আছিরুন কিংবা দুঃখনামা

লাবণ্য সায়মা রহমান:

পর্ব ৫

ফাতেমা বিনতে রফিক, সুন্দরী, উচ্ছ্বল আর প্রাণশক্তিতে ভরা এক মেয়ে যে সদ্য এম বি বি এস পাশ করেছে। মনের ভেতরে স্বপ্ন সীমাহীন। কেবল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে, প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ের পরিকল্পনাও চলছে তখন। তেমনি এক স্বপ্নঘোরের কালে এক সকালে চোখে কাজল পরে আর ঠোঁটে হাল্কা রংয়ের লিপস্টিক বুলিয়ে গেলো সার্জারির বার্ন ইউনিটে। তখন আতিকুর রহমান স্যারের অধীনে কাজ করে মেয়েটি। খুব মায়াবী মানুষ, নিজের কাজে ভীষণ মনোযোগী। রোগীর সেবায় কোনো কার্পণ্য নেই ফাতেমার।

বার্ন ইউনিটে কঠিন একটা রোগী এসেছে, নার্সের কাছে জানতে পারে ডাক্তার ফাতেমা। আতিক স্যারের বিশেষ স্নেহভাজন বলে এবং ফাতেমার দায়িত্বশীলতার ওপর স্যারের খুব আস্থা আছে বলেই সে ড্রেসিংয়ের দায়িত্ব পায় একটা কঠিনভাবে আগুনে পোড়া রোগীর। নাম, বয়েস কিছুই জানতো না ফাতেমা। শুধু আতিক স্যারের এক কথায় দৌড়ে যায় ফাতেমা বারো নম্বর বেডের দিকে। স্যার বললেন, যাও মেয়ে, নিজেকে প্রমাণ করো আরেকবার যে তুমি পারো।

ডাক্তার ফাতেমা জানতো না সারাজীবনের জন্য একটা গ্লানিবোধ ওকে তাড়া করে ফিরবে সেদিনের পর থেকে। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে কাছে যায় ফাতেমা, জানতে চায় রোগীর নাম পরিচয়, কী ঘটেছিলো, কবে ঘটেছিলো এই দুর্ঘটনা। শীর্ণকায়, ফ্যাকাশে শাদা গাত্র বর্ণের এক মেয়ে ক্লান্তি আর ব্যাথায় নুয়ে পড়া দুচোখ মেলে তাকায় ওর দিকে। ‘নাম কী তোমার মেয়ে’ বলতেই ক্ষীণ অথচ ফ্যাশ ফ্যাশে কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘আফা, আমার নাম আছিরুন, বাড়ি নবীপুর’। আফা, আমারে বালা কইরা দেউ, যে বেদনা করে আফা গো। দিবাইননি আফা বালা কইরা?

পর্ব ৬

আছিরুনের শরীরের ওপর থেকে হাসপাতালের শাদা চাদরটা সরানো মাত্রই কী দেখে ফাতেমা! এতোটা বিভৎস, এতোটা দগ্ধ শরীর নিয়ে মেয়েটা কী করে বেঁচে আছে! একদম কোমর থেকে পায়ের পাতা অব্দি ঝলসে যাওয়া শরীরের অংশটায় একটুও চামড়ার অস্তিত্ব নেই। হলদেটে শাদা থিকথিকে ঘা হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়, প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ঘা থেকে। কুঁকড়ে গেছে শরীরের নিচের অনেকটা অংশ, একটুখানি নড়াচড়া করতে পারছিলো মেয়েটা তবু। এমনকি বা পায়ের পাতায় গর্ত মতো হয়ে ঘিনঘিনে ম্যাগোটও জন্মেছে। ইশ, ক্যামন করে ঘটলো? ফাতেমা জানতে চাইলে গ্যাঁ গ্যাঁ গ্যাঁ শব্দ করে কাঁদছিলো মেয়েটি, জবাব দেয়নি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় ফাতেমা বুঝতে পারছিলো না ক্যামন করে শুরু করবে আছিরুনের চিকিৎসা? মনেও জোর পাচ্ছিলো না, মনে হচ্ছিলো সে গুটিয়ে যাচ্ছে নিজেরই ভেতরে। মনে জোর যে রাখতেই হয়, ডাক্তারকে শক্ত থাকতে হয়। ভেতরে দলা পাকানো কান্নাটাকে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বের করে দিয়ে এক ছুটে আতিক স্যারকে ডেকে আনে। ‘স্যার আপনার অপিনিয়ন দরকার’। আতিক স্যার দেখে বলেন, ‘কেইস জটিল, বেশি রিকভার তো হবে না, যতটুকু পারো ড্রেসিং করো, ইনফেকশনটা যেনো না ছড়ায়, আর কনট্রাকচার যেনো না বাড়ে খেয়াল রাখো’।

ডাক্তার ফাতেমা বিনতে রফিক শক্ত হাতে সকল প্রস্তুতি নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করে কাজ। আছিরুন বলেই না কী ঘটেছিলো, শুধু কাঁদে শুধুই কাঁদে। ফাতেমা প্রতিদিন দুবেলা ড্রেসিং করে, আস্তে আস্তে শোয়া থেকে বসানোর ট্রেনিং দিতে থাকে। আর একটু একটু করে আছিরুন নিজের গল্প বলা শুরু করে।

তৃতীয় দিন বিকেলের ড্রেসিংয়ে আছিরুনকে আবার জিজ্ঞেস করে ফাতেমা, এবার চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে খুব ফিশ ফিশ করে বলে, আফা গো, হুনবাই তুমি? আছিরুনের জবাবটা শুনে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারে না, ফাতেমা কাঁদে, আছিরুনও কাঁদে।

পর্ব ৭

অগ্রহায়ণ মাস, শুকনো শুনশান এক সকালে সবাই যখন বাড়ির বাইরে, উঠোনে পক্ পক্ ঘুরে বেড়াচ্ছিলো মুরগি মা আর তার মায়াবী হলদে ছানাগুলো। তখন তাকে পাকের ঘরে নিয়ে ‘আতকা গায়ে কেরাসিন ঢাইল্লা আগুন লাগায়া দেয়’। ‘ব্যাহা মাইয়া, কেউ শাদী করবো না, বহায় বহায় বাত দিতো কে? কেউ না গো, মইরা গেলে তো অতো চিন্তা করন লাগে না’। সৎমা ঠাণ্ডা মাথায় এ কথা বলতে বলতে ওর গায়ে সপাৎ আগুন ধরিয়ে দেয়। এ কথা শুনে ক্রোধে ও কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে পারে না ফাতেমা, দ্রুত হোস্টেলে ফিরে যায় সেদিন। মানুষ এতো নির্দয় হয় ভেবে কূল খুঁজে পায় না! সেদিন থেকে জীবনবোধ অনেক পাল্টে যায় ফাতেমার।

আছিরুনের তবু মরণ হয় নাই। সেদিন ওর বিকট চিৎকারে প্রতিবেশিরা ছুটে এসে আগুন নেভায়। কোনো চিকিৎসা পায়নি, বাড়িতেই ফেলে রাখা হয়েছিলো আছিরুনকে কতগুলো দিন। ওর ক্রমাগত ক্রন্দনে শেষমেষ সুরুজ মিয়া হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে এলে ওখানকার সিভিল সার্জন বলেন, এ রোগীর চিকিৎসা এখানে হবে না। তাই সেখান থেকে সিলেট ওসমানীতে নিয়ে আসা হয় মৃতপ্রায় আছিরুনকে। আছিরুনদের নিয়তি এমনই ক্রুর বাস্তবতার নির্দয় সত্যর সুতোয় বোনা আজন্ম দুঃখের নকশীকাঁথা।

আছিরুনের সেরে ওঠা এবং পুনর্বাসন নিয়ে অনেক কিছু ভেবে পরদিন ওয়ার্ডে এলে আর কোথাও খুঁজে পায় না ফাতেমা মেয়েটাকে। নেই তো নেই! নার্সকে জিজ্ঞেস করলে ডিসচার্জ শিটটি এনে দেয়, আর সাথে মুচলেকাটিতে লেখা ছিলো ‘রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন জানিবা সত্ত্বেও নিজ দায়িত্বে নিয়া গেলাম’ স্বাক্ষর করা নাম হাওয়া বিবি। পুলিশ কেইস হতে পারে তাই আগেই রোগী নিয়ে ভেগে গেছে ওরা। মরবেই তো আছিরুন, তবে ধুঁকবে, কতোটা ব্যথায় কাতরাবে মরার আগে ভেবে শিউরে ওঠে ফাতেমা। বুকের মধ্যে চাপা কষ্টটা আজ অব্দি তাড়া করে, কোনো একলা ক্ষণেঁ ফাতেমা এখনও মনে মনে বলে, আছিরুনরে, বোন আমার, ক্ষমা করে দিস এই অপারগ আমাকে।

সমাপ্ত

শেয়ার করুন: