সম্পর্ক, বিশ্বাসভঙ্গ, সম্পর্কচ্ছেদ: অপরাধ ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা

অনুপম সৈকত শান্ত:

এক
মেয়েটা খারাপ ছিল। বা, নাহ মেয়েটা খুব ভালো। ছেলেটা ভালো, ছেলেটা খারাপ। এইরকম আলাপ দেখলেই- মাথায় আসে, এই ভালো আর খারাপের সংজ্ঞা কী? ভালো, খারাপ নির্বাচনের ক্রাইটেরিয়াই বা কী?
আর এইরকম ভালো-খারাপ বিচার কি আপেক্ষিক না? মানে, একেকজনের কাছে একেকজনকে ভালো লাগতে পারে, খারাপ লাগতে পারে- সবই তো যার যার ব্যক্তিগত রুচি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। ফলে এ নিয়ে কি সর্বকূলে সম্মত হওয়ার মতো কোন কিছু পাওয়া সম্ভব, কিংবা জরুরি? ফলে অমুক ভালো, তমুক খারাপ- এ ধরনের আলাপরে আমি ইগনোরই করতে চাই; সে তুলনায় কেউ অপরাধী কী নিরপরাধ- সেই আলাপটাকে জরুরি মনে করি!

দুই
সভ্য দুনিয়ার কোন আইনেই দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সম্মতিপূর্বক যৌন সম্পর্ক অপরাধ নয়। প্রাক সভ্যযুগে উদ্ভুত ধর্মগুলোতে অবশ্য “বিবাহ” নামক শর্তকে আবশ্যক করা হয়েছে, যদিও সেই আবশ্যকীয়তা পুরুষদের জন্যে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে শিথিল করে রাখা হয়েছিলো।

যাই হোক- সে ভিন্ন আলাপ। কেননা এইসব ধর্মীয় বিধান রাষ্ট্রীয় আইন থেকে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে কেবল সামাজিক- নৈতিক ধ্যানধারণার মাঝেই আবদ্ধ হয়ে আছে। তো যা বলছিলাম- আমাদের বাংলাদেশের আইনেও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সম্মতিপূর্বক যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার উপায় নেই। যতই দুদিন পরপর “প্রেম” করার অপরাধে বিভিন্ন ম্যাজিস্ট্রেট/লোকাল এমপি/নেতাদেরকে পার্কে হানা দিয়ে জুটিদের হেনস্থা করতে দেখা যাক না কেন!

দুজনের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক অপরাধ হবে তখনই- যখন একজনের বয়স নির্দ্দিষ্ট মাত্রার কম হবে, কিংবা দুজনের একজন অপর কোন ব্যক্তির বিবাহিত স্ত্রী হবে। অর্থাৎ, যৌন সম্পর্কে লিপ্ত দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কেউ বা উভয়ই বিবাহিত/ বিবাহিতা হলেও তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না যতক্ষণ বিবাহিতা নারীর স্বামী এসে অভিযোগ উত্থাপন করে; এবং এই অভিযোগটি সে উত্থাপন করতে পারতে পারবে তার স্ত্রীর পার্টনারের বিরুদ্ধে- মোটেও স্ত্রীর বিরুদ্ধে না। অর্থাৎ, বিবাহিত/ অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক নারী অপর যেকোনো বিবাহিত/অবিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হলেও অপরাধী হবে না। বিবাহিত/অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষও অপর যেকোনো অবিবাহিত নারীর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হলেও অপরাধী হবে না।

তবে কোন পুরুষ যদি বিবাহিত নারীর সাথে তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া সম্পর্কে লিপ্ত হয়- তাহলে সে অপরাধী বলে বিবেচিত হবে। বৃটিশ আমলের এই পেনাল কোডটি যথেষ্ট সমালোচনার পাত্র; সম্প্রতি ভারতীয় আদালত এই ধারাটি রদ করেছে। অর্থাৎ ভারতের বর্তমান আইন অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক দুজনের সম্মতিই যথেষ্ট; দুজনের ধর্ম- বর্ণ- গোত্র – বৈবাহিক অবস্থা- লিঙ্গ- কোনকিছুই পূর্বশর্ত নয়- সেই যৌনসম্পর্ককে আইনসিদ্ধ হওয়ার জন্যে। সমস্ত সভ্য দুনিয়াতেই এমন আইন প্রচলিত।

তিন
আমাদের সমাজে- কাউকে অপরাধী বা নিরপরাধ বিবেচনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের চাইতেও সামাজিক তথা নৈতিক বিচার অনেকাংশে গুরুত্ব পায়! অর্থাৎ, বিশ্বাসভঙ্গ কি অপরাধ, না কি না? একটা সম্পর্ক থাকা অবস্থাতে (সেটা বৈবাহিক সম্পর্কই শুধু না) অন্য কারোর সাথে সম্পর্কে যুক্ত হওয়া কি অপরাধ? দেশের আইনে অপরাধ না! মানে, শাস্তিযোগ্য অপরাধ না। ফলে- এমনটার জন্যে সাজা প্রদান করা যাবে না। আদালতে গেলে- অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন খুব ভালো কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় বিবাহ বিচ্ছেদের।
অর্থাৎ, অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক হয়ে গেলে- সবার আগে দরকার সেটা প্রকাশ্যে এনে পূর্বতন সম্পর্কটি ভেঙ্গে দেয়া। ব্যস এতোটুকুই। ফলে, এক্ষেত্রে প্রশ্নটি অপরাধ সম্পর্কিত নয়; বড়জোর নৈতিকতার। প্রশ্নটিকে পাল্টে এমন করতে পারি- একটি সম্পর্ক থাকা অবস্থায় আরেক জায়গায় সম্পর্কে লিপ্ত হওয়াটা কি নৈতিক? এর জবাব হবে, অবশ্যই নৈতিক না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে- চলতে ফিরতে আমরা নৈতিক না- এমন অসংখ্য কাজ করে থাকি- [তাছাড়া, নৈতিকতার মানদণ্ডও কিছুটা আপেক্ষিক]- এর জন্যে কাউকে সাজা প্রদান করা যায় না।

রাস্তায় পড়ে থাকা একটা মৃতপ্রায় কুকুর বা বিড়ালকে দেখেও নিজের কাজে যথারীতি চলে যাওয়া নৈতিক কি? না, নৈতিক না, মানে অনৈতিক। কিন্তু অপরাধ কি? না, অপরাধ না, মানে এর জন্যে কাউকে সাজা প্রদান করা যাবে না। আচ্ছা, ঐখানে যদি কুকুর-বিড়ালের জায়গায় একজন মৃতপ্রায় মানুষ থাকতো- তবে সেটা কি কেবল অনৈতিক, নাকি অপরাধও? এমনক্ষেত্রে আমাদের নৈতিকতার জায়গা এমনই টনটনে যে- তাকে অপরাধও বলে ফেলি। রাস্তার একটা কুকুর বা বিড়ালকে মেরে ফেলা অনৈতিক বলছি, অনেকের কাছে সেটা অপরাধ সমতুল্য। যেমন বাংলাদেশের মানুষ এতো এতো অপরাধ দেখেও, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এমন খুন-গুম-গণতন্ত্র হত্যা দেখেও যখন চুপ করে বসে থাকে- নিদেন প্রতিবাদও করে না- সেটাকে কেবল অনৈতিক না, রীতিমতো অপরাধ হিসেবে আমি মনে করি। কিন্তু এই অপরাধের তো কোন আইনি সাজা সম্ভব না! ফলে, একে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করার কোন কার্যকারিতাও নাই। সুতরাং শুনতে যেমনই লাগুক- বাংলাদেশে খেয়াল বশে একটা কাক বা শালিক পাখি মেরে ফেলা অনৈতিক হলেও অপরাধ না, কিন্তু অতিথি পাখি মেরে ফেলা অপরাধ (এবং অনৈতিকও)।

চার
অনৈতিক, অপরাধের বাইরে- আরেকটা শব্দ প্রচলিত, পাপ। এটা ধর্মীয় ধারণা থেকে উদ্ভুত, ফলে সাজার জন্যে মনুষ্য আদালতের উপরে নির্ভর করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়- স্রষ্টার আদালতের জন্যে অপেক্ষা না করেই স্বতপ্রণোদিত হয়ে পাপীকে সাজা দেয়ার চল বিরাজমান। সামাজিকভাবে, কিংবা পারিবারিকভাবে। এই সাজা অনেক সময়ই শারীরিক পর্যায়ে চলে যায়- যা রীতিমতো রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধ (অনৈতিক তো বটেই)। ফলে, কোনো একজন বিবাহিত ব্যক্তি যদি অন্যত্র সম্পর্কে লিপ্ত হয়- তবে সেটিকে অনৈতিক বলা যেতে পারে, কিন্তু তার জন্যে সেই ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করা- শুধু অনৈতিকই নয়- রীতিমতো অপরাধও। এই অপরাধে অপরাধী ব্যক্তিটি যদি আত্মহত্যাও করে থাকে- তবু সেই অপরাধে সে অপরাধী, কেবল তার পার্টনারকে শারীরিক নির্যাতনের জন্যে অপরাধী নয়- আত্মহত্যার অপরাধেও অপরাধী।

পাঁচ
কিন্তু আত্মহত্যার প্ররোচনাও কি অপরাধ নয়? সেই দায়েও কি তার পার্টনারকে অপরাধী বলা যাবে না? “আত্মহত্যায় প্ররোচনা” – ব্যাপারটি বেশ গোলমেলে। যেকোনো ভাবেই একজন সেই প্ররোচনা পেতে পারে; বাবা-মা কেন বন্ধুর চাইতে বেশি গরীব- এটাও অনেক সময় কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে, যে ছেলেটি বা মেয়েটিকে ভালোবেসে কাছে চেয়েছিলাম- সে কেন প্রেমে সাড়া দিলো না- এটাও প্ররোচনা দিতে পারে।
ফলে যেকোনো প্ররোচনাকে অপরাধ বলা মুশকিল- নিদেন অনৈতিকও বলা যায় না। বরং যে কারণটিতে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে- সেটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা দরকার, তা সেই ব্যক্তির প্রতি অপরাধ কি না (অনৈতিক কি না)! অর্থাৎ আমি জনসম্মুখে একজনকে অপমান করলাম (যেমন গ্রাম্য সালিশ ডেকে বেতের বাড়ি দিলাম বা মাথা মুড়ে দিলাম), সে অপমানে বিষ খেলে সালিশকারীদেরকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে বিচার হবে; কিন্তু কোন ব্যক্তিকে (ধরলাম একজন শিক্ষককে) আদালত চুরির দায়ে সাজা দেয়ার পরে অপমানে আত্মহত্যা করলে- বিচারক- উকিল-বাদী কাউকেই অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে না (যদি না পরবর্তীতে মিথ্যা মামলা প্রমাণ না হয়)।

ফলে আত্মহত্যায় প্ররোচনার ব্যাপারটির ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করা সেই ব্যক্তির প্রতি কৃত অপরাধ দেখা দরকার। যেমন, কোন স্ত্রী যৌতুকের জন্যে স্বামী- শাশুড়ি- ননদ- সবার লাঞ্ছনা, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলে, আত্মহত্যায় প্ররোচনার অপরাধে স্বামী- শাশুড়ি-ননদরা অভিযুক্ত হবে। এখন স্বামী যদি আত্মহত্যা করে থাকে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী কীভাবে প্ররোচিত করতে পারে?
স্ত্রী সংসার ভেঙ্গে দিতে চেয়েছে, মানে ডিভোর্স চেয়েছে। হ্যাঁ, এটাও একটা প্ররোচনা; কিন্তু এটা তো কোনো অপরাধ না। দাম্পত্য কলহের মাথায় স্ত্রী কিছু একটা কটু কথা বলেছে। হ্যাঁ এটাও প্ররোচিত করতে পারে আত্মহত্যায়, কিন্তু সেটা কোনো অপরাধ না। স্ত্রী স্বামীকে অপমান করেছে (যেমন- রাতে একসাথে থাকতে চায়নি বা স্ত্রীর ব্যক্তিগত বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে … ইত্যাদি), এই কারণেও স্বামী আত্মহত্যা করতে পারে- কিন্তু কোনোটাই অপরাধ না।

স্ত্রী কি স্বামীকে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করতো (হয়তো- স্ত্রীর ষণ্ডা পাণ্ডা ভাইদের সহায়তায়), যা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে? – হ্যাঁ, তাইলে এক্ষেত্রে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অপরাধে অভিযুক্ত হবে স্ত্রী ও তার ভাইরা। স্ত্রী কি কোন উপায়ে স্বামীকে ব্লাকমেইল করতো এবং তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় রাখতো (যেমন- স্বামীর পরিবারের কোন কোন সদস্য স্ত্রীর পরিবারের উপরে নির্ভরশীল- কিংবা স্বামীর এমন কোন দুর্বল পয়েন্ট স্ত্রীর জানা, সেটাকে দেখিয়েও নানাভাবে ব্লাকমেইল করা- মানসিক নির্যাতন করা), এরকম ক্ষেত্রেও আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আসতে পারে।

আচ্ছা, স্ত্রী স্বামী বাদে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হলে- স্বামী আত্মহত্যা করলে? স্ত্রীর কর্মটি তো কোনো অপরাধ নয়- ফলে এর জন্যে স্বামী যদি আত্মহত্যা করে থাকে- তাহলে সেটা তাকে নিজ দায়িত্বেই করতে হবে বৈকি!

ছয়
কিন্তু এই যে বিশ্বাসভঙ্গ করে অন্যত্র সম্পর্কে লিপ্ত হলো- সেটা তো এটলিস্ট অনৈতিক, নয় কি? এমন অনৈতিক কাজের কোন দায় কি স্ত্রীর নেই? হ্যাঁ, দায় দিতে চাইলে দেয়াই যায়। যেকোনো সম্পর্ক ভাঙ্গায় (প্রেম- বিয়ে- বন্ধুত্ব) কেউ আত্মহত্যা করলে- তার দায় কিছুটা হলেও অন্যের ঘাড়ে তো পড়েই- তা সেই অন্যপক্ষ যতোই তার মৃত্যুকামনা না করে থাকুক।
ফলে এমন দায় স্ত্রীর ঘাড়ে দেয়া যেতেই পারে।

কিন্তু আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে ফাঁসির দাবি যে উঠছে- সেটা একেবারেই হাস্যকর, নিদেন সাজাও এখানে প্রাপ্য না। আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয়- বিশ্বাসভঙ্গ করে বিবাহিত নারীর অন্যত্র সম্পর্ক করা নিয়ে সকলে যতখানি সোচ্চার, বিবাহিত পুরুষের এহেন সম্পর্কের ব্যাপারে কি সকলেই ততোটাই নীরব নয়? মিটিমিটি হাসি, “ব্যাটাছেলেদের ঐরকম একটু আধটু হয়েই থাকে”- এহেন প্রতিক্রিয়া ভিন্ন আর কিছু কি মিলে?
অন্য নারীর সাথে সম্পর্কের জের ধরে যদি সব স্ত্রী আত্মহত্যা করতো- তাইলে বাংলাদেশে নারীর সংখ্যা ৪ ভাগের ৩ ভাগ কমে যেত! এমন কোনো একটা উদাহরণ কি পাওয়া যাবে- যেক্ষেত্রে স্বামীর অন্য নারীর সাথে সম্পর্কের জন্যে সেই পুরুষটিকে সবাই মিলে ঘৃণার চোখে দেখছে, “বেশ্যা”, “মাগী”, “খানকি”- এসব বলে উঠতে বসতে গালানো হচ্ছে? একজন নারীর এরকম অভিযোগে যে পরিমাণ ছি ছি রব পড়ে গেছে পুরুষ-নারী সকল মহলে, তার এক শতাংশও কি একজন পুরুষ একইরকম ঘটনায় বিদ্ধ হয়? আর স্বামী নিজে আত্মহত্যা করার আগে যেভাবে মনের খায়েশ মিটিয়ে স্ত্রীকে পিটায়, স্ত্রী কি তা পারে? নাকি একলা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আত্মহত্যা করতে হয়, কিংবা স্বামীকে বাঁধা দিতে গিয়ে প্রবল নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়? কোনটা বেশি ঘটে?

সাত
হ্যাঁ- আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে, নারীরা বৈষম্যের শিকার- এটা স্বীকার করেও এবং এই বৈষম্যের অবসান চেয়েও কি- নারীর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথা এরকম বিশ্বাসভঙ্গের বিরোধিতা করা যায় না? যাবে না কেন, অবশ্যই যায়। কিন্তু সেই আলাপটা তো নৈতিকতার আলাপ। কী করা উচিৎ, কী করা উচিৎ না- এই সংক্রান্ত। কেউ অনৈতিক আচরণ করলে- একটা মাত্রা পর্যন্ত তাকে ধিক্কারও দেয়া যেতে পারে। কিন্তু, সাথে এটাও মাথায় রাখা দরকার- নৈতিকতার ধারণা বেশ আপেক্ষিক- আমার কাছে যা নৈতিক বা যা অনৈতিক- সেটা দুনিয়ার আর সকলের কাছেই একইরকম, এমন আশা করা অনুচিত। সেই জায়গা থেকেই আলাপ হওয়া দরকার। ফলে, কোন ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সমস্তভাবে হেয়, অপদস্থ করার চাইতেও দরকার- নৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিমূল নিয়া আলাপ আলোচনা! আলাপ করা দরকার, আজকের সমাজে সম্পর্ককে কীভাবে দেখা হবে, বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান- তার কার্যকারিতা, উপযোগিতা- এসব কিছুর আলাপ জরুরি।

আট
কিন্তু, এরকম অনৈতিক কাজ করা একজনের পক্ষে দাঁড়ানো মানে কি পরকীয়া আর বহুগামিতাকেই প্রমোট করা না? “পরকীয়া”, “বহুগামিতা”কে নতুন করে প্রমোট করার কিছু নেই- দুটোই সমাজে প্রবলভাবে আছে। বস্তুত পুরুষদের জন্যে- এ দুটিই সমাজে বেশ গ্রহণযোগ্য আকারেই আছে যাবতীয় ভয়- নারীদের বেলায়। যাই হোক- এসব সমাজে কেন আছে, কী দরকার, কেন দরকার হয়ে যায়- এগুলোও বুঝা দরকার।
সাধারণভাবে আমি মনে করি, একটি সম্পর্কে কমিটমেন্ট থাকার পরেও অন্য আরেকটি সম্পর্কে জড়ানো উচিৎ না! কিন্তু, এই ঔচিত্যবোধ দিয়ে সবসময় মানুষ চলতে পারে না; ফলে এর মাঝেই অন্যত্র সম্পর্ক হয়ে যেতেই পারে। সেটা হয়ে গেলে- সবচেয়ে এক্সপেক্টেড কাজটি হচ্ছে- এক্সিস্টিং সম্পর্কে ছেদ টানা, যত দ্রুত সম্ভব এক্সিস্টিং সম্পর্ককে জানানো।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- আমাদের সমাজে নারীদের যে অবস্থান, তাতে বিশ্বাসভঙ্গকারী পুরুষ পার্টনারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সেই নারীটিকে একদম ছিন্নমূল করে দেয় বিধায় সে সবকিছু সহ্য করে নিয়েও সংসারে টিকে থাকতে চায়; উল্টোদিকে পুরুষ তার পার্টনারের বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটিকে স্রেফ মানতে পারে না বিধায় মারধর থেকে শুরু করে- একদম গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া থেকে শুরু করে- এমনকি স্রেফ সন্দেহের বশে জানেও মেরে ফেলে অনেক সময়।
ফলে সাধারণভাবে পুরুষদের এরকম সম্পর্কে যুক্ত হওয়ায় ক্ষেত্রে কিছু আইনি বাঁধা থাকার দরকারও মনে করি (আপদকালীন হিসেবে)- কিন্তু বস্তুত অধিক দরকার- যাতে নারীর স্বাবলম্বী হওয়া, সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হতে পারে। আর সম মর্যাদার, সমপর্যায়ের শিক্ষিত, সমপর্যায়ের কর্মক্ষম কাপলের ক্ষেত্রে মনে করি, দুজনেরই ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে- সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ও সম্পর্ক ভাঙ্গার, সম্পর্ক ভেঙ্গে নতুন সম্পর্ক করাও সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে।

একবার বিয়ে হয়েছে বলে (বা একবার সম্পর্ক হয়েছে বলে) সেই সম্পর্ক আজীবন টিকিয়ে রাখতে হবে- নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপাড়া- মনের মিল- এগুলো যেমনই হোক, যত নিচেই নামুক- সম্পর্ক যুগ যুগান্তের জন্যে অকৃত্রিম- পাকপবিত্র বিধায় তা ধরে রাখতেই হবে, কিংবা আর আজ আমার পার্টনার বলেই সে অতীতে কিংবা ভবিষ্যতে কোনদিন অন্য কারোর পার্টনার হতে পারবে না- এরকমটা আমি মনে করি না। সেই অর্থে – হ্যাঁ আমি বহুগামিতাকে প্রমোট করছি। সবসময়ই করি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.