আমাদের জাস্টিন ট্রুডো মাশরাফি

শামীমা জামান:

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষটির নাম কী?
হুমায়ূন আহমেদ।
উঁহু। মরহুম নয়। জীবিত মানুষের কথা বলছি। এই প্রশ্নের উত্তরে হাতে কি চারটা অপশন আছে? না নেই। ভাববারও কিছু নেই।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষটির নাম মাশরাফি বিন মর্তুজা। তবে মাশরাফির সেই প্রবল জনপ্রিয়তার দিন বুঝি শেষ হলো। দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের ভালবাসার জোয়ারে ভাগ বসিয়ে দিলো ঘৃণাজীবীরা। এখন থেকে মানে যেদিন থেকে তার রাজনীতিতে আসার ঘোষণা এলো, বিরোধী শিবিরের মানুষগুলো একরাতেই তাদের ভালবাসাকে ঘৃণাতে রূপান্তর ঘটালো! সেই ঘৃণা জনে জনে ইনবক্স ঘুরে আমার কাছেও আসতে লাগলো।

মাশরাফি বিন মর্তুজা

জনৈক বুদ্ধিজীবী: ‘গাদ্দার। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা আর দেখবো না। স্বৈরাচার হাসিনার দালাল’।
আমি: মাশরাফি সম্পর্কে এইসব ফালতু ভিডিও আমাকে দেবেন না।
জনৈক বুদ্ধিজীবী: বিবেক নাই। সারা বাংলাদেশের ছিল ও আর সাকিব। এখন স্বৈরাচার হিটলার হাসিনার দালাল ওরা। ওদের বয়কট করুন। ও খেললে বাংলাদেশের খেলা আর দেখবো না …’নাহ ! এইসব মাথা নষ্টদের সাথে তর্কে যাওয়া যায় না। আবার নীরবে তাদের এই অযৌক্তিক ঘৃণা ছড়ানো অভিযান মেনে নেওয়াও যায় না, মানুষটা যখন হয় মাশরাফি। তাই এই লেখার অবতারণা।

জাতীয় দৈনিক আর অনলাইন পোর্টাল্গুলোর মাশরাফিকে নিয়ে করা নিউজের কমেন্টবক্সগুলোর অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, কুৎসিত সব গালি, কী নেই সেখানে! এতো বছর সফলতার সাথে দেশকে সম্মান এনে দেয়া মাশরাফির সম্মানের কথা তাদের বিবেচনায় রইলো না। এদেশের রাজনৈতিক দল্গুলোর অন্ধ সমর্থকেরা এমনই অবিবেচক।

আজ মাশরাফির আওয়ামী প্রার্থিতা বিএনপি তথা সমগ্র বিরোধী আওয়ামী লীগ শিবিরে যে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে মাশরাফি যদি বিএনপি প্রার্থী হতেন, একই ঘটনা ঘটতো আওয়ামী শিবিরে। যেমনটি নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস এর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। যদিও পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানিত পুরস্কার বিজয়ী হলেও ডঃ ইউনুস একজন মাশরাফির জনপ্রিয়তার ধারে কাছেও ছিলেন না। এমনকি মাশরাফির সতীর্থ সাকিব, তামিম বা অন্য যেকোনো সম্মানিত ক্রিকেটার নানান ক্যাটাগরিতে বিশ্বশ্রেষ্ঠ হলেও আচরণগত সীমাবদ্ধতায় মানুষের আবেগকে মাশরাফির মতো কেউ ছুঁতে পারেননি।

মাশরাফি একটা ভালবাসার নাম। মাশরাফি মানে বাংলাদেশ। মানুষের এই বিপুল ভালবাসায় মাশরাফি কখনো অহংকারে নাক উঁচু, শির উঁচু করে উদ্ধত আচরণ করেননি। বরং কেবলই বিনয়ে অবনত হতে দেখেছি তাকে আমরা। রাজনীতিতে পা দেবার আগেই তার জনকল্যাণমূলক কাজের কথা আমরা জানি। আর সেগুলো কোনভাবেই লোকদেখানো জনপ্রিয়তার জন্য নয়, নিতান্তই অন্তরের তাগিদে করা।

নড়াইলকে নিয়ে তার স্বপ্নের শেষ নেই। তাঁর মহানুভবতাকে পুঁজি করেই নড়াইলবাসীর নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন এগিয়ে চলেছে নানান উন্নয়ন আর জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে। মাশরাফির আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতায় নড়াইলের এক ঝাঁক তরুণ এর ধ্যান জ্ঞান আজ মানবসেবা, তথা শহর উন্নয়নের নেশায় পরিণত হয়েছে। মানুষ মাশরাফির বর্ণনা করতে গেলে এই লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমার মনে হয় সকলেই কম বেশি জানেন। তবু কী করে মানুষ তার সম্পর্কে এতো কুৎসিতভাবে বলতে পারে, আমার বুঝে আসে না। রেহাই দেয়া হচ্ছে না তার স্ত্রীকেও। যে সব শব্দবোমা তাকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া হচ্ছে, তার মধ্য থেকে সবচেয়ে ভদ্র (!) শব্দ হলো মাল!

মাশরাফির স্ত্রী কি বিরাট অন্যায় করেছেন? উনি স্বামীর হয়ে ভোট চাইতে গেছেন। আচ্ছা কোনো প্রার্থীর জীবনসঙ্গী তার স্বামীর জন্য ভোট চান না? এই ঘটনা কি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ঘটালেন মাশরাফির স্ত্রী সুমি? কেন আপনাদের এতো যন্ত্রণা হয়? আপনাদের দলের প্রার্থী হলে তো মাথায় করে নাচতেন। আমার ও অবশ্য মাশরাফির জন্য করজোড়ে তার স্ত্রীর ভোট চাওয়া ভালো লাগেনি। তার জন্য ভোট চাইতে হবে কেন? তাকেই বা কেন নাওয়া খাওয়া ভুলে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোটের জন্য যেতে হবে? লোকে নিজ দায়িত্বে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তার বিজয় নিশ্চিত করবে। আমার খুব গর্ব করে বলতে ইচ্ছে হয়, এই মাশরাফি আমাদের বলাকা আপার ছেলে! আমাদের বেড়ে ওঠা সময়ের সবচেয়ে সুন্দর শিশু কৌশিক। আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু কৌশিক।

লেখক: শামীমা জামান

নির্বাচনকে সামনে রেখে নানান প্রচারণা চলেছে। নায়ক নায়িকারা দলে দলে ভোট চাইতে নেমেছেন। এইসব অভিনব দৃশ্যের অবতারণা যদিও আগে দেখা হয়নি। চেনা অচেনা মানুষেরা যার যার চেতনার জয়গান করছেন। বেশ একটা উৎসব মুখর পরিবেশ, কোথাও বা গুমোট গুঞ্জন। আসলে কি ভালো কিছু কিম্বা প্রচণ্ড সর্বনাশা কিছু হতে চলেছে দেশে? অভাগা দেশে মানুষ কি তার সত্যিকারের পছন্দের প্রার্থীকে আদৌ খুঁজে পাবে? নাকি মন্দের ভালোকে বেছে সান্ত্বনা খুঁজে নেবে?

দুটি সাপ বেজি প্রতীকের চিরন্তন শত্রু শত্রু খেলা, হায়েনা, অজগর আর শকুনের চক্রবৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে আর কতকাল জিম্মি থাকতে হবে এই দেশের মানুষকে? ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি আর দলীয় সংকীর্ণতার বাইরে বের হতে পারেন কজন প্রার্থী?

মাশরাফি নির্বাচনের আগে তার সমস্ত সম্পদের হিসাব নিকাশের কাগজপত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়ে বলেছেন, ‘পাঁচ বছর পর এই হিসাব মিলিয়ে নেবেন’! ঠিক এইখান থেকে একটা স্বপ্নের জন্ম হতেই পারে। আমাদের কোনো আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন আরো ২৯৯টি মাশরাফির। মাশরাফি কেন এমপি হবে? সে হবে আমাদের জাস্টিন ট্রুডো।

শেয়ার করুন: