#মিটু: বাঁধ ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস মাত্র!

ঈহিতা জলিল:

#মি টু আন্দোলন নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বরাবরের মতোই আমি সব থেকে পিছনে। আমি আসলে পিছনে থাকতে যেমন ভালোবাসি, তেমনি আবার হুটহাট লিখে ফেলতে পারি না।
আর সত্যি কথা বলতে শুচিস্মিতা সীমন্তির লেখা পড়ার পর আমার চোখের সামনে তালাবদ্ধ ধূলোর আস্তরণ পরা একটা বই উঠে আসলো। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলো কিছু দুঃসহ যন্ত্রণার ছবি। ভুলে যাওয়া স্মৃতি আবার চলে আসলো সামনে। সবুজ জামার স্মৃতি! খয়েরি সালোয়ার-কামিজের স্মৃতি! কালো তাঁতের শাঁড়ির স্মৃতি! গাউসিয়া মার্কেট-বই মেলা-নিজের বাড়ির পড়ার ঘর! কোনটা রেখে কোনটা বলি!

আসলে কি ভুলে যাওয়া? নাকি জোর করে ভুলতে চাওয়া? আমি তো কোনকিছু-ই ভুলি না। ঐ স্মৃতিগুলো কেমন করে ভুলবো? স্মৃতি নাকি দুঃস্মৃতি? সেই যন্ত্রণা ভাগ করার কেউ ছিলো না! কীভাবে বুঝে গেছিলাম এগুলো গোপন কথা! শুধু নিজের সাথে বলা যায়! তবে পরবর্তীতে আমার অনুজদের আমি সাবধান করেছি। আমার কাছের মানুষদের সন্তানদের সাবধান করেছি। আমি লাকি ছিলাম আমার পরিবারের কোন সদস্যের হাতে আমাকে এবিউজড হতে হয়নি, তাই এই বিষয়ে ধারণা ছিলো না।

পরবর্তীতে অনেক ঘটনা পড়ে জেনেছি পরিবারেও ঘটতে পারে এমন ঘটনা। আর ছেলেরা যে এবিউজড হয় এটা জেনেছি আমার স্বামীর সাথে পরিচয়ের পর। তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে যখন সে বলেছিলো “এতোদিন সে আর কাউকে এসব বলতে পারেনি”। এই যে বলতে না পারাকে বলতে পারাতে বদলে দেয়ার জন্যই প্রয়োজন #মিটু। এটি একটি বাঁধ ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস মাত্র।

এই যে আমি এতো বড় বড় কথা বলি-লিখি! কিন্তু আমি সত্যি কি সব বলতে পারি? বলতে পারা এতো সহজ না। তাই যারা বলতে পারেন, তাদের সাহসকে আমি সাধুবাদ জানাই। প্রতিটা মানুষের অভিজ্ঞতা আলাদা। যে কখনও সংসার করেনি, সে কখনও বুঝবে না এর ভালো/মন্দ দিক। যার কখনও ডিভোর্স হয়নি, সে কখনও বুঝবে না এটি কখন যন্ত্রণার আর কখন মুক্তির! এক ছাদের তলায় থেকেও দিনের পর দিন স্বামী-স্ত্রীর আলাদা থাকা কেমন, তা এক সুখী দম্পতি বুঝতে পারবে না। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নপুংসক স্বামী/স্ত্রীর ঘর করতে কেমন লাগে সেটি শারীরিক তৃপ্তি পাওয়া নারী/পুরুষ কখনও বুঝবে না। আবার যে কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পায়নি, সে বুঝবে না এর কদর্যতা কেমন!

শুচিস্মিতা যদি সুপ্রীতি ধরের মেয়ে না হতো, তাহলে ওকে নিয়ে এতো ঘাঁটাঘাঁটি হয়তো হতো না!! আমি তো কোন নারীবাদীর মেয়ে ছিলাম না। তবে আমি কেনো আমার মাকে বলতে পারিনি! বাবা-মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা উঠলে সেই সন্তানের কেমন লাগে, সেটি যে ফেস করেনি সে কখনও বুঝবে না!

তাই অপরাধীর ছবি শেয়ার করার সময় তাঁর পরিবারের কথাও মাথায় রাখা উচিত। মাথা গরম করে অনেক বড় বড় জ্ঞানী মানুষ এমন কিছু কাজ করে ফেলেন যা কাম্য নয়। এই যে বলা শুরু হয়েছে এতে কি হবে জানেন? যারা ভাবতেন যে এই বিষয়ে কেউ বলবে না, তাঁরা সতর্ক হবেন।

এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো সবাই তো সবই লিখে ফেলছে আমি কী বলবো? তখন আমার মনে হলো আমি একটু একেবারে সাধারণ গৃহিণী নারীটি কী ভাবছে সেটি একটু জানি তো!! কথা বললাম, একজন গৃহবধূর সাথে। তিনি বললেন, ঘটনাগুলো প্রকাশ হওয়া যেমন জরুরি, সেইসঙ্গে এটিও সতর্ক হতে হবে অভিযোগ তোলার সময় কেউ যেনো মিথ্যা অভিযোগের শিকার না হয়। তাই অভিযোগকারীর সাথে সাথে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

গতকাল মাঝ বয়সী এক পুরুষ আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বিষয়টি আসলে কী! তিনি শিক্ষিত এবং একজন চাকুরীজীবী। আমি তাঁর সাথে কথা বলে বুঝলাম উনার বিষয়টি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা নেই। উনি ভেবেছেন, এটি কোনো একটি ঘটনার আন্দোলন। আমি যখন তাঁকে বোঝালাম প্রথমত এটি কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। এবং এটি কোন নির্দিষ্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। তখন উনি বিষয়টি বুঝলেন। তখন আমার আরো বেশী করে মনে হলো, মিটু বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা খুব জরুরি।

আমার মনে হয় পৃথিবীতে খুব কম নারীই আছেন, যার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের অভিজ্ঞতা নেই। পুরুষদের সংখ্যাটা কম, কিন্তু নগণ্য নয়। আমরা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারবো না, আমরা কখনও এবিউজড হইনি, আবার আমাদের জীবনের পুরুষরা সবাই সাধু পুরুষ! আমাদের জীবনের পুরুষেরা হয়তো আমাদের জন্য অসাধারণ পুরুষ, কিন্তু অন্য কারো জীবনে তাঁরা সেটি নাও হতে পারেন। আবার সব স্পর্শ যে খারাপ, তাও কিন্তু না!!

এখন আমাদের করণীয় কী? বলার সাথে সাথে আরো কিছু পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে। আমাদের সন্তানদের ডেঞ্জার পয়েন্ট শিখাতে হবে বয়স তিন হলেই। আর বড়দের শেখাতে হবে কোন ধরনের স্পর্শ গ্রহণযোগ্য নয়।

সব বয়সের মানুষকে জানতে হবে সেক্সুয়াল এবিউজের সংজ্ঞা কী! আমাদের সন্তানেরা যেনো নির্ভয়ে কথা বলতে পারে সেই প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হবে। সবার জীবন এক না। সবার যুক্তি এক না। সবার প্রতিবাদের ভাষাও এক হবে না। একেকজনের যুদ্ধ একেকরকম। একেকজনের প্রতিবাদ একেকরকম। যারা মিটু নিয়ে হাস্যরস করছেন, তাঁদের ঘরের সন্তানটির খবর যেন তাঁরা নিয়ে নেন।

এরই মধ্যে কিছু পুরুষ দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন, তাদের সাধুবাদ। কারো শক্তি হতে না পারি, আসুন কারো নাজুক সময়ে তাঁকে অন্তত রক্তাক্ত না করি। যদি বুঝতে না পারি, অনুভব করতে না পারি তাহলে চুপ থাকি। সব বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। আর একটা কথা, #মিটু আন্দোলন কিন্তু পুরুষের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন নিপীড়কের বিরুদ্ধে। আর নিপীড়নকারী নারী বা পুরুষ যে কেউ-ই হতে পারে।

“আশু কে সাঙ্গ না বাহুঙ্গি সাখী
আব না ম্যা গুমসুম রাহুঙ্গি সাখী
সেহনে সে বেহতার
কাহুঙ্গী সাখী”।

#MeToo
#MeTooBangladesh

শেয়ার করুন: