পরিবারই হোক মাথা রাখার প্রথম কাঁধ

ফারহানা আনন্দময়ী:

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একজনের কাছে পরিবারই হোক তার মাথা রাখার প্রথম কাঁধ। আমার বেদনা-বঞ্চনা শোনার জন্য পরিবারই প্রথম পাতুক কান। অন্ধকার খাদ থেকে টেনে তোলার জন্য একজনের দিকে বাড়ানো প্রথম হাতটি যেন তার পরিবারের হয়। বয়সের একটা সীমা পর্যন্ত পরিবার মানে আমার মা-বাবা এবং ক্ষেত্রভেদে ভাইবোন। বয়সের সেই নির্দিষ্ট সীমা পেরোনোর পরে পরিবার বলতে আমি বুঝবো স্বামী কিংবা স্ত্রী এবং সন্তানেরা। পরিবারের সংজ্ঞাটি তাই স্পষ্ট ক’রে জেনে নেয়া জরুরী। ভরসা করে নিজের আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেয়ার জন্য আত্মীয়স্বজন কখনোই পরিবারের অংশ নয়। একমাত্র কারো পরিবার যদি তার সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকে, সমাজে সেই সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান এবং তার নিজস্ব কঠিন সময়ে দৃশ্যত একলা হলেও, মানসিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

এ বোধ যে আমার হঠাৎ-ই জাগ্রত হলো আর নীতিকথা শোনানোর জন্য লিখতে বসে গেলাম, ঘটনা তা নয়। কাল আমি বারান্দায় বসে আছি, ভেতরে মোবাইলফোনের নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক কাজ না করায়, আমাদের বাড়ির অনেক বছরের সাহায্যকারী নারীটি দেখলাম এদিকে এসে ফোনে কথা বলছে। নারীটি মধ্যবয়সী, বেশ রাগতঃস্বরে তার মেয়ের বরের সাথে কথা বলছিল।
কানে যেটুকু এলো, শুনলাম, বলছে, “তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার কে? মেয়ে যদি তোমার অপছন্দের কিছু করে থাকে, আমি এখনো বেঁচে আছি, আমি ওর মা, আমারে বলবা, আমি গিয়ে তারে বোঝাবো, দরকার হলে শাসন করবো। তোমার এতো বড় সাহস আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েরে মারো! আর একদিন যদি আমি শুনি আমার মেয়ের গায়ে তুমি হাত তুলছো, আমি এখান থেকে গিয়ে সোজা তোমারে দুই টুকরা করে টেনে ছিঁড়বো।”
ফোন রেখে সে আমাকে ঘটনা বললো। আমি বিস্মিত, মার-খাওয়া-মেয়ের মায়ের এই ভূমিকা দেখে। এবং একইসঙ্গে অভিভূত।

রা কত অনায়াসে সমাজকে তোয়াক্কা না করে নির্যাতিতা মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারলো। নিরক্ষর একজন নারী হয়েও তার মেয়ের অধিকার রক্ষায় কী দাপুটে স্বরে সোচ্চার হতে পারলো! কত সহজ উচ্চারণে বউ-পিটানো পুরুষটিকে বলতে পারলো, “মাইর খাওয়ার জন্য আমার মেয়েরে আমি তোমার সাথে রাখবো না।”

অথচ আমরা? নিজেদেরকে সমাজে শিক্ষিত-সম্মানিত অংশ বলে বড়াই ক’রে বেড়ানো মা-বাবা, পরিবার কত সহজে শ্বশুরবাড়িতে হেনস্থা হওয়া কন্যাকে উপদেশ দিই, “মা-বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে, সমাজের কথা ভেবে আরেকটু সহ্য করো, মা”। সন্তানের সম্মানের চেয়ে সমাজে নিজেদের অসম্মানিত হওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ জড়সড় আমরা। কন্যার নিগ্রহকে আমলে নিই না আমরা, তাকে জীবন্মৃত অবস্থায় দাম্পত্যযাপনে বাধ্য করি। এক অর্থে পরিবারই হয়ে উঠি নির্যাতনকারীদের অদৃশ্য সহচর।

এ তো গেল দাম্পত্য কলহের বিষয়। এই যে আজ আমরা #MeToo তে যেসব যৌনহেনস্থার কথা শুনছি, এখানেও যদি পরিবার প্রথম থেকেই একজনের অভিযোগ আমলে নেয়, প্রতিকার না হোক, অন্তত প্রতিরোধ তো গড়তে পারে। শিশু যৌনহেনস্থার মত ভয়ঙ্কর একটি অভিযোগ যেন শিশুটি কোনোরকম দ্বিধাভয় ছাড়াই মা-বাবাকে জানাতে পারে, ঘরের পরিবেশটি তার অনুকুলে রাখার চর্চাটা মা-বাবাকেই করতে হবে। একজন শিশু যখন ঘরে দ্যাখে তার বড় বোনকে মা অবিরাম বলে যাচ্ছে, এসব লজ্জার বিষয়, তোমারই লজ্জা, চেপে রাখো… তখন এই শিশুটির সাথে ঘটে যাওয়া এমন নিপীড়ন সে সাহস করে তার পরিবারকে জানাতে চাইবে না। আমি জানি এই সমাজে সব পরিবারেই বেড়ে-ওঠার পরিবেশ একইরকম নয়, তারপরেও মায়েরা যদি একটু বেশি সচেতন হোন নিজের শিশুসন্তানটির বিষয়ে, একটু বেশি যদি খোলামনে তাদের সাথে কথা বলেন, সম্পর্কটা ভয়ের চাইতে ভালোবাসায় সংরক্ষণ করেন, তাহলে শিশুসন্তানেরা পরিবারকেই তার ভরসার প্রথম আশ্রয় বলে ভাবতে পারবে।

আপনার কিশোরী বা সদ্যতরুণী কন্যা যদি আপনার কাছে এসে তার স্কুলে কিংবা আত্মীয়তার বলয়ে ঘটে যাওয়া কোনো যৌনহেনস্থার অভিযোগ করে, অনুগ্রহ ক’রে তাকে বিশ্বাস করুন। তাকে উলটো দোষারোপ না ক’রে তার অভিযোগ আমলে নিন। আপনার সাধ্যের মধ্যে যতটা পারেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। স্কুল-কলেজে ঘটনা ঘটলে, লিখিত অভিযোগ দিন কতৃপক্ষকে। পরিবারের মধ্যে ঘটলে আত্মীয়তা ভুলে যান। হেনস্থাকারী যদি আপনার পরম কাছের কেউ-ও হয়, তাকে ছাড় দেবেন না। আপনার জীবনে আপনার সন্তানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই আপনার বাবা-চাচা-মামা-খালু নন।

আর পরিণত বয়সে পৌঁছানোর পরে ঘরে বা কর্মক্ষেত্রে কখনো যৌনহেনস্থার শিকার হলে প্রকাশ করতে দেরি করবেন না। পরিবারের কাছে এসে মন খুলুন, হতে পারে আপনার জীবনসঙ্গী বা প্রাপ্তমনস্ক সন্তা্নের কাছে। এই সমাজে আবার বেশিরভাগ নারীরই জীবনসঙ্গীর কাছে অভিযোগ জানানোর একটা সমস্যা অবশ্য আছে।

গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সঙ্গী যদি হয়, তখন উলটে আপনাকে অভিযুক্ত করতে পারে, “একা কেন গেছো? নিশ্চয়ই তোমার আচরণেও এমন কিছু ছিল যা তাকে অন্যরকম ইঙ্গিত দিয়েছে?” তো সেক্ষেত্রে মা-বাবা, ভাইবোন আর প্রাপ্তমনস্ক নিজসন্তানকে জানান। এই প্রজন্মের সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মানসিকভাবে অগ্রসরতা পায়। চিন্তার দীনতা তাদের মগজে কম প্রভাববিস্তারী। তাদেরকে আপনার অভিযোগটি জানান। এমনও হয়, মা-বাবা যেমন সন্তানকে সাহসের মশালটা জ্বালিয়ে দিতে পারেন, কোনো ক্ষেত্রে সন্তানও পারে বিধ্বস্ত সময়ে মায়ের শক্তিসঞ্চারি হয়ে উঠতে। যত আপনি এধরনের নিগ্রহের ঘটনা গোপন করে রাখবেন, পচন তত বেশি ছড়াবে। আপনার তোলা আওয়াজে আশেপাশের আরো পাঁচজন নারী সতর্কবার্তা পাবে।

যৌথপরিবার ভেঙেচুরে আজ অণু-পরমাণু পরিবারে রূপ নিচ্ছে, স্থিরতা পাচ্ছে। হোক, তবু তো পরিবার। একটি পরিবারে যদি মাত্র তিনজন সদস্যও থাকেন, তো তারাও পারস্পরিক বন্ধুতার জায়গাটিতে আলো-বাতাস আসতে দিন। তাতে ভরসার জায়গাটিও হাত-পা মেলবে। সাহসের জায়গাটি সোজা হয়ে দাঁড়াবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি জেনেছি, শিশুসন্তান, কিশোরসন্তান কিংবা সদ্যতারুণ্য স্পর্শ করা সন্তানটির মননে-মগজে যদি একবার জানা হয়ে যায়, অনুকূল-প্রতিকূল যে কোনো পরিস্থিতিতে সে সবার আগে পরিবারকে পাশে পাবে, কঠিন সময়ে পরিবারের কাঁধে সে নির্দ্বিধায় মাথাটি রাখতে পারবে, তখন তার সমগ্র জীবনচলার পথটি কুসুমমসৃণ না হলেও অন্ততঃ কাঁটায় আকীর্ণ হয় না। অন্ধকার খাদে পড়লেও সে পরিবারের হাত ধরেই উঠে আবার দাঁড়াতে পারবে, নোংরা কাঁদামাটি ঝেড়ে আলোর পানে দৌড়াতেও পারবে। তার সেই চলার পথটি হতে পারে শিক্ষাজীবনের পথ, কর্মক্ষেত্রের পথ, এমনকি দাম্পত্যজীবনপথ।

#SolidaritywithMeTooMovement

#MeTooBangladesh

শেয়ার করুন: