হালিমা রিমা:
ঘটনা ১: স্কুল থেকে ফেরার পরই মা বললেন আজ সন্ধায় রফিক আঙ্কেলরা আসবেন। মা স্নান করে ভাল জামাও পরতে বললেন। রফিক আঙ্কেলকে রুম্পার একটুও পছন্দ নয়। তিনি যখন আসেন সবসময় অনেক গিফট আনেন রুম্পার জন্য, অনেক মজার গল্প করেন; তবুও রুম্পার ভালো লাগে না। ইদানিং তিনি শুধু কারণে-অকারণে রুম্পাকে আদর করতে চান। শুধু শুধু রুম্পার পিঠে হাত দেন, না হয় পাশে বসে কোমরে হাত রাখেন। কাজটা মা বাবার সামনেই করেন। রুম্পার এতো অস্বস্তি হয়। কিন্তু কেউ বোঝে না। মাকে একদিন বলেছিল মা তো বুঝলোই না বরং বকা দিয়ে দিল বললো ‘তোমাকে এতো আদর করে আর তুমি পছন্দ করো না কেন? তিনি তোমাকে তার মেয়ের মতো স্নেহ করেন।’
ঘটনা ২: মিতু চাকুরীজীবী। তার দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তান। তার বাসায় একজন বয়স্কা মহিলা আছেন যিনি সব কাজ সামলান। রহিমা খালার বয়স হয়েছে তাই তার সাহায্যের জন্য একজন ১২ বছর বয়সী মেয়েকে রাখা হয়েছে। একদিন ছুটি নিয়ে মিতু বাসায় ছিল। দুপুরে কোন এক প্রয়োজনে রান্নাঘরের দরজা ধাক্কা দিতেই দেখলেন সেই মেয়েটি এক হাত দিয়ে দরজা ধরে রেখেছে আর ভয়ে কাঁপছে। মিতু এর কারণ জেরা করে যেটা বুঝতে পারলেন তা হলো এর আগে যে বাসায় মেয়েটি ছিল সেখানে সে প্রতিনিয়ত শারীরিকভাবে অত্যাচারিত হয়েছে। দুপুরে যখন সবাই ঘুমিয়ে যেত তখন বাসায় থাকা বয়স্ক লোকটির হাতে সে লাঞ্ছিত হয়েছে, তাই তার মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছে। মিতুর কষ্টে চোখে পানি চলে এলো, কারণ তার মেয়েটিও এই বয়সী।
ঘটনা ৩: রাহেলা সন্তানসম্ভবা। তার দেখাশোনার জন্য গ্রাম থেকে তার এক আত্মীয়া এসেছে থাকবে বলে। রাহেলার অগোচরে তার বিশ্বস্ত স্বামীজী তার বোনকে নানাভাবে শারীরিকভাবে লাচ্ছিত করার চেষ্টা করে। অসহায় মেয়েটি না তার মা বাবাকে, বা বোনকে কিছু বলতে পারে! এ ক্ষেত্রে দিনের পর দিন যৌন নিপীড়িত হয়ে তাকে দিন কাটাতে হয়!
ঘটনা ৪: অফিসের বস স্মৃতিকে যেন একটু বেশীই তার কক্ষে কারণে-অকারণে ডাকেন। কাজ বুঝে নেয়ার নাম করে কখনো পিঠে বা কোমরে হাত রাখেন। অথচ বস স্মৃতির বাবার বয়সী।
ঘটনা ৫: রিঙ্কি এসএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করার পর তার খালুকে সালাম করতেই তিনি তাকে আশীর্বাদ করার নাম করে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন। রিঙ্কির প্রচণ্ড অস্বস্তি হলেও কিছু বলার ছিল না। অথচ কাজটা সবার সামনেই ঘটেছিল।
ঘটনা ৬: কলেজে প্রতিদিন বাসেই যাতায়াত করে সিমি। পাশের সিটে যে মহাপুরুষ থাকেন তিনি শাহেনশাহের মতো হাত পা ছড়িয়ে বসেন। সিমি অতি কষ্টে গা বাঁচিয়ে জড়সড় হয়ে বসার চেষ্টা করে যাতে অনাকাঙ্খিত স্পর্শ থেকে বাঁচা যায়। আর যদি দাঁড়িয়ে যেতে হয় তবে পিছনে থাকা মহামানবটি তার বিশেষ অঙ্গটি দিয়ে অকারণে ধাক্কা দিতে থাকে।
এসবই কখনো না কখনো যে কোন মেয়ের জীবনে ঘটে থাকে। এভাবে প্রতিনিয়ত প্রতিদিন মেয়েরা ঘরে বা বাইরে চলার পথে নিগ্রহের শিকার হয়। একটা মেয়ে জানে এই অবস্থার সম্মুখীন হলে তা তাকে কতটা বিপর্যস্ত করে। আর তাই আসুন আমরা আমাদের সন্তান বা বোনকে এইসব বিষয়ে সচেতন করে তুলি।
একটা শিশুকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার বাবা মায়ের। বিকৃত মানসিকতার পশুরা খুব কাছের হতে পারে সে হয়তো আপনারই ভাই বা আত্মীয়। তাই চোখ কান খুলে রাখুন। আপনি একটু বিশেষ লক্ষ্য রাখলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। অনেকেই আপনার শিশু কন্যার সাথে কথা বলার সময় অকারনে তার গাল ধরে টানবে নয়ত তার অনাবৃত পিঠে হাত বুলাবে অহেতুক জড়িয়ে ধরবে ! এমন দেখলে সামনেই প্রতিবাদ করুন। বাচ্চাকে বোঝান তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ কোনটি। আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ তাকে কীভাবে ব্যবহার করতে চাইতে পারে তা জানাতে হবে। প্রয়োজনে সেইফ এবং আনসেইফ স্পর্শ এবং তার স্পর্শকাতর অঙ্গটি চিনিয়ে দিতে হবে। তবেই সে বুঝবে কীভাবে চলতে হবে। নিজের বাচ্চাকে শিখান প্রতিবাদী হতে এবং সবকিছু আপনার সাথে শেয়ার করতে।
সচেতনতা একটি বড় বিষয়। আমার বাচ্চা কার সাথে মিশছে বা পাশের বাড়িতে যে শিশুটির সাথে খেলছে, তার বাসার পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হোন। আপনি যখন কাজে ব্যাস্ত তখন সে বাসায়ই কোন অন্যায়ের শিকার হচ্ছে কিনা তা আপনাকেই খেয়াল রাখতে হবে। আপনি সচেতন হলে বাচ্চা নিজেও সচেতন হতে শিখবে। প্রতিবাদ করা লজ্জার কিছু নয় বরং দুষ্ট যে তার জন্যই অপমানজনক এটা শিখাতে হবে।
আমি চাই না আমার সন্তান বা অন্য কারো সন্তান যৌন নিগ্রহের অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হোক। কিছু প্রাথমিক আত্মরক্ষার কৌশল শিখান বাচ্চাকে। এখন এগুলো ইন্টারনেটে লার্নিং ভিডিও দেখেও নিজে এবং বাচ্চাকে শেখানো যায়। এখন বাচ্চাদের উপযোগী বিভিন্ন ভিডিও আছে যাতে সেইফ টাচ এবং আন্সেইফ টাচ বিভিন্ন ঘটনা বা নাটিকা আকারে পাওয়া যায়।
সচেতনতা পরিবার থেকে শিখাতে হবে। নিজেকে বাঁচিয়ে চলা শেখাতে হবে। আমি সেখানেই আমার বাচ্চাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে দিব যেখানে আমি নিজে থাকতে পারবো। সচেতন মা তার বাচ্চাকে সব অবস্থায় সচেতনতার সাথে চলতে শিখাতে পারেন।
চাই না আর কোন মেয়ে তার জীবনে me too এই অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠুক । বরং সচেতনতার সাথে সেই সব নরপিচাশদের মুখোশ খুলে দেই না কেন? কেন ভিক্টিম হবো বরং তাদের কথা জানিয়ে সবার সামনে তার পরিচয় তুলে ধরব তাকে লজ্জা দিব।
#MeTooBangladesh