#MeToo: একটা জেনারেশন একধাপ এগিয়ে গেলো

ফাহমিদা খানম:

সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে #মিটু শব্দটার সাথে সবারই পরিচয় আছে, পক্ষে-বিপক্ষে অনেককিছুই পড়লাম আর ভাবছি, এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া সাধারণ মেয়েরা যে প্রতিদিন কতোভাবে নিগৃহীত হয়, আমরা কি বুঝি না, জানি না? রাস্তায়, টেম্পুতে, বাসে কতো অযাচিত স্পর্শ মেয়েদের শরীরে ঘিনঘিন ধরায়—আমরা কি জানি না? হেনস্থার শিকার না হলে মেয়েরা মুখ খুলতো কি?

আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের মুখ খোলাকে সাদরে মেনে নিবে না—এটাতো জানা কথা। কিন্তু যেসব নারী তাদের সাথে হাত মেলায়, তারা আসলে কারা?

সংসারে তিন ধরনের নারী থাকে –এক পক্ষ নির্যাতিতা হলেও সয়ে যেতে বাধ্য হয়, কারণ যে বয়সে এসব হয় তখন লজ্জা, লোকনিন্দার ভয়ে সে চুপ থাকে, আরেকদল নারী আছে, যারা নিজেদের স্বার্থের জন্যই উপরে উঠার সিঁড়ি হিসাবে মানুষকে ব্যবহার করে। কারণ নিজেদের মেধা, যোগ্যতার উপর তাদের নিজেদেরই ভরসা কম থাকে। এসব মেয়েদের পক্ষে আমরা কিছু লিখছি না, যে নিজেকে বুঝে সঁপে দিচ্ছে তার আর নির্যাতিতা মেয়ের মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। আরেক দল আছে, যারা সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে, নিজেদের মেয়েমানুষ বানিয়ে রাখে এরা। ভাগ্যক্রমে সার্টিফিকেট পেলেও এরা নিজেদের ভেতরবাড়ি উন্নত করার চেয়ে সবার মতো স্রোতে তাল ভাসায়, শিক্ষা কেবল তার কাছে সনদ, আজকাল এদের সংখ্যাই ভারী। রাঁধুনি আর মা হয়েই জগতের সব তৃপ্তি এদের।

বিয়ের আগে ৩/৪ টা ছেলের সাথে প্রেম করা মেয়েটাও বিয়ের পর একদম সতীসাধ্বী হয়ে যায়, কারণ সে জানে সমাজ, সংসার এটাকেই ভালো মেয়ে বলে, প্রেম করে বিয়ে করা দম্পতিকেও দেখেছি সন্তানের কাছে প্রেমের কথা গোপন রেখে আদর্শবান হতে। সেখানে কেউ যদি আঙ্গুল তুলে বলে তার সাথে অন্যায় হয়েছে, অনেকেই সহজভাবে নিবে না। উল্টো বলবে, কই, আমাদের সাথে তো হয়নি, তোমার সাথেই কেনো হইছে বুঝি না আমরা!

ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় ‘সম্ভ্রম’ রক্ষা করেই চলা আসল ধর্ম –তাই মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হলেও লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থাকে। হাজার বছর ধরে চলা সংস্কারমুক্ত হওয়াও তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। সমাজ, সংসার ভালো মেয়েদের একটা সংজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, সেখানে সে নিরবে সইবে, কাঁদবে –এখন কেউ যদি প্রতিবাদী হয়, সেখানে বাঁধা আসবেই, আর যদি সমাজের ক্ষমতাশীল কারো দিকে হাত তুলে, তাহলে উল্টা মেয়েটির গুষ্ঠি নিয়ে কথা তুলবে।কারণ পুরুষতন্ত্রের বুকে ধাক্কা মেরেছে, মানুষটির এতোদিনের সম্মান,পরিচয় যে ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে! যে দেশে মেয়েরা কাছের মানুষের কাছেই নির্যাতিতা হয় সেখানে প্রশ্ন তুলে কারা?

এক সাংবাদিক নারী নির্যাতনের কথা লিখতেন আর বাসায় স্ত্রীর প্রথম পক্ষের মেয়েকেই যৌন নির্যাতন করতেন। কী করে জোর দিয়ে বলি মানুষটা এমন হতেই পারে না? একজন বাবা বা ভাই ছাড়া অন্য কারো বেলায় এই জোর দেবার মতো সম্মান খুব কম পুরুষই অর্জন করতে পারে। আসলে ব্যাপারটা এমন, মেয়েরা প্রতিবাদী হলেই বিপদ। তাতে পুরুষ মানুষের চুলকানি হবেই। ধরেই নেয় সব মেয়েই চুপচাপ সয়ে যাবে, একটু ভাবুন কতোটা যন্ত্রণা হলে মেয়েরা মুখ খোলে!অবশ্য আমাদের চিন্তার জগত এখনও এতো উদার হয়নি, তাই অনেক সময় পরিবার জানলেও উল্টা বলে ‘সয়ে যা’, যেটা এক ধরনের নীরব সমর্থন অন্যায়কারীর প্রতি। ধারালো, শান দেয়া নারী সমাজ, সংসারের দরকার নাই। তাদের দরকার লুতুপুতু, ন্যাকামি করা মেয়েদের, যাদের মেরুদণ্ড নেই, অন্যের আলোয় আলোকিত আর বটবৃক্ষের মতো ছাদ পেলেই খুশী থাকবে, এদের নামের পাশে তকমাও দিয়েছে –সতী-লক্ষ্মী। তাই অনেক মেয়েরাও ছকের বাহিরে গিয়ে সাহসী হতে পারে না।

এদেশের অল্পকিছু পুরুষ ছাড়া বাকিদের কাছে মেয়েমানুষ মানে আজো একতাল মাংসপিণ্ড,তাইতো বন্ধু কিংবা প্রেমিকের কাছেও ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয় নারী, লালসার চোখ সবখানেই। এক জীবনে এদেশের প্রায় সব নারী কতোশতো অযাচিত স্পর্শ পায়, সে গুণেও শেষ করতে পারবে না, বয়স পর্যন্ত ব্যাপার না। যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাফেরা করেন, যেসব মেয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করে অথবা একটু সুখের আশায় বিদেশে গৃহকর্মী হয়ে যায়, তারা যদি মুখ খুলতে পারতো! আমার তো মনে হয় এদেশের সব মেয়েই #মিটু লিখতে পারবে, আর যারা বলে এসব বানোয়াট, তাদের কাউকে, কাউকে আমিও দেখেছি রেজাল্ট ভালো করার জন্য শিক্ষকদের সাথে আলাদা খাতির রাখতে, অথবা বসদের তেলাতে নিজের ভাগ্য বদলাতে, এরাই আবার নিজেকে সৎ দেখাতে কতো কী করে! মেয়েদের চিনতে মেয়েদের ভুল হয় না।

বুকের ভেতর যন্ত্রণা পুষে রাখলে আজীবন নিজের সাথেই যুদ্ধ করতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, আর যারা বলে ভালো মেয়েদের সাথে এসব হয় না, তারা সব মিথ্যাবাদী। আজকালকার মেয়েদের সাথেও অহরহ হয়, পরিমল স্যারের কথা ভুলে যাইনি। আশার কথা হচ্ছে, মেয়েরা মুখ খুলতে শুরু করেছে, ভয়কে পাশ কাটিয়ে নায়ক সেজে থাকা মানুষগুলোর সত্যিকার চেহারা সামনে নিয়ে আসছে, এই সংখ্যা ধীরে ধীরে আরো বাড়বে, তাতে সচেতনতা বাড়বে, ভালোমানুষি সেজে থাকা মুখোশ খুলবে আর মৃত হবার আগেই নিজের কাজের জন্য লজ্জিত হতে শিখবে পুরুষেরা, ন্যায়-অন্যায় এই বোধ জাগ্রত হবে।

সময়ের সাহসী সন্তান যারা নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদী হয়েছে, আমাদের মতো ভীরু মায়েরা এসব রত্নগর্ভাদের পাশেই আছি। যারা নিজেদের সাথে অন্যায়ের কথা বলেছেন –তাদের স্যালুট জানাই।

বিচার পাই আর নাই পাই আফসোস থাকবে না –কারণ পরের জেনারেশন এক ধাপ এগিয়ে গেলো, ওরা অন্যায়ের গালে চপেটাঘাত করে বসবে, আর আলোর দিশারী #মিটু সব মেয়েরা হবে। ওরাই শিখিয়েছে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে বাঁচতে হয় না। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি মুখোশ খুলে সবার সত্যিকার চেহারা বের হয়ে আসুক, আমাদের মেয়েদের অমানুষ চেনাই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.