ফারজানা আকসা জহুরা:
আজকাল নাকি দেশি মেয়েরা আর প্রবাসী ছেলেদের বিয়ে করতে চাচ্ছে না! আর এই খবর শুনে প্রবাসী ভায়েদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে! ওদিকে শুনলাম মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেও নাকি বাংলাদেশে ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়! আচ্ছা, এমন আলাউদ্দিনের চেরাগ দেশি পাত্র ছেড়ে, কোন মেয়ে চাইবে বিদেশি পাত্র বিয়ে করতে? বিদেশে কি এতো সহজেই কেউ কোটিপতি হতে পারে?
দেশে যেখানে কাজের লোক দিয়ে ঘরের সব কাজ করানো যায়, বাচ্চা-কাচ্চা পালার জন্য বাবা-মা-শ্বশুর-শাশুড়িসহ চৌদ্দগুষ্টিকে কাছে পাওয়া যায়, সেখানে কোন মেয়ে চাইবে বিদেশে গিয়ে সারাদিন বাচ্চা আর সংসারে পিছনে ফ্রিতে কামলা দিতে?
নিশ্চয় আমার কথা শুনে খুব রাগ হচ্ছে? কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো, এই যে আপনারা, মানে প্রবাসীরা এতো কষ্ট করে যে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করেন, সেই অর্থ দিয়ে আপনারা কী কী করেন?
বেশিরভাগই তো নিজেদের আয়-রোজগারের সিংহভাগ দেশে পাঠিয়ে দেন, কি তাই না? সেই টাকা আপনাদের পরিবার নিজেদের সুখ সুবিধার পিছনে খরচ করে। বাবা মায়ের চিকিৎসা, বোনের বিয়ে, ভাইয়ের পড়াশোনা করাতে করাতে আপনারা নিজেদের হাড্ডি মাংস সব এক করে ফেলেন!
আপনাদের টাকা দিয়ে এক সময় বাড়ি হয়; একতলা দোতলা, তিন তলা। দুই দিন পরে গাড়ি কেনা হয়। বোনেদের বিয়েতে দশ-বিশ ভরি গহনা দেওয়া লাগে! ভাইয়েদের হাতে আইফোন না থাকলে তাদের কোনো সম্মান থাকে না! অথচ আপনারা আধপেট খেয়ে, পুরাতন ভাঙা মোবাইল দিয়ে, দিন-রাত না ঘুমিয়ে, ওভারটাইম কাজ করে করে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন!
আপনাদের এই কষ্টে অর্জিত অর্থ দিয়ে আপনাদের পরিবারের উন্নতি হয় ঠিকই, কিন্তু আপনাদের নিজেদের জন্য কোনো কিছুই হয় না। না আপনারা নিজেদের জন্য কোনো সঞ্চয় করতে পারেন।
পরিবারের বোঝা টানতে টানতে আপনাদের দিন রাত বছর কাটে। আথচ আপনাদের কথা তারা কখনোই চিন্তা করে না। হঠাৎ যখন তাদের মনে হয়; ছেলের বিয়ে দিতে হবে, ততদিনে কিন্তু আপনারা মধ্যবয়সী। এই মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পাত্রের জন্য তারা তখন খুঁজে খুঁজে সহজ, সরল, হাবাগোবা একটা বাচ্চা মেয়ে ধরে নিয়ে আসে। যে মেয়েটিকে দিয়ে কাজের লোকের মতো ঘরের সব কাজ করানো যাবে, এবং যে মেয়েটি তাদের কথামতো উঠবে আর বসবে!
আচ্ছা বলেন তো, জেনে শুনে কোন মেয়ে দেশি কাজের বেটি হইতে চাইবে? আর কোন পরিবার তাদের বাচ্চা মেয়েকে এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিবে?
সবচেয়ে বড় কথা, যে পরিবারের জন্য আপনারা এতো কষ্ট সহ্য করেন, সেই পরিবার কি আপনাদের ততোটা আপন ভাবতে পারে? যে ভাইবোনের চাহিদা বছরের পর বছর মিটিয়ে এসেছেন, তারা কি আপনার দুঃখ-কষ্ট অনুভব করতে পারে?
নারে ভাই পারে না।
একটু সম্পত্তির ভাগ চেয়ে দেখেন তো? দেখবেন যে বাবা আপনার টাকায় বাড়ি করেছে, সে কিন্তু বাড়ি তার বলে ঘোষণা দিবে! যে বোনকে দশ ভরি গহনা দিয়েছিলেন, সে কিন্তু আপনার বিয়েতে এক ভরি গহনাও দিবে না। ভাইরে, টাকা ছাড়া তো আপনাদের জন্মদাতা বাবা-মাও আপনাদের খোঁজ নেয় না, তাহলে কি করে অন্য একটি মেয়ের কাছে এতো ত্যাগ প্রত্যাশা করেন? যেখানে একই মায়ের পেটের ভাইবোন আপনাদের টাকার মেশিন ছাড়া আর কিছু মনে করে না, সেখানে পরের বাড়ির মেয়ে টাকা-পয়সা না দেখে কি আপনাদেরকে বিয়ে করতে রাজী হবে?
কোনো মেয়ে রাজী হবে না।
মানুষ বিয়ে করে সুখি হতে চায়। চায় সাজানো গোছানো একটা সুন্দর সংসার। কিন্তু মাইলের পর মাইল দূরত্বের কারণে আপনারা সেই সংসারটা গড়ে তুলতে পারেন না। আর পারবেন কী করে? সারাদিনের কষ্ট শেষে ফোনে বউয়ের সাথে যে একটু ভাব ভালোবাসার কথা বলবেন তা কি আপনাদের কপালে জোটে?
বউও যে সারাদিনের শ্বশুর-শাশুড়ির কামলা খেটে, ননদ দেবরের খোটা শুনে, প্রতিবেশীদের কটু কথা হজম করে আর প্রেম ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। ফলে বিয়ের দুইদিন পরেই আপনাদের মধ্যে শুরু হয় মান-অভিমান।
ওদিকে মা-বাবা সেই অভিমানে ঘি ঢালে। কিছু হলেই তারা নতুন বউকে দোষারোপ করতে থাকে। প্রবাসে বসে আপনারা কি সমস্যা সমাধান করবেন? আর কাকে থুয়ে কাকে বিশ্বাস করবেন? এসব কিছু মিলে বিয়ের পরে তো আপনাদের জীবন আরও অতিষ্ট হয়ে ওঠে! না বউ আপনাদের বোঝার চেষ্টা করে, না আপনারা বউদের কষ্ট বোঝেন!
তাহলে কি প্রবাসীরা মানে আপনারা বিয়ে করবেন না? সুখের স্বপ্ন দেখবেন না?
অবশ্যই সুখি সংসারের স্বপ্ন দেখবেন। কিন্তু ভাইরে, সংসারের সুখ শান্তি তো স্বামী স্ত্রী দুজনের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে। যে জন্য দুজনকে যথেষ্ট সময় দিতে হয়। কিন্তু প্রবাসে থেকে কি আপনারা একে অপরকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন? একে অপরের সুখ দুঃখে পাশে থাকতে পারেন? একে অপরের সমস্যা উপলব্ধি করতে পারেন? শুধু যৌনতাই তো সবকিছু না, কিন্তু আবার অনেক কিছু। অবশ্য স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যদি খুব ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, যদি একে অপরকে ভালোভাবে বুঝতে পারে, তাহলে কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।
তাই আপনাদের উচিৎ বিয়ের সময় নিজের আর্থিক অবস্থা ও দায়-দায়িত্বের কথা পাত্রীকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা। পারলে এমন মেয়ে বিয়ে করা যে মেয়ে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে। অল্প বয়সী মেয়ে, যারা এখনেও জীবন সম্পর্কে কিছুই বোঝে না, তেমন পাত্রী বিয়ে না করাই উত্তম। যে আপনার কষ্ট বুঝতে পারবে, আপনার সুখ দুঃখে ভাগ নিতে পারবে তেমন মেয়ে বিয়ে করা।
নিজে জন্য বিয়ে করা, একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া। দয়া করে অসুস্থ বাবা মায়ের সেবাযত্নের জন্য কাজের মানুষ বিয়ে করে ঘরে আনবেন না। পারলে বাবা মায়ের দেখাশোনার জন্য একজন সাহায্যকারী রাখুন। সংসারে সব কাজের বোঝা বউয়ের উপরে চাপিয়ে দিবেন না। সংসারে কাজ করা খারাপ না, বরং ভালো। কিন্তু বউ তো আর কাজের লোক না, তাই না? তাই তাকে সম্মান করতে শিখুন। যতটুকু সম্ভব তাদের সমস্যাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বউকে সম্মান না দিলে, তার সাথে বন্ধুত্ব গড়তে না পারলে বউ অন্য কাউকে বেছে নিবে। তাই আগেই সাবধান হোন। বাবা মা ভাই বোনের কথায় বউকে অযথা সন্দেহ করবেন না। নিজের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগিয়েন। বউকে কাজের মানুষ নয়, বন্ধু, জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবুন।
সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যে আপনারা বছরের পর বছর এতো কষ্ট করে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারেন, তাহলে কি আরেকটু কষ্ট করে নিজের জন্য আলাদাভাবে কোনো সঞ্চয় করতে পারেন না? নিজের জন্য, নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য আলাদাভাবে সঞ্চয় করতে শিখুন। আপনারা যদি নিজের ভবিষ্যৎ নিজেরাই নিশ্চিত করতে না পারেন, সেখানে অন্য একজনকে বিয়ে করে সংসারে দায়-দায়িত্ব নিবেন কীভাবে?
আর হ্যাঁ, আপনারা অনেক পরিশ্রম করেন, আপনাদের টাকায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয়, আপনারা দেশের জন্য, পরিবারের জন্য অনেক কষ্ট করেন, সবাই বুঝলাম। কিন্তু এই কষ্টের জন্য কি সব মেয়ে চাহিবামাত্র আপনাদের বিয়ে করতে বাধ্য থাকিবে?
দেখুন ভাই, বিয়ে তো প্রতিটা মানুষের নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়, কি তাই না? তাহলে কোন মেয়ে দেশী ছেলে বিয়ে করবে, আর কোন মেয়ে বিদেশী ছেলে, তা তাদের উপরে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বরং আপনারা নিজেদের কথা ভাবুন। শুধু পরিবারের কথা নয়, নিজেদের যত্ন নিন, নিজেদেরকেও একটু ভালোবাসুন।