নিলুফার রুখসানা:
ধরেন আপনি রোজ ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠেন, তারপর যে রুটিন মাফিক কাজগুলি আপনি করেন তা আমি বলছি, …অনেক কষ্ট করে বাচ্চার ঘুম ভাঙান, এরপর আপনি বাচ্চার জামা কাপড় রেডি করে পরান, টয়লেট করান, সন্তানের স্কুলের জন্য দুপুরের খাবার রেডি করেন…পানির বোতলে পানি ভরেন। এবার তাকে নাস্তা খাওয়ান, দাঁত ব্রাশ করান, ক্রিম, লোশন মাখান…বাচ্চা মানুষ তার চশমার কাঁচ মুছে পরিয়েও দিতে হয় আপনার।
এবার সবকিছু তার ব্যাগে ঢুকালেন…এর ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কর্তার(!)জন্য খাবার তৈরিও অন গোয়িং কিন্তু… যাই হোক, স্বামীর জন্য নাস্তা বানালেন, তিনি কিন্তু আবার কলা পাউরুটি খানেওয়ালা ভদ্রলোক নন…অতএব উনার জন্য পাস্তা, খিচুড়ি, গরু ভুনা, রুটি, পরোটা ডিম, সবজি একেকদিন একেকটা। স্যরি স্যরি আমি বলতে ভুলে গেছি উনার কিন্তু মিনিটে মিনিটে চা লাগে, তা উনি নিজেই গরম পানিতে টি ব্যাগ ফেলে দেন! তো, আপনি করেনটা কী সারাদিন আশ্চর্য!
আপনার স্বামী ঘুম থেকে উঠলেন, উনার ব্যক্তিগত কাজ সেরে কিছুক্ষণ উনি টিভিতে দেশ দুনিয়ার হালচালে চোখ রাখলেন, এবার উনি বাবুটির মতো নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে গেলেন…আর উনার নামের শেষে শুধু ডিগ্রীর লাইন পড়তে থাকলো, আজ এই সেমিনার তো, কাল ঐ সেমিনার, হিল্লি দিল্লি, টিভি টক শো, ইন্টারভিউ ইত্যাদি ইত্যাদি।
শুনুন, আমাকে আবার একচোখা ভাববেন না যেন আমি আপনার গল্পটিও বলবো … আমি আপনাকে খুব ভালো করে চিনি মহাশয়া…তবে আপনার গল্প বলা আমার জন্য খুব সহজ আবার বেদনারও। আপনার ডিগ্রী দূরে থাক, একটা বলার মতো(!)চাকরিই করে উঠতে পারলেন না। অথচ ভালো ছাত্রী হিসেবে অনেক নামডাক ছিলো আপনার…লেখাপড়া আপনি ভুলতেন না বলেই জানি। আর আজ? সেই আপনার একটা মোবাইল নাম্বারই মনে থাকে না! কিন্তু আপনার ঠিকই মনে রাখা লাগে উনার রুমাল, টাওয়েল, রেজার বা সেন্টটা রাখা হয়েছে কোথায়, নেইল কাটার কোথায়, বাচ্চার ক্লিপ, মোজা বইখাতা পেন্সিল রাখা হয়েছে কোথায়!
আপনার কাজ হলো হুকুম মতো সব হাজির করা, আর যদি এর কোনকিছু আপনি খুঁজে না পান তাইলে আপনার সামনে কেয়ামত অপেক্ষা করতে বাকি নেই বাছাধন!
আচ্ছা এই সংসারে আপনার কাজটা কী, বলুন তো! যদি এসব সামান্য জিনিসই আপনি সময়মতো না হাজির করতে পারেন, আপনার তো রোজগার করা লাগে না, টাকা রোজগার করা কী জিনিস তা কি আপনার মাথায় আছে! আমি তো খাওয়া ছাড়া আর কাজ দেখি না আপনার। সারাদিন আপনি বাসায় কী করেন?
স্যরি বলতে ভুলেই গেছি আপনার মেয়ে, ছেলে এরা আবার পড়ালেখায়ও ব্যাপক ভালো। তাদের অ, আ, ক, খ সব আপনার হাতেই শুরু। আপনার স্বামী কিন্তু একটা অক্ষরও তাদের শেখান নাই। আমার ধারণা আপনারা মায়েরা সবাই পরিস্কার বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি! একটা শিশুর যোগ বিয়োগ, গুণ-ভাগের হাতেখড়ি দেয়া কতোটা ঝক্কির কাজ, তা সেই শিশুর মা আর আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। তো, সেই আন্ডা বাচ্চাদের সেই মায়েরা এসময় কত ধরনের টেকনিক যে আবিস্কার করেন, যা নিউটনের আবিস্কারের থেকে কম নয় সিরিয়াসলি!
থাক, আমি ওদিকে আর না যাই। তো আপনার সকাল আর সন্ধ্যা এক হয়ে গেছে বাচ্চা আর স্বামীর পিছনে ঘুরে ঘুরে। সে বাচ্চার স্কুল কিংবা তার কোচিং এর সামনে রোদ বৃষ্টি, ঝড় যাই হোক দাঁড়িয়ে থাকার কাজটা কিন্তু আপনার। তারপর ধরেন, আপনার বাচ্চাটা পরীক্ষায় একটু খারাপ করেছে…তার দায়ভারও আপনারই। তাই স্বামী মহামান্যের কথার তীর-ধনুক আপনার দিকে তাক করা ছাড়া আর কার দিকে তাক করা থাকবে বলুন!
বাচ্চা মানুষ, তার জ্বর সর্দি কাশি লেগেই আছে…বাচ্চা কিন্তু সারারাত আপনার কোল থেকে নামবে না…বাচ্চার বাবা আপনাকে বললেন, “কোনো সমস্যা হলে ডেকো।” তারপর থেকে আপনি সারারাত ক্রমাগত উনার নাক ডাকা ছাড়া আর কিছু শুনবেন না। আর এদিকে বেচারা আপনার দুচোখের পাতা একটিবারের জন্যও এক হলো না, কতবার যে বাচ্চার বমি আর হাগু পরিস্কার করলেন, তা একমাত্র আল্লাহ্ জানেন। এই করে করে রাত পেরিয়ে ভোর হলো, আপনার নাওয়া-খাওয়া শিকেয় উঠলো। তবু আপনার রুটিন মাফিক কাজ আপনারই থাকবে, সে পৃথিবী উল্টে গেলেও।
আর ওদিকে মহাব্যস্ত গৃহকর্তা, আজ এই সেমিনার তো কাল ঐ সেমিনার, আজ এই দেশ তো কাল ঐ দেশ। তো, মহাশয় আপনি পুরো সংসার ফেলে উড়াল দিলেন…তবুও সংসার কিন্তু ভেসে যাচ্ছে না, চলছে ঠিকঠাক। কারণ আপনার সেই ভাত রান্না করা বউটিই সংসারটা সামলাচ্ছেন একা একা…বাজার, রান্না, সন্তান সব একাকি তার হাতে।
তারপরও আপনি বউয়ের তাক লাগানো একটা ক্যারিয়ার, এতো এতো ডিগ্রী আশা করতেই পারেন, আমরা কেন জানি পারি না…আমি সবসময় বিশ্বাস করি আপনি টপ করে সুপারম্যান হিসেবে আকাশ থেকে পড়েননি! অবশ্য অনেকের এতো এতো সমস্যা থাকতেও যে ক্যারিয়ার হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়…আর মনে রাখা দরকার সবার সবকিছু একরকম করে হয় না…একেক জনের জীবন একেক রকম, একজনের সাথে আরেক জনের মেলানো যায় না। কারণ কেউ বিল গেটস হয় কেউ কেরানি, কেউ এলিস ওয়াল্টন হয়, কেউ বা ঘুটে কুড়ানি। (কাউকে বড় ছোট করছি না, শুধু অবস্থানটা বুঝানোর চেষ্টা করছি)
যাক সে কথা ভাইয়েরা আমার, আপনার যদি পরিবারের সবার জন্য রান্না আর অফিস এ দুটো একসাথে করতে হতো, তাহলে কি সংসারটা সোনামুখ করে কখনো করতেন? বোধ হয় না, আর বাচ্চা পালা তো বাদই দিলাম।
আর একজন চাকুরীজীবী নারী যিনি সংসারের সবগুলো কাজ করে তারপর চাকুরিটা করেন। আর হ্যাঁ জনাব, নারীদের অফিস কিন্তু অফিস না, ওটা একটা আরামের জায়গা! তো, ঐ আরামের জায়গা থেকে ফিরে আপনার চা রেডি করা, আপনার প্লেটে ভাত তুলে দেয়া, গ্লাসে পানি এগিয়ে দেয়া তার নৈতিক দায়িত্বই বৈকি! আর আমার মতো মূর্খ মানুষরা কেন যেন অনেক কিছু সহজে বুঝতে চাই না! হাউজ ওয়াইফ তো, বুদ্ধির ঘাটতি একদম পাক্কা।