে।
৮) যে কাদায় পড়েনি সে কাদা সম্পর্কে যাই বলুক, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সংসারে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে পাঁকের অভিজ্ঞতা থাকা একেবারেই জরুরি এ কথা মনে হয়।
যে বিপদকে মেনে নেয় জীবনের আখড়া হিসেবে, তাঁর কিছু পেশি তৈরি হয়। এই পেশি নিজেকে আর অন্যকে আগলে রাখতে পারে। দিক নির্দেশ দিতে পারে। এই লোকগুলো বাতিঘরের মতো।
৯) গতানুগতিক শিক্ষা ছাড়াও মৌলিক শিক্ষা আর মূলত একলা চলার হিম্মত (একলা চলতে হবে এমন না, কিন্তু দরকার হলে সেটা যে খুব ঠিকাছে) ছাড়া (নারীর বা পুরুষের) সত্তার বিকাশের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাই না।