শিল্পী জলি:
কিছুদিন আগে একটি তরুণী মেয়ের ইসিজি করছিলাম। বুকের ব্যথা নিয়ে সে এসেছিল। তাই হার্টের অবস্হা কী জানতে ইসিজি করতে গিয়ে দেখি সব ক’টি লিড সিগনাল পাচ্ছে না। মেয়েটির ব্রেস্টো ঠিক প্রাকৃতিক মনে হলো না। শোবার পরও কেমন উধর্বমুখী হয়ে আছে। বললাম লিড তো ঠিকমতো সিগনাল পাচ্ছে না। বললো, আমিতো ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করেছি, তাই হয়তো এমন হচ্ছে। লিডগুলোর পজিশন কিছুটা বদল করে আবার ইসিজি করলাম।
আমেরিকায় অনেকেই ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করে। কখনও কসমেটিক কারণে, কখনওবা রিকন্সট্রাকটিভ ইস্যুতে। যেমন ব্রেস্ট ক্যান্সারে ব্রেস্ট রিমুভ হলে, আগুনে পুড়ে গেলে অথবা অন্য কোনো কারণে। কখনও কখনও এমনও হয় যে দু’টো ব্রেস্ট দু’রকমের, তখনও কেউ কেউ তা ইমপ্লান্ট করেন। আবার এমনও হয় যে কারও কারও ব্রেস্ট রিডাকশনেরও দরকার হতে পারে। তেমনও একজনের সাথে বহুদিন আগে পরিচয় ঘটেছিল যে বিশাল ব্রেস্টের কারণে কাঁধের ব্যথায় ভুগছিল, তাই ডলার জমাচ্ছিল অপারেশন করে ব্রেস্ট ছোট করতে।
যদিও আমেরিকাতে ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট তেমন কোনো নতুন ধারণা নয়, তথাপি বাংলাদেশের একটি ঘটনার আলোকে বিষয়টিতে কিছুটা আলোকপাত করছি।
কোন মেয়ে চাইলে ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করতেই পারে, সেই ফ্রিডম তার আছে– নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার বলে কথা। তথাপি ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করতে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই এবং রিসার্চ করা উচিত যেন সবদিক জেনে একটি ওয়াইজ সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
ব্রেস্ট ইমপ্লান্টে ব্রেস্ট এবং চেস্টের মাঝে সিলিকন জেল বা সিলিকন স্যালাইন ঢুকিয়ে দিয়ে ব্রেস্ট বড় করা হয়–কখনও ব্রেস্টের নিচ কেটে, কখনও বোগল/আর্মপিট এর কাছ দিয়ে, কখনও বা নাভীর ওখানে কেটে করা হয় এটা। এই রকমারি পথের সাথে রকমারি ঝড়ঝাপ্টা থাকে। সে যাই হোক, একাধিক রোগীর অভিজ্ঞতার আলোকে যা জানলাম, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাঙ্ক্ষিত সাইজের চেয়ে দুই/তিন সাইজের বড় হয়ে গিয়েছে, তাদের ব্রেস্ট এখন তাদের সামাজিক জীবনকে বাধাগ্রস্থ করেছে। এমনকি ব্রা পেতেও হিমশিম খেয়েছেন কেউ কেউ। হয়তো চেয়েছিলেন কাপ সাইজ বি, হয়ে গিয়েছে ডাবল ডি সাইজ। শুধু কি তাই? ব্যায়ামে অসুবিধা, শিশুকে ব্রেস্ট ফিডিংয়ে অসুবিধা, আরও কত রকমের ঝঞ্ঝাট।
সিলিকন সংক্রান্ত নানাবিধ ঝামেলাও জড়িয়ে রয়েছে ইমপ্লান্টের সাথে সাথে। যেমন, সিলিকন জেল নানা কেমিক্যালের সংমিশ্রণে তৈরি– এ্যালুমিনিয়াম, টিন, জিঙ্ক অক্সাইড, ব্রোমাইন, ক্রোমিয়াম, প্লাটিনাম, বেরিয়াম থেকে শুরু করে নানা ধাতব পদার্থের সংমিশ্রণ। তেমনি শেলটিও মিথাইল ইথাইল কিটোন, এ্যাসিটোন, সাইক্লোবেক্সানোন, ইউরেথেইন, পলিভাইনাইল ক্লোরাইড, ল্যাকার থিনার, ইথাইল এ্যাসিটেট ইত্যাদি জাতীয় নানাবিধ নিউরোটক্সিন এবং ক্ষতিকারক দ্রব্য যা শরীরের ভেতরে রকমারি ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটায় এবং রোগীর জীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্হ করে।
সিলিকন জেল এবং স্যালাইন ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা তৈরি করলেও দু’টোতেই একই জাতের শেল থাকে, যা একেক ব্যক্তির শরীরকে একেকভাবে প্রভাবিত করে। অমসৃণ শেল যেখানে ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত, সেখানে মসৃণটির সমস্যা হয়তো ভিন্ন। তাই কোন ধরনের সিলিকন ব্যবহার করা হবে, ডাক্তার কেমন, তার অভিজ্ঞতা কতটুকু, ইত্যাদি বিষয়গুলোও যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবুও ভরসা নেই।
সাধারণত আট-দশ বছরের জন্যে ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করা হয়। তবে অনেকের শরীরেই এই ইমপ্লান্টের কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়, যখন সৌন্দর্যের চেয়ে প্রাণ রক্ষার দিকেই গুরুত্ব দিতে হয় অধিক। এ জাতীয় সমস্যা শুরুতেও হতে পারে, আবার কয়েক বছর পরেও। কখনও সিলিকন স্যালাইনে ছত্রাক জন্মে তো, কখনও জেল ব্লিড ঘটতে পারে। কখনও বা শেলের সাথে বিক্রিয়া ঘটে শরীরের, কখনও বা সিলিকনের দেয়ালে ক্যাপসুল ফর্ম করে। তখন মূল চিকিৎসা হলো এক্সপ্লান্ট বা রিমুভাল। এমন হলে আগের চেয়েও হয়তো খারাপ দশা হয় ব্রেস্টের। মূলত স্বাস্হ্য বা জীবনরক্ষাই এই স্টেজের উদ্দেশ্য।
ব্রেস্ট ইমপ্লান্টজনিত যেসব সমস্যা এবং লক্ষণে রোগীর জীবন বরবাদ হবার দশা হয়, সেগুলো হলো সিলিকন টক্সিসিটি, বায়োটক্সিসিটি, ব্রেইন ফগ, অটো ইমিউন ডিজিজ, সাইনাস প্রবলেম, টায়ার্ডনেস, নিউরোপ্যাথি, হরমোনাল প্রবলেম, হেয়ার লস, ড্রাই আই, শরীরের ভেতরে মোল্ড ফরমেশন, লাইম ডিসিস,মেমোরি প্রবলেম, ওজন বেড়ে যাওয়া ,ব্লাডার প্রবলেম,নিউরোপ্যাথি,জয়েন্ট পেইন, এ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, প্যানিক এ্যাটাক, আত্মহত্যার প্রবণতা, BIA-ALCL (টি-সেল ক্যান্সার), থাইরয়েড সমস্যা, হরমোনাল সমস্যা, মেটাবলিক সিনড্রমসহ আরও অনেক অনেক অনেক কিছু।
অনেক ভুক্তভোগীই বলেছেন তাদের নাকি হাঁটার শক্তিও হারিয়ে গিয়েছিল, চলতেন হুইল চেয়ারে, অথচ বুঝতে পারছিলেন না ঘটনা কী? এক কথায় বলতে গেলে জীবন থাকে ঝুঁকিতে, যৌন সেনসেশনেও জটিলতা দেখা দেয়, জীবন হয় যায় যায় দিন, ওদিকে রোগও সহজে ধরা যায় না–প্রশ্ন থেকে যায়, কী হলো আমার? আমি কী আর বাঁচবো না তবে?
ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, মরে গেলে মানুষের স্ব স্ব পাপ অনুযায়ী কবরে নাকি এমন চাপ দেবে যে সেই চাপে একদিকের হাড় আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাবে। ইমপ্লান্টেও অনেকটা এমনই ঘটতে দেখলাম জেল ব্যাগের– পুরো কট্কটে শক্ত পাথর হয়ে গিয়েছে। ইমপ্লান্টকে শরীর ফরেইন বডি মনে করে শরীরকে রক্ষা করতে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে নানাবিধ ফ্লুইড দ্বারা। অতঃপর সেই ফ্লুইড শক্ত হয়ে হয়ে চাপতে চাপতে চ্যাগা করে দেয়। সেই চাপে ব্রেস্টের আকার-আকৃতি-প্রকৃতিসহ নানা জাতের পরিবর্তন ঘটে। এমনকি কেমিক্যালের লিকও ঘটে শরীরে ছড়াতে পারে। স্যালাইন ইমপ্লান্টের লিক হলে দু/একদিনের ভেতরেই হয়ত ব্রেষ্ট চুপসে যায়। তবে দু’টোই যে একই সাথে লিক হবে তেমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তখনও কিন্তু সমস্যা– একটি আছে আরেকটি খতম। টাকা জলে।
এফডিএ’র পরামর্শ মোতাবেক ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট একবারের সার্জারি নয়– বার বার সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে নানাবিধ জটিলতায়। জেল লিক হচ্ছে কিনা জানতে সার্জারির তিন বছর পর এবং তারপর প্রতি দুইবছর পর পর এমআরআই করা জরুরি লিক বুঝে টক্সিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে। সেইসাথে নিয়মিত ব্রেস্ট পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে কী দিয়ে কী হচ্ছে বুঝতে। উপরন্তু একবার ইমপ্লান্ট করলে আজীবনই করতে হয়, নইলে হয়তো হাড্ডি আর চামড়া অথবা ঝুলন্ত স্কিন ছাড়া ব্রেস্ট্রের আকৃতি খুঁজে পাওয়া কঠিন। আবার পুনরায় ইমপ্লান্ট করলেই যে ভালো থাকবে সবকিছু, তেমনও কোন নিশ্চয়তা নেই। সেইসাথে রকমারি অসুখ-বিসুখতো জড়িয়ে আছেই এই প্রক্রিয়ায়, অতএব জানো, বোঝো, কেন চাও এই ঝক্কি!
নানাদিক ঘেঁটেঘুঁটে যা বুঝলাম তাতে বলবো, খাল কেটে কুমীর না এনে যেমন আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উত্তম। জীবনই যদি না টেকে, তাহলে এমন ভেজালের ব্রেস্ট দিয়ে কী হবে আর? বাহ্যিক সৌন্দর্য আজ আছে, কাল থাকবে না, কিন্তু মনের সৌন্দর্যের বৃদ্ধি অবিরত ঘটানো সম্ভব। ফোকাস ওখানে থাকলেই ভালো– লাভ বই ক্ষতি নেই।