জহুরা আকসা:
“ আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। প্রচণ্ড পেট ব্যথা ছিল ,তাই হেড স্যারের কাছে গিয়ে বললাম,”স্যার, পেট ব্যথা, ছুটি দেন।” স্যার সুন্দর করে কাছে এসে আমার পেটের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়ে বললেন, কোথায় ব্যথা? এখানে? এখানে?
যাই হোক, এক পর্যায়ে স্যার আমাকে ছুটি দেন। কমন রুমে বড় আপুরা ও বন্ধুরা জানতে চাইলো, স্যার আমাকে কিভাবে ছুটি দিলেন??
আমি বললাম; আমার পেটে হাত দিয়ে উনি বোঝার চেষ্টা করলেন সত্যি আমার পেটে ব্যথা আছে কিনা? তারপর চলে যেতে বলেছেন। এই বলে আমি হে হে, ইয়াহু বলে ব্যাগ ঘাড়ে নিচ্ছি যাচ্ছি, আর পিছনে কমন রুমে থাকা বড় আপুরা, বন্ধুরা স্যারকে কুত্তার বাচ্চা, শুয়ারের বাচ্চা আরও বিচ্ছিরি গালি দিয়ে ধুচ্ছে।
এটা আমার পিরিয়ড হওয়ায় বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা। তখন ওরা স্যারকে কেন গালি দিয়েছিল না বুঝলেও পরে ঠিকই বুঝেছি। এরকম প্রত্যেক মেয়ের সাথেই স্কুলে, প্রাইভেটে, বাসে, অটোতে, নিজের বাড়িতে,ল্যাবে, বসের রুমে অহরহই ঘটছে।
আমার মনেহয় প্রত্যেকটা মেয়ে #মিটু এর শিকার।”
…. কথাগুলো লিখেছেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ২৩ বছর বয়সী মৌরী সিদ্দিকা। যিনি শৈশবে স্কুলের হেড মাস্টার দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন ।
শুধু মৌরী সিদ্দিকা নয়, তার মতx আরো অনেক স্কুল জীবনে স্যারদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল।
তার সত্যতা মিলে ২৭ বছর বয়সী ফারজানা সিরাজ শীলার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। তিনি পেশায় একজন সমাজ সেবক এবং উন্নয়ন কর্মী, তিনি লিখেছেন ;
“ আমি তখন চুয়াডাঙ্গা সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। আমাদের শ্রেণী শিক্ষক ছিলেন রহমান স্যার। তখন দেখতাম স্যার যাদের বেঞ্চের কাছে যেতো তাদেরই মুখ শুকিয়ে যেতো। আর স্যারের অন্যতম কাজ ছিলো পিঠে হাত বোলানো। সেভেনে তার কোন ক্লাশ ছিলো না। এইটে ওঠার পর তিনি আবার কৃষিশিক্ষা ক্লাশ নিতো। একদিন আমি কোন কারণে পড়া পারিনি।
স্যার আমার কাছে এসে আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ব্রার ফিতা টেনে ধরে ছেড়ে দিলেন। লজ্জায় ভয়ে কুঁকড়ে গেছিলাম। বাসায় ফিরে কারো সাথে সে কথা শেয়ার করতে পারিনি। অনেক দিন মন খারাপ ছিলো। ক্লাশ নাইনেও একই ঘটনার পুনারাবৃত্তি করে ছিলেন কয়েকবার। স্কুলটাকে আমার কাছে তখন জাহান্নাম মনে হতো।
শুধু আমি না আমার সহপাঠীদের অনেকেই তাদের পিঠ কুঁজো করে হাঁটতো শুধু স্যারের অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে মুক্তি পাবার জন্য। এটা অবশ্যই মলেস্টেশন ছিলো। যা আমার মনের ওপর অনেক দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রভাব ফেলেছিলো। শুধু রহমান স্যারেরা একা নয়, তারা দলে দলে আছে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
#Me too তে আমিও আছি সামিল।”
ফারজানা, মৌরীর মতো ইলা মিত্র শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। ২৫ বছরের ইলা মিত্র তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন-
“আমার বয়স তখন পাঁচ ছয় এর বেশি ছিল না। তখন আমরা দাদা দাদির বাড়ি যেতাম টেম্পুতে করে। সম্ভবত এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগত। আমি আর ছোটবোন দাদির সাথে দাদার বাড়ি যাচ্ছিলাম । টেম্পুতে প্রচুর ভিড়। দাদি ছোটবোনকে কোলে বসিয়ে নিয়েছে, আমাকে এক লোক আদর করে তার কোলে বসিয়ে নিলো। আদরের মাত্রা কিছুক্ষণ পরেই বেড়ে গিয়েছিল ।
হঠাৎ অস্ফুট জরায়ু পথে প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম। উনি আমাকে খুব জোরে জাপটে ধরে ছিলেন। মুখের দিকে ব্যথায় করুণভাবে তাকাতেই “আম্মু কী হলো” বলে আদর দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর আবারও একই জায়গায় একই আঘাত। এবার কোল থেকে সরে যেতে চাইলাম, আবার জাপটে ধরে বললো “আর না আর না”। পুরো রাস্তা তার কোলে বসেই ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে ছিলাম। এরপর থেকে পুরুষ মানেই আমার কাছে আতঙ্ক ছিল।
কিন্তু কাউকে এসব কথা বলতে পারিনি। বড়ো হওয়া পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক ছিলাম না। এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছিল আমার উপর। আমি সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনি।
সবশেষে তিনি সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করে বলেছেন যে; আমরা যেন কেউ যাত্রাপথে আমাদের ছেলে/মেয়ে বাচ্চাটিকে কোনো পুরুষের কোলে বসতে না দেই।”
শুধু ইলা মিত্র নয়, ছোটতে নিজ বাড়ির পুরুষ সদস্যের দ্বারা একইভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হোন জান্নাতুল ফেরদৌসি মানু। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন-
“আমার বড়লোক ‘খালু’, বছরের পর বছর আমাদের স্কুল পড়ুয়া কাজিনদের (আমিসহ) যৌন হয়রানি করেছে। বাদ যায়নি আমাদের ৮ বা ১০ বছরের খালাতো-মামাতো বোনেরাও।
বড়দের সামনেই আদরের ছলে, কাউকে কোলে বসিয়ে, কাউকে ঘরের কোণে আটকিয়ে রেখে, কারু কাছে পানি চাওয়ার অজুহাতে — বিভৎস আচরণ করেছে দিনের পর দিন।
আমরা তাকে দেখলেই ভয়ে ঘরের কোণে পালাতাম। আমার খালা (তার স্ত্রী) তিনিও জানতেন। আমাদের পাহারা দিয়ে রাখতেন।
কিন্তু কেউ কিছুই বলতো না! যেন কেউ কিছু জানেই না। কারণ তার অনেক অনেক টাকা। সবার সুখে-দু:খে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেন আমরা প্রতিবাদ করিনি তখন বা এখন?
কিন্তু আমার মেয়ের সাথে কেউ এমন কুৎসিত আচরণ করলে তাকে ’খুন’ করবো!”
আসলে শৈশবে আমরা নিজের সমস্যার কথা তেমনভাবে বুঝতেও পারি না, আবার কী হয়েছে তা বাবা-মায়ের বকাবকির ভয়ে বলতেও পারি না। কিন্তু শৈশবে সেই কদর্য স্মৃতি ঠিকই আমাদের মনে থাকে। যা আমাদের মনোজগতে বিরুপ প্রভাব ফেলে।
শৈশবে এমন কদর্য ঘটনা যাতে অন্য কারোর সাথে না ঘটে সেই প্রসঙ্গে রুমানা রশীদ রুমী, যিনি একজন লেখিকা, তিনি তার টাইমলাইনে লিখেছেন ;
“এ বছরের শুরুতে মেয়েকে পুরুষ হুজুরের কাছে দিয়েছি। আর নতুন স্কুলে ভর্তি করায় স্কুল বাসেও দিয়েছি। দুই জায়গাতে যেটা সবচেয়ে বেশী চিন্তিত করেছে মেয়ে আমার মাত্র পাঁচ বছরের। অনেক কিছুই বুঝবে না। নিরাপদ থাকবে তো!!
এবং যা হবার হলো পুতুলের মতোন দেখাতে মেয়ে আমার যেখানে যায় সবাই আদর করে জাপটে ধরতে আসে। এই জাপটে ধরার মধ্যে যতই আদর বোঝাতে চাক না কেন, আমি সবাইকে সুন্দর করে সামনা সামনি কথাটাই বলতে পছন্দ করি।
সেদিন পড়ার পর হুজুরের কাছে একটু বাড়তি সময় চেয়ে নিলাম। বললাম: কিছু মনে না নিতে। কিন্তো এটাই ঠিক যে- আজ আপনি, ওর বাবা, ওর ভাইকেই ও প্রথম পাচ্ছে যে ছেলে হয়েও আদর করে। এই অভ্যাসটা থাকলে বাইরের যে কেউ যখন ওকে স্পর্শ করবে ও বুঝতে পারবে না কোনটি উচিত নয়। তাই ভালো হবে একটু নিরাপদ দূরত্বে মেয়েকে বসিয়ে পড়াবেন। মুখে আদর করে কথা বললেও স্পর্শ করবেন না। এমন কথা বলবেন না যা শালীনতার সীমা অতিক্রম করে। হুজুর খুব অমায়িকভাবে বলেছেন, আপা আমি বুঝতে পারছি। আমারও মেয়ে বাচ্চা আছে।
এমন কথা গাড়ির ড্রাইভারকেও জানিয়েছি। খেয়াল করে দেখেছি হুজুর আর ড্রাইভার ভাই কথাটা বুঝেছেন। তারা খুব সংযত আচরণ করেন।
এটাই ভালো হয়েছে বরং। সরাসরি না বলে যদি আমি আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম তা তাদেরও বিব্রত করতো।আর আমি কী বোঝাতে চাইছি বুঝতেই পারতো না। কথা বলে পরিষ্কার করাটাই ভালো।
আমি তো শুধু চাই আমাদের মেয়েরা নিরাপদ থাকুক। তার সম্মানিত জীবন রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।”
রুমী হয়তো ঠিকই বলছেন। আসলে শিশুদের নিরাপদ শৈশব দেওয়া এবং তাদের যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা আমাদের সকালের দায়িত্ব। আসুন আমরা সকলে শিশুদের ব্যাপারে একটু সচেতন হই। শিশুদের দিকে খেয়াল রাখি।