জহুরা আকসা:
আমার প্রাণের শহর ঢাকা, তোমাকে খুব মনে পড়ে। আমাদের সেই হলুদ রং চটা পুরনো বাড়ি, খেলার মাঠ, পানির ট্যাংক, মেহেন্দি গাছ, ছাদের রাখা ফুলের টবগুলি সবাই মনে পড়ে।
পুরনো বাড়ি, পুরনো ঘর, পুরনো ভাঙা দরোজা এতো কেন মনে পড়ে জানি না। অথচ এই দেশটা কত নতুন; ঝকঝকে, ঝলমলে …. তবুও আমার সেই পুরনো সাদামাটা স্মৃতিগুলিই মনে পড়ে।
আমাদের সেই পুরনো মিরপুর, যেখানে এতো এতো বিল্ডিং ছিল না, ছিল খেলাধুলার মাঠ। বাড়ির পাশের বড় চওড়া রাস্তা, চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা। সেই সবুজ স্মৃতিগুলি আজও মনে পড়ে।
আমাদের সেই ডাব তলা? যেখানে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে লুকিয়ে লুকিয়ে টাঙ্গিয়ে দিতাম পাড়ার লোকেদের বার্ষিক খেতাব।
যেখানে কারোর নাম হতো “কানাই”, কেউ হতো “সানাই”। এলাকার “বিবিসি লন্ডন, কুমুদিনী, কুটনি বুড়ি” খালাম্মাদের তো অভাব ছিল না। সাথে ছিল ভিলেন আর খলনায়ক টাইটেলধারী ছেলেপেলেদের ভিড়।
দুষ্টুর শিরোমণি আমাদের দেখলেই পাড়ার সবাই বলতো; এসেছে “হাসি খুশি আনন্দো!”
আর থার্টি ফাস্টে, আমাদের মোমবাতি প্রজ্বলিত সারা বাড়ি দেখে বলতো; “হ্যাপি নিউ ফায়ার!”
আমাদের বাড়িটা ছিল মূল রাস্তার পাশে। সেই বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ছুটতে দেখেছি স্বৈরাচারীর পতন।
১৪৪ ধারা কারফিউ উপেক্ষা করে যখন চাচারা আর্মির বিরুদ্ধে মিছিল বের করতো, সাথে মারতো ইট পাটকেল। সেই ছাদে দাঁড়িয়ে আমরাই তো তাদের খবর দিতাম, কোথায়, কোনদিকে তারা আছে!
কত যে মিলিটারিদের বকা খেয়েছি। ছাদে এসে বকাবকি করে গেছে তারা। অথচ সেই স্বৈরাচারীর আমলেও কিন্তু শিশুদের গায়ে হাত তোলা হতো না।
আমরা ভাই বোনেরা কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি, তবে আমরা সেই যুদ্ধের গল্প শুনে বড় হয়েছি। শুনেছি ব্রিটিশদের অত্যাচারের গল্প, শুনেছি দাদা নানাদের মুখে ৪৭ এর দেশ ভাগের স্মৃতি। ইতিহাস বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমাদের এদেশ ওদেশ করে কত দেশ যে ঘুরে বেড়াতে হলো।
এখনও আমরা হাতড়িয়ে বেড়াই সেই দেশ হারানোর স্মৃতি। যা কখনো আপন ছিল, নিজের ছিল। আর আজ তা পয়সা আর ভিসার হিসেবে হারিয়ে গেছে।
একটা সময় সব বদলে গেলো!
তখনো ঈদ আসতো, কিন্তু আমরা আর আগের মতো বাড়ির সবাই মিলে চাঁদ রাত্রি উদযাপন করতাম না। না ছাদে বসে পিকনিক করতাম। শৈশবের স্মৃতিগুলি একটু একটু করে বিলীন হয়ে গেল। তবুও সেই সব হারানো স্মৃতিগুলি গল্প হয়ে রয়ে গেছে মনে।
আহঃ আমাদের সেই হলুদ রংচটা চারতলা বাড়ি! তোমায় গুড়িয়ে একদিন গড়ে উঠল আধুনিক এপার্টমেন্ট। ছিল না সেখানে আমার মায়ের হাতে লাগানো করমচার গাছটি! না রইলো আমার ফুলের বাগান। তবুও তোমার চেহারাটা আজও মনেপড়ে।
চাকরি করতে গিয়ে যখন ঢাকার বাইরে থাকতে হতো, কী যে ছটফট করতাম! কতদিন কত রাত হয়েছে বাড়ি আসতে গিয়ে। কিন্তু তবুও ছুটে আসতাম তোমার কাছে। আর আজ কতগুলো বছর হয়ে গেল, তোমার কাছে যেতে পারি না! কী যে কষ্ট, তা কেউ বুঝবে না। নিজের বাড়ি, নিজের দেশ। কিন্তু না, সে সব তো এখন কিছুই নেই। তবুও এতো কেন মনে পড়ে তোমায়?
এখনো ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখি, আমাদের সেই হলুদ রং চটা পুরনো বাড়ি। যেখানে আমার বাবা ছিল, মা ছিল, আমাদের একটা বড় পরিবার ছিল।