অর্পিতা শামস মিজান:
শিরোনাম দেখে অবাক লাগছে? বৈষম্যের মতো আগাগোড়া একটা নেতিবাচক বিষয় আবার ইতিবাচক হয় কীভাবে? আসুন, গল্পের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি।
সমতা নামক একটি দেশে, সকল নাগরিকের জন্য সকল কাজ করতে (চিকিৎসাসেবা, ওষুধ, শিক্ষা, চাকুরি, বিবাহ ইত্যাদি) একটি নতুন সফটওয়্যার প্রোফাইল ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। সফটওয়্যারের শর্তাবলী সবার জন্য এক। যেহেতু সব সফটওয়্যার ব্য প্রোফাইলের ফাংশন, বাটন, অপশন এবং সেটিংস এর সুযোগ এক, বলা যেতে পারে যে, তাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করার সমান অধিকার ও সমান ক্ষমতা আছে।
এখন ক জন্মের পর থেকেই কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ পেয়েছে, এবং তার সবসময় ওয়াইফাই এবং মোবাইল ডেটা থাকে। খ এর পরিবার তাকে পুরুষ তত্ত্বাবধান ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয় না এবং তার কোন ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা মোবাইল নেই। গ কেবল ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, কারণ তার গোত্র অচ্ছুত।
এখনও কি মনে হয় যে সমস্ত নাগরিক তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সফটওয়্যারটি একইভাবে ব্যবহার করতে পারবে?
এখন যদি সমতার বাংলাদেশ হয়, সফটওয়্যারটি আইন, ইন্টারনেট গণজীবন, এবং ক-খ-গ নাগরিক যারা সকলে আইনের চোখে সমান, তাহলে? খ ও গ আজ পিছিয়ে আছে কারণ সমাজ তাঁদের ক-এর চাইতে কম সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। যদিও তাদের সকলের একই সফটওয়্যার আছে, খ ও গ এর ব্যবহার সবসময় ক’ এর চাইতে অদক্ষ এবং দুর্বল হবে।
অতএব, সত্যিই যদি নিশ্চিত করতে হয় যে সবাই সফটওয়্যারটি সমানভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তাহলে হয় খ ও গ-কে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও ওয়াইফাই ব্যবহারের সু্যোগ করে দিতে হবে, যেন তাঁরা ক এর সমকক্ষ হয়, অথবা তাঁদের সফটওয়্যার ব্যবহারে সাহায্য করার জন্য বিশেষ কর্মী নিয়োগ দিতে হবে যারা কেবল খ ও গ কেই সাহায্য করবে, ক-কে নয়।
এই যে ‘বাড়তি’ সুবিধা খ ও গ পাচ্ছেন, এটাই ইতিবাচক বৈষম্য। এটি এমন এক বৈষম্য যা ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির জন্য করা হয়, এ বৈষম্য বিগত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে করা হয়, পার্থক্য ঘোচাতে করা হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) বলে ইতিবাচক বৈষম্য একটি অধিকার। এটি একটি বিশেষ পদক্ষেপ যা অধিকতর সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেয়া হয়, ঐ সকল জনগোষ্ঠীর জন্য যারা দীর্ঘ বৈষম্য ভোগ করেছে, যেন এখন তারা সমাজের অন্যদের মতো সকল ক্ষেত্রে সমান প্রবেশাধিকার পায় (মানবাধিকার কমিশন, অস্ট্রেলিয়া)।
এটি শুধু নারী নয়, বরং যেকোনো পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য, যেমন সংখ্যালঘু, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বৃদ্ধ, শিশু ইত্যাদি। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে (১৯৪৮) এ নীতির কথা বলে আছে, এবং প্রেসিডেন্ট কেনেডি ১৯৬১ সালে প্রথম এ শব্দটি ব্যবহার করেন। এটির উৎপত্তি এই বিবেচনা থেকে যে শত শত বছরের কাঠামোগত বৈষম্য ও ঐতিহাসিক নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এখন কেবল সমানাধিকার দিয়ে রক্ষা করা যাবে না। যারা দুর্বল, তাঁদের সমান পূষ্টি দিলে তাঁরা স্বাস্থ্যবান হবে বটে, কিন্তু যখন তাঁরা স্বাস্থ্যবান হচ্ছে, তখন আগে থেকে স্বাস্থ্যবান যারা তাঁরা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ফলে, বিদ্যমান যে ফাঁক, যে শক্তির পার্থক্য, তা থেকেই যাচ্ছে।
সমান অধিকার তাদেরই সাহায্য করে যারা সমান। অসমানদের সমান করার জন্য আগে বাড়তি কিছু দিয়ে ফাঁক পূরণ করতে হবে।
সকল সমাজেই সমস্যা আছে। কিন্তু সব সমস্যা নিয়ে কথা বলা হয় না। বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে, কিন্তু মূল জায়গায় কতটা হাত দিয়েছি আমরা?
পুরুষতন্ত্র, বৈষম্যমূলক প্রথা, স্টেরিওটাইপ, ট্যাবু এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের একটা নারী অধিকারের ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি হয়েছে, যা কিছুটা এরকম, মেয়েরাও মানুষ, মেয়েদের অধিকার আছে, মেয়েদের সমান মজুরি দেয়া উচিত, মেয়ে শিশুদের বৈষম্য করা যাবে না (মীনাকে ধন্যবাদ) প্রভৃতি।
কিন্তু এর পাশাপাশি আরও একটা ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে যা আমরা খেয়াল করলেও খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছি ইভটিজিং খারাপ (কিন্তু অপরাধ কিনা?), মেয়েরাও দেরি করে বাড়ি ফিরতে পারে, (তবে ওরা নিশ্চয়ই খারাপ মেয়ে), মেয়েরাও নেতৃত্ব দিতে পারে (তাঁদের বাবা বা স্বামী করেছিল কিনা তাই) ইত্যাদি।
এই দ্বিতীয় যে ন্যারেটিভ, সেটি দেখিয়ে দেয় যে আমাদের সমাজ নারীর সমতাকে ‘মেনে নিয়েছে’, কিন্তু ‘বিশ্বাস’ করেনি। এজন্য কাগজে-কলমে নারীর সমতা ভালো, তবে বাস্তবে যখনই মেয়েরা অধিকার চাইতে যায়, শুরু হয় হইচই। মেয়েরা কী কী বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে তার শোরগোলে সমতার গলা যায় দেবে, মেয়েদের আলাদা বাসের আসন, চাকুরির কোটা, সংসদে সংরক্ষিত আসন, নারী অভিবাসী শ্রমিকের কোন খরচ লাগে না, মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি!
বটে? নারী পুরুষ যদি সমানই হয়, তবে এতো সুবিধা কেন? মেয়েরা যদি দুর্বল-ই না হয়, তবে পুরুষেরা কেন এসব সুবিধা পাবেন না?
এ প্রশ্নগুলো কিন্তু ফেলে দেবার মতো নয়! মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছোট শিশু থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষক এমনকি পরিপক্ক সরকারি কর্মকর্তারাও এ প্রশ্নটি তুলে থাকেন। এর মানে এ বিষয়টি পরিষ্কার না। ইতিবাচক বৈষম্য নাগরিক জীবনে নারীদের সমতা নিশ্চিত করে (দুঃখজনকভাবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ক্ষেত্রে বৈশম্যের জন্য কোন আইন এদেশে নেই। ক্ষেত্র বিশেষে পারিবারিক সহিংসতা আইন সাহায্য করে)।
মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই যারা পরিবহন বা সংসদের আসন নিয়ে চিন্তিত, তাঁরা কিন্তু নারী যখন সম্পত্তি কম পায়, বা তালাকের অধিকার কম পায়, বা সন্তানের অভিভাবকত্ব পায় না, তখন কোন প্রশ্ন তোলেন না। যদি নারীরাও সমান হোন এবং বাড়তি সুবিধা ভোগ করা অনুচিত, তাহলে কেন আপনারা ছেলেদের সম্পত্তি বেশি পাওয়া নিয়ে কথা বলেন না?
কাজেই আমাদের ইতিবাচক বৈষম্য জানতে ও বুঝতে হবে।
আমরা যতই নারী অধিকারের কথা মুখে বলি, এটি অর্জিত হবে না যতদিন আমরা মেনে না নেই যে নারীরা আজও অবদমিত। রাষ্ট্রীয় সেফটি স্কিম নিয়ে বিতর্ক হয় না, কারণ সবাই জানেন এর দ্বারা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর সুবিধা হয়। ঐ একই জায়গায় নারীকে বসালে ফল হয় উলটো। আমাদের স্বীকার করতেই হবে নারীরা আজও বৈষম্যের স্বীকার, এবং তাঁদের পুরুষদের সমান করে তোলা না পর্যন্ত বাড়তি সুবিধা দিতে হবে।
হয়তো ভ্রু কোঁচকানোর দল ইতিবাচক বৈষম্য নিয়ে আগে মাথা ঘামায়নি, কারণ নারীর সমতা আগে অতটা বোঝা যেত না। আজ নারী এভারেস্ট জয় করছে, আর নিন্দুকেরা তাঁদের শেষ অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে: অজ্ঞতা ও কুযুক্তিঃ ‘মেয়েরা কি কাপড় খুলে রাস্তায় হাঁটতে পারবে?” বডিশেমিং এর ওপর মানুষের সম্মান নির্ভর করে না, তবে মানুষের সাথে আপনার আচরণ কিন্তু আপনার সম্মান নষ্ট করতে পারে।
লেখক আইনের সামাজিক বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এবং হার্ভার্ড ল’ স্কুলের স্নাতক।